শীতের ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে যাঁরা খেলা দেখবেন, অস্ট্রেলিয়া সফরে তাঁদের কথা ভাবুন বিরাটরা

২০০৪ সালে ভোরে ঘুম ভাঙা সার্থক হল, অস্ট্রেলিয়া সফরে সিরিজে এগিয়ে গেল ভারত

 |  5-minute read |   20-11-2018
  • Total Shares

তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না...

ধ্যুস! শীতকালের সকাল আবার মিষ্টি হয় নাকি। শীতকালের সকাল মানেই তো লেপমুড়ি দিয়ে অলস ঘুম। কতক্ষণ? যতক্ষণ না সূর্য্যিমামা মধ্য গগনে উঠে রোদ পোহানোর ব্যবস্থা করছেন, ততক্ষণ।

একটু ভুল লিখলাম। ক্ষেত্রবিশেষে বা দিন বিশেষে শীতের সকাল মিষ্টি হয়। যখন অলস ঘুমকে বিদায় জানিয়ে, ভালোবাসার লেপটাকে এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে বিছানা ত্যাগ করতে ভালোই লাগে। তা সে বাইরের তাপমাত্রা যাই থাকুক না কেন।

আসলে সেই দিনগুলোতে (অধিকাংশ সময়ে রবিবারেই পড়ে) যে চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বঙ্গ অভিধানেও যার পোশাকি নাম এখন পিকনিক। সকাল সকাল যোগ দিতে হবে, কারণ জলখাবারেরও ব্যবস্থা আছে। পাঁউরুটি, ডিম সিদ্ধ আর কলা কিংবা কড়াইশুঁটির কচুরি বা আলুর দম - যতই একঘেঁয়ে লাগুক না কেন খেতেই হবে। মাত্র কয়েকদিন আগেই গুণে গুণে কড়কড়ে নোট উদ্যোক্তাদের দিয়ে এসেছি। খামোকা ছাড়তে যাব কেন? তার জন্য যদি শীতের সকালে লেপের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানতে হয়, হোক।

ক্রিকেট ভক্তদের জন্য পিকনিক ছাড়া আরও একটি কারণে শীতের সকাল মধুময় হয়ে ওঠে। সেই সুযোগ অবশ্য দু'তিন বছর অন্তর আসে। ভারতীয় ক্রিকেট দল যদি অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। স্টিভ ওয়, অ্যালান বর্ডারদের দেশে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের মাদকতাটাই আলাদা।

body_112018021321.jpg২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে সিরিজ ড্র রেখে ফিরেছিল ভারত [ছবি: এপি]

টেস্ট যখন শুরু হয় সময়ের পার্থক্যের জন্য ভারতে তখন সূর্য্যের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে বা শুরু করবে করবে। কোনওক্রমে আড়মোড়া ভেঙে টিভি চালিয়ে আবার লেপের তলায় আশ্রয় নেওয়া। এই সিরিজের মাদকতা ও উত্তেজনার সঙ্গে থাকে এক রাশ আতঙ্কও।

আশির দশকের কথা মনে পড়ে গেল। বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচ শুরু হবে পরের দিন থেকে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি ভোরে উঠেই টিভি চালাতে হবে। একটি বলও মিস করা যাবে না। কিন্তু বিধি বাম। স্কুল ছুটি। তাই 'আর্লি টু বেড' আর হল না। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি দেরি হয়ে গিয়েছে। অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে টেস্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনও রকমে দুরু দুরু বুকে টিভি চালিয়ে স্পোর্টস চ্যানেল ঘোরালাম। আর কী আশ্চর্য! আশঙ্কা যে সত্যি হল। টসে জিতে ভারতকে ব্যাট করতে পাঠিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর ওয়াকার সবুজ উইকেটে ভারতের স্কোর তখন মাত্র ২২ রান, তিন উইকেটে।

এবার আসা যাক নব্বইয়ের শুরুর কথায়। আজহারের ভারতে সেবার দুই বঙ্গ সন্তান। সুব্রত ব্যানার্জি ও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভের ভাগ্যে অবশ্য সেই সিরিজে টেস্ট ক্যাপ জোটেনি। সুব্রতর ভাগ্যে জুটেছিল। সিডনিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে। ২-০ সিরিজ হারছিল ভারত। ১৭০ রানে পিছিয়ে থেকে ম্যাচ শেষে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল আট উইকেটে ১৭৩। মানে, ভারত জিততেই পারত।

সেদিন বারবেলায় পাড়ায় শুরু হল গণআন্দোলন। ক্রিকেটপ্রেমীদের আসামি অধিনায়ক আজহার। প্রথম টেস্টেই প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট তুলে নেওয়ার পরেও দ্বিতীয় ইনিংসে কেন এক ওভারও বল করতে দেওয়া হল না সুব্রতকে? এই নিয়ে উত্তাল গোটা বাংলা। রাগ যত বেশি না ভারত হেরেছে বলে তা চেয়ে বেশি শীতের সকালে ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে বলে। ভাবখানা এমন - সকাল সকাল জয়ের প্রত্যাশায় ঘুম থেকে উঠলাম। আর, তুমি (পড়ুন আজহার) সুব্রতকে বল করতে না দিয়ে জেতা টেস্টে ড্র নিশ্চিত করলে!

অবশেষে, ২০০৪ সালে, বাঙালির শীতের সকালে ঘুম ভাঙার কঠোর পরিশ্রম সার্থক হল। ব্রিসবেনে প্রথম টেস্টে প্রথমে ব্যাট করল অস্ট্রেলিয়া। ৩২৩ রান তুলল।

জবাবে ভারত কী করবে? সেই সময়ে বিদেশের মাটিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্যর্থ হওয়া তো ভারত একরকম অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরল। অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৪৪ রানের সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়ার রান টপকে গেল ভারত। প্রথম টেস্ট ড্র।

নড়েচড়ে বসল আসমুদ্রহিমাচল। দ্বিতীয় টেস্ট ব্র্যাডম্যানের পাড়ায়, অ্যাডিলেডে। প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া তুলল ৫৫৬ রান। জবাবে রাহুল দ্রাবিড়ের ২৩৩ আর ভিভিএস লক্ষণের ১৪৮ রানের সুবাদে ভারত তুলল ৫২৩। টেস্ট ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র হতে চলেছে - এরম একটা ধারণা যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখনই জ্বলে উঠল ভারতীয় বোলাররা। আগরকরের ছ'উইকেটের সৌজন্যে ১৯৬ রানে শেষ অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে ছ'উইকেট হারিয়ে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলল ভারত। আর এই জয়ের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে টেস্ট সিরিজে এগিয়ে গেল।

body1_112018021344.jpg২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে রচিত হয়েছিল মাঙ্কিগেট [ছবি: রয়টার্স]

মেলবোর্ন তৃতীয় টেস্টে হারলেও চতুর্থ তথা শেষ টেস্টে একটা সময়ে জয়ের মতো পরিস্থিতিতে পৌছে গিয়েছিল ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৪২ রান তাড়া করতে নেমে একটা সময় ১৯৬ রানে চার উইকেট পড়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়াকে টেনে তুললেন ক্যাটিচ ও স্টিভ ওয়। ঘরের মাঠে জীবনের শেষ টেস্টটি খেলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। টানটান উত্তেজনার মধ্যে টেস্ট যখন শেষ হল তখন ছ'উইকেটে ৩৫৭ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। বৃষ্টিতে আধঘণ্টা খেলা বন্ধ না থাকলে টেস্ট যে কোনও দলই জিততে পারত।

আসমুদ্রহিমাচল সেদিন খুশি। শুধু সৌরভরা টেস্ট সিরিজে ড্র রেখেছে বলে নয়। শুধু হাড্ডাহাড্ডি একটি ম্যাচ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে বলে নয়। আসলে সেদিন যে শীতের সকালে ঘুম ভাঙার কষ্ট সফল হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে ২০০৮ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের কথাও মনে পড়ছে। অনিল কুম্বলের নেতৃত্বে সেবার অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল ভারত। সিরিজ হেরেছিল ২-০ ব্যবধানে। কিন্তু সেই সিরিজের মাদকতা অন্য জায়গায় পৌছোছিল অন্য একটি কারণে।

সিরিজ চলাকালীন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন হরভজন সিং এবং অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। যে বিতর্কের পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছিল 'মাঙ্কিগেট'। অনেকের বদ্ধমূল ধারণা সেদিন সাইমন্ডসকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় হিন্দিতে গালিগালাজ করেছিলেন ভাজ্জি -- সাইমন্ডসের মাকে জড়িয়ে। কিন্তু সাইমন্ডস হিন্দি বোঝেন না। ভাজ্জি হিন্দিতে যা বলেছিলেন সেই হিন্দি উচ্চারণের কাছাকাছি ইংরেজি উচ্চারণ যা হয় তাই তাঁকে বলা হয়েছিল ভেবে বসেছিলেন সাইমন্ডস - 'মাঙ্কি', অর্থাৎ বাঁদর। শাস্তি পেয়েছিলেন হরভজন। কিন্তু এই ধারণা যদি সত্যি হয়, তা হলে বলতেই হবে গুরু পাপে লঘু দণ্ড পেয়েছিলেন তিনি।

এসব কারণের জন্যেই অস্ট্রেলিয়া সফরের উত্তেজনাটা একেবারেই অন্যরকম। মাদকতাটাও অন্যরকম। তাই তো পৌষ-মাঘের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে ক্রিকেট ভক্তরা টিভির পর্দার সামনে বসে। তা সে যতই পৃথিবীর কঠিনতম কাজ হোক না কেন।

বিরাটের নেতৃত্বে এবার অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে ভারত। সেদেশের ছবির মতো সুন্দর মাঠগুলোতে অবশ্য কঠিন লড়াই অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁদের জন্য।

আশা করি, লড়াইয়ের সময় দেশে বসা লক্ষাধিক ভক্তের এই ভোরে ওঠার আত্ম্যত্যাগের কথাটাও মাথায় রাখবেন তাঁরা।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment