ভারত অধিনায়কদের জন্য নির্দিষ্ট সৌরভ ম্যানুয়াল অনুসরণ করুন বিরাট কোহলি
অধিনায়ক নিযুক্ত হন আর নেতারা জন্মান, তাই সবাই স্টিভ-ইমরান-সৌরভ হতে পারেন না
- Total Shares
ইউটিউবে বিশেষ একটি ভিডিয়ো রয়েছে, সুযোগ পেলে একদিন দেখে নিতে পারেন।
উপলক্ষ্য ছিল সচিন তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী প্রকাশ। সেই অনুষ্ঠানে জমাটি আড্ডায় মেতেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের ফ্যাভ ফোর - রাহুল, সৌরভ, লক্ষ্মণ ও সচিন। সেশনটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন ধারাভাষ্যকার হর্ষ ভোগলে।
আড্ডা চলাকালীন এক জায়গায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, "আমি বোধহয় বিশ্বের একমাত্র অধিনায়ক যাকে দলের বাকিদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হত, 'আমি কি আজ ওপেন করতে পারি', 'আমি কি আজ অমুক করতে পারি', 'আমি কি আজ তমুক করতে পারি'।" বেশ জোরের সঙ্গেই কথাগুলো বলেছিলেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। উপস্থিত সহকর্মীদের হাসি দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে সৌরভ সত্যি কথাই বলছেন। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ করতালিতে ফেটে পড়েছিলেন।
সৌরভের এই কথায় যে এক বর্ণও মিথ্যা নেই তা তাঁর ক্রিকেট জীবনের স্কোরকার্ডগুলো দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এক থেকে ছয় বিভিন্ন পজিশনে ব্যাট করেছেন তিনি। ক্রিকেট জীবনের শুরুতে সন্দীপ পাটিলের সৌজন্যে সাত নম্বরেও ব্যাট করতে দেখা গিয়েছে বেহালার বাঁ-হাতিকে।
ভারতীয় ক্রিকেটের এক দুয়োরানি কী ভাবে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হয়ে উঠলেন সেই রূপকথা শোনানোর জন্য এই লেখা নয়। এখানে অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ কতটা সফল তাই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা নেতা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় [ছবি: রয়টার্স]
অনেকেই মনে করেন বা বলে থাকেন, নবাব পটৌদি নাকি ভারতীয় অধিনায়কদের ম্যানুয়াল তৈরি করে দিয়েছিলেন। জাতীয় ক্রিকেট দলের পরবর্তী অধিনায়কদের কাজ শুধু সেই ম্যানুয়াল অনুসরণ করে চলা। কথাটা অর্ধসত্য। পাটৌদি ম্যানুয়াল তৈরি করেছিলেন ঠিকই আর সেই ম্যানুয়াল পরবর্তী অধিনায়করা অনুসরণও করেছিলেন।
কিন্তু ২১ শতকের শুরুর দিকে ভারতীয় ক্রিকেটের রাজ্যপাট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে যেতেই নতুন ম্যানুয়ালের পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় দলের বাঙালি অধিনায়ক নতুন একটি ম্যানুয়াল তৈরি করেছিলেন যা রাহুল, কুম্বলে, ধোনির মতো তাঁর পরবর্তী অধিনায়করা হুবুহু অনুসরণ করেছিলেন। ভারতের বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলিও করছেন।
সৌরভের ম্যানুয়ালের প্রথম অধ্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই অধ্যায়তে প্রাদেশিকতা লোপ পাওয়ার উল্লেখ আছে। দেশের হয়ে তাঁরাই সুযোগ পাবেন যাঁরা জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্বের জন্যে যোগ্য। প্রথম একাদশে তাঁরাই থাকবেন যাঁরা ম্যাচ উইনার হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখেন। ভারতীয় নাগরিক হলেই হল, তিনি কোন রাজ্যের বা কোন ধর্মের বা কোন জাতের সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আর এই প্রাদেশিকতা লোপ পাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছিল বলেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন দক্ষিণপূর্ব রেলের প্রাক্তন টিকিট পরীক্ষক রাঁচির মহেন্দ্র সিং ধোনি। প্রাক-সৌরভ যুগে ঝাড়খণ্ডের কোনও ক্রিকেটার ভারতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করবেন তা কল্পনাই করা যেত না।
বিরাটের ভারত কি প্রাদেশিকতা থেকে মুক্ত? গত বছর মার্চ মাসে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে সাত নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয়েছিল দীনেশ কার্তিককে। যিনি শেষ বলে ছয়ে মেরে ভারতকে সেই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। অনেকেই বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন যে দিল্লির বিরাট আর মুম্বাইয়ের রবি শাস্ত্রী নাকি চেন্নাইয়ের কার্তিকের উত্থান আটকাতেই তাঁকে সাত নম্বরে পাঠিয়ে ছিলেন।
শাস্ত্রীদের বেনিফিট অফ দ্য ডাউট দেওয়াই যেতে পারে। কিন্তু স্কোরকার্ড উল্টে দেখা যায় ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কার্তিকের মতো অভিজ্ঞকে সাজঘরে বসিয়ে রেখে ব্যাট করতে পাঠানো হচ্ছে নবাগত মনীশ পাণ্ডে ও বিজয় শঙ্করকে। এক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছুর গন্ধ পাওয়াই তো স্বাভাবিক!
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ম্যানুয়াল জোড়াতাপ্পি বা সাময়িক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিল না। দেশে যদি একজনও যোগ্য ওপেনার না থাকে তা হলে এমন কোনও ব্যাটসম্যানকে খুঁজে বের কর যে দলের প্রয়োজনে ওপেন করতে পারে। বীরেন্দ্র শেহবাগকে ওপেন করতে পাঠিয়ে ছিলেন তিনি। আর ওপেনারের ভূমিকায় নিঃসন্দেহে সফল শেহবাগ। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর তিনি বুঝেছিলেন রাহুল দ্রাবিড় নয়, ভারতীয় দলের প্রয়োজন একজন উইকেটরক্ষকের যিনি ব্যাটটাও ভালো করতে পারেন।
মূলত তাঁর অনুরোধেই দলে সুযোগ পেয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর সৌরভ তাঁকে সুযোগও দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশাখাপত্তনমে হঠাৎই তাঁকে তিন নম্বরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে শতরান করেন ধোনি। বাকিটা ইতিহাস।
বিরাট কোহলি অধিনায়ক হতে পারেন, কিন্তু এখনও নেতা হননি [ছবি: রয়টার্স]
এবার কোহলির ভারতে আসা যাক। বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা, বছরের মাঝে ইংল্যান্ড ও বছরের শেষ প্রান্তে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দু'টি টেস্ট - গোটা বছরেই বিদেশের মাটিতে ব্যর্থ ভারতীয় ওপেনাররা। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাতে গোনা তিন চারজনকেই সুযোগ দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নতুন ওপেনার কিংবা দলের অন্য কোনও যোগ্য ব্যাটসম্যানকে ওপেন করতে পাঠিয়ে পরখ করে নেওয়া হচ্ছে না। এমন একজন ওপেনারের খোঁজ চলছে না যাতে এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া যায়।
এর মাসুলও হাতেনাতে দিতে হচ্ছে ভারতকে। বিরাটের ভারতকে অনেকটা আজহারউদ্দিনের ভারত বলে মনে হচ্ছে। সচিন রান পেলেই ভারত জিতবে, নচেৎ নয়। কখনও কখনও আজহার, সিধু বা কাম্বলি দলকে উদ্ধার করে দেওয়ার মতো ইনিংস খেলে দেবেন। বিরাটের ভারতও একই রকম। ব্যাটিং লাইনআপ পুরোটাই বিরাট-নির্ভর। মাঝে মাঝে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবেন কে এল রাহুল কিংবা চেতেশ্বর পুজারারা।
সৌরভের ভারতে অবশ্য সচিন তেন্ডুলকর অপরিহার্য ছিলেন না। শুধু সচিন কেন কেউই অপরিহার্য ছিলেন না। শেহবাগ থেকে শুরু করে রাহুল, সৌরভ সচিন, যুবরাজ সিং এমনকি মহম্মদ কাইফ -- প্রত্যেকেই জিতিয়েছেন ভারতকে। প্রত্যেকেই কঠিন পরিস্থিতে ম্যাচ জিতিয়েছেন ভারতকে। ব্যাটিং লাইনআপের সেই জৌলুশ কোহলির ভারতে কোথায়?
সৌরভের ম্যানুয়ালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল খেলোয়াড়দের শারীরিক ভাষা। শুধু ব্যাট বল হাতে নয় মনস্ত্বাত্বিক দিক থেকেও বিপক্ষকে আক্রমণ করতে হবে। স্টিভ ও যখন 'ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার' জয় করতে এ দেশে এসেছিলেন তখন টস করতে যাওয়ার সময় একটি ম্যাচে তাঁকে অপেক্ষা করিয়ে রাখেন সৌরভ। তবে, ইচ্ছে করে নয়। কিন্তু সৌরভ যখন বুঝলেন এতে স্পষ্টতই বিরক্ত হচ্ছেন স্টিভ, পরবর্তী ম্যাচগুলোতে এই ফর্মুলা শুরু করে দিলেন তিনি। এতে লাভও হয়েছিল।
২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভের ভারত টিম সার্কেল আমদানি করেছিল। ইনিংসের শুরুতে বা উইকেট পতনের পরে একসঙ্গে গোল হয়ে দাঁড়ানো। বিশ্বকাপ ফাইনালে পরের দিন কলকাতার একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পাতা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ম্যাচ হারার কোনও দুঃখ ছিল না সেই পাতায়। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার কোনও আফসোসও ফোটে ওঠেনি সেই পাতায়। আট কলম জুড়ে সেই টিম ইন্ডিয়ার সার্কেলের ছবি। সঙ্গে একটি ক্যাপশন যার বাংলা তর্জমা, "হারে দুঃখ পেও না, এই বিশ্বকাপে এই ভাবেই তোমাদের আমরা মনে রাখব।"
বিশ্বকাপ ফাইনালের হার নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। কিন্তু, খেলায় তো হারজিত আছেই। আর ফাইনালে ভারত হারলেও তার আগের সাতটি ম্যাচ যে প্রাণ ভোলানো ক্রিকেট খেলল! সেই কৃতিত্ব কেন একটি ফাইনাল হারে খাটো করে দেখা হবে?
শরীরের ভাষার কথা যদি বলতেই হয় তাহলে ২০০২ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালের কথা বলতে হয়। ৩২৫ রান করে ম্যাচ জিতেছিল ভারত। আর, এই জয়ের মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন মহম্মদ কাইফ ও যুবরাজ সিং। ম্যাচ শেষে লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে গেঞ্জি উড়িয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। কিন্তু, ইংরেজদের মতো প্রবল 'ভারত বিদ্বেষী'রাও সমালোচনা করতে পারেননি।
আসলে তার মাসকয়েক আগে ইংরেজ পেসার অ্যান্ড্রু ফ্লিন্টফ মুম্বইতে সিরিজের শেষ ম্যাচ জিতে খালি গায়ে মাঠ জুড়ে দৌড়েছিলেন। তারই বদলা নিয়েছিলেন সৌরভ। বার্তাটা বেশ পরিষ্কার ছিল - 'তুমি যদি গাভাস্কার বেঙ্গসরকারদের মাঠে খালি গায়ে দৌড়াতে পার আমিও তা হলে গ্রেস-হবসদের ব্যালকনিতে খালি গায়ে গেঞ্জি ওড়াতে পারি। তুমি যদি সিরিজের শেষ ম্যাচ জিতে সিরিজে সমতা ফিরিয়ে এই কাজ করতে পার, তাহলে আমি ফাইনালে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উচ্ছ্বাস দেখাতে পারব না কেন?"
এবার আসা যাক বিরাটের ক্রিকেট অগ্রাসনের কথায়। মাঠে বিরাটের শরীরের ভাষা নিঃসন্দেহে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। কিন্তু অধিনায়কের শরীরের ভাষা শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও প্রয়োজন। অধিনায়ক কোহলি মাঠের বাইরে কতটা সফল তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
বিপক্ষ অধিনায়কের সঙ্গে কথাকাটি হতেই পারে। কিন্তু কোহলি তো মাঠের মধ্যে একবার সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে। সেই সংঘাত মাঠের বাইরেও লক্ষ করা গিয়েছিল। তুমি দেশের অধিনায়ক। দেশের একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার যে তোমার নেতৃত্বে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে তার সঙ্গে তোমার ব্যক্তিগত সংঘাত বাঁধবে কেন? বাঁধলেও তা মিটিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ অধিনায়ককেই নিতে হবে। বিরাট তা নেননি।
আসলে, দেশের অধিনায়ক তো কয়েকজন মিলে ঠিক করেন। তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কেউই অধিনায়ক হতে পারেন। 'মিয়াঁ তুম কাপ্তান বনোগে' -- আজহারউদ্দিন যেমন অধিনায়ক হয়েছিলেন রাজ সিং দুঙ্গারপুরের নেতৃত্বে। কিন্তু নেতা তো আর ব্যক্তির ইচ্ছায় হওয়া যায় না।
দশক প্রাচীন সেই প্রবাদটি মনে পড়ে যাচ্ছে। অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়, নেতারা জন্মান। তাই তো সবাই স্টিভ ও, ইমরান খান বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হতে পারেন না।