তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ের মাদকতাই আলাদা, ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বশ্রেষ্ঠ জয়

কৃতিত্বের বিচারে বিরাটের সিরিজ জয়ের চেয়ে এগিয়ে সৌরভের ২০০৩-০৪-এর অস্ট্রেলয়া সফর

 |  4-minute read |   09-01-2019
  • Total Shares

২৪ অগস্ট ১৯৭১, ২৫ জুন ১৯৮৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭, ২ এপ্রিল ২০১১ - ভারতীয় ক্রিকেটের চারটি ঐতিহাসিক দিন। প্রথমটি ইংল্যান্ডে, ভারতীয় দলের প্রথম বিদেশের মাটিতে সিরিজ জয়। দ্বিতীয়টিও ইংল্যান্ডে, প্রথমবার ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। ২০০৭ সালে টি-২০ বিশ্বকাপ জিতেছিল ধোনির ভারত। ২০১১ সালে আবার ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত, এবার অবশ্য ঘরের মাঠে।

ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহাসিক দিনগুলোর তালিকায় কি এবার ৭ জানুয়ারি, ২০১৯-ও ঢুকে পড়বে? বিরাট কোহলিদের হেডস্যার অবশ্য বলছেন, ভারতের অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয় তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও বড়। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য কতটা যুক্তিসঙ্গত?

৭১ বছরে এই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতল ভারত। নিঃসন্দেহে, ভারতীয় ক্রিকেটের সোনালি ইতিহাসে স্থান করে নেবে এই দিনটি। কিন্তু ভারতীয় জনমানসে প্রভাব বিস্তারের কথা যদি বলেন তা হলে কপিলস ডেভিলসের তিরাশির বিশ্বকাপ জয় আরও অনেক বেশি কৃক্তিত্বের। ভারত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন - আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে এই শব্দযুগলের প্রভাব যতটা পড়েছিল তার ধারেকাছেও আসে না অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবার টেস্ট সিরিজ জয়ের প্রভাব।

বিরাট কোহলির ভারত অসাধারণ। অস্ট্রেলিয়াতে চার টেস্টেই অসাধারণ খেলেছেন চেতেশ্বর পূজারা, ঋষভ পন্থ, মোহম্মদ শামি বা জসপ্রীত বুমরারা। তার ফলও পাওয়া গেছে হাতেনাতে। এশিয়ার প্রথম ক্রিকেট দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতেছে ভারত। এই কৃতিত্বের কোনও তুলনা চলে না।

body_010919021000.jpgতিরাশির বিশ্বজয়ের মাদকতাই আলাদা [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে]

কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হচ্ছে রবি শাস্ত্রীর পর্যবেক্ষণ ভুল। ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে এই জয় বড় নয়। কিন্তু কেন?

স্বাধীনোত্তর ভারত আশির দশক অবধি ক্রীড়াক্ষেত্রে যে সাফল্যগুলো পেয়েছিল তার সিংহভাগই এসেছিল হকির থেকে। ১৯৮০তে মস্কো অলিম্পিক্সে শেষবারের জন্য অলিম্পিক্সে স্বর্ণপদক জিতেছিল ভারত। ব্যাস! ওই শেষ। এর পর ভারতীয় হকি দলের মনে রাখার মতো পারফর্ম্যান্স কোথায়?

এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জনগণ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে এমন একটা সাফল্যের খোঁজ করছিল যে সাফল্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব। আর, ঠিক এই সন্ধিক্ষণেই এল ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়। বিরাট কোহলির এই ভারত অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতলে জিততে পারে - এমন একটি আশা অনেক ক্রীড়াপ্রেমীই করেছিলেন। কিন্তু তিরাশির বিশ্বকাপে ভারত জিততে পারে এমন আশা হয়তো ভারতের অতি বড় সমর্থকও করেননি। বস্তুতপক্ষে, বেশ কয়েকটি অঘটন ঘটিয়ে ফাইনালে গত দু'বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে পরাজিত করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দলের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মহিন্দর অমরনাথরা।

এই জয়ের ফলে শুধুমাত্র আসমুদ্রহিচলই যে গর্ববোধ করেছিল তা নয়, এই জয়ের ফলে ভারতীয় ক্রিকেটের কদরও অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিল। একদিনের ক্রিকেটে আশির দশকে এর পরে বেশ কয়েকটি সাফল্য এসেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৮৫ সালের বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ। তিরাশির সেই বিশ্বকাপ জয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যায় যে মাত্র চার বছরের মধ্যে, পরবর্তী বিশ্বকাপে, ভারতীয় ক্রিকেট দলকে টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট হিসেবে গণ্য করা হচ্ছিল। ভারতের দুর্ভাগ্য, রিলায়েন্স বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে মুম্বাইয়ে (তখন বোম্বে) গ্রাহাম গুচের সুইপ সেই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে দিয়েছিল ভারতকে।

তিরাশির বিশ্বকাপ জয়ের ফলে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে এক ধরণের গণহিস্টিরিয়া তৈরি হয়েছিল। হরভজন, ধোনি এমনকি আজকের বিরাট কোহলিরাও তো সেই গণহিস্টিরিয়ার ফসল। এক লহমায় হকি, ফুটবল বা অন্যান্য খেলাগুলোকে পিছনে ফেলে ক্রিকেট ভারতীয়দের পয়লা নম্বর পছন্দের খেলা হয়ে উঠেছিল।

body1_010919021119.jpgসচিন, রাহুল সৌরভদের অনেক কঠিন অস্ট্রেলিয়ার মোকাবিলা করতে হয়েছিল [ছবি: রয়টার্স]

আশা করা যায়, রবি শাস্ত্রী সে সব দিনগুলোর কথা ভুলে যাননি।

শাস্ত্রী অবশ্য তাঁর বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বলেছেন, "এটা টেস্ট ক্রিকেট। ক্রিকেটের রিয়াল ফর্ম্যাট, যেটা সবথেকে কঠিন।" অর্থাৎ ইতিহাস বা জনমানসে প্রভাব নয়, পাফর্ম্যন্সের দিক থেকে এই সিরিজকে তিরাশির বিশ্বকাপ থেকে এগিয়ে রাখছেন ভারতীয় দলের হেডকোচ।

তবে এখানেও তিনি ঠিক কথা বলছেন না। বিশ্বকাপ পারফর্ম্যান্স তো দূর অস্ত্। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিম ইন্ডিয়ার ২০০৩-০৪ মরসুমের অস্ট্রেলিয়া সফরের পারফর্ম্যান্স বিরাটের এই সিরিজ জয়ের পারফর্ম্যান্স থেকে এগিয়ে থাকবে।

কেন? টিম পেনের অস্ট্রেলিয়া আর স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে তফাৎটা আকাশ-পাতাল।

স্টিভ ওয়ের সেই দলটির সাত নম্বর ব্যাটসম্যান ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। পাঁচ উইকেট পতনের পরেও বিপক্ষ বোলারদের নিস্তার নেই। সিডনিতে সিরিজের শেষ টেস্টে তো স্টিভ ওয়ের (তাঁর ক্রিকেট জীবনেরও শেষ টেস্ট ছিল এটি) অনবদ্য ৮০ আর ছ'নম্বর ব্যাটসম্যান ক্যাটিচের অপরাজিত ৭৭ রান ভারতকে জিততে দেয়নি সেই টেস্ট। সিরিজ শেষ হয়েছিল ১-১ ব্যবধানে। সমগ্র ব্যাটিং লাইনআপটাও বেশ ঈর্ষণীয়। ল্যাঙ্গার, হেডেন, পন্টিং, মার্টিন, স্টিভ ওয়, ক্যাটিচ ও গিলক্রিস্ট।

body2_010919021218.jpgপ্রথমবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতল বিরাটের ভারতের [ছবি: রয়টার্স]

এবার আসি বোলারদের কথায়। সেই সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণের দায়িত্ব ছিল ব্রেট লি ও জ্যাসন গিলসপির হাতে। তা সত্ত্বেও সিডনি টেস্টে প্রায় চারের কাছাকাছি গড় রেখে ৭০৫ রান তুলেছিল ভারত। সচিন তেন্ডুলকর ২৪১, ভিভিএস লক্ষ্মণ ১৭৮। তবে, শুধু সিডনিতে নয়, গোটা সিরিজটাই অনবদ্য খেলেছিল ভারতীয় দল।

এবার আসা যাক টিম পেনের অস্ট্রেলিয়ার কথায়। এই অস্ট্রেলিয়া দলের পারফর্ম্যান্সের দিক থেকে সবচাইতে ভালো ব্যাটসম্যানটির নাম উসমান খাওয়াজা। কিন্তু তাঁরও যে কনসিসটেন্সির যথেষ্ট অভাব ছিল। দলের একটি ব্যাটসম্যানও সিরিজ জুড়ে একটিও শতরান করতে পারেননি। সিংহভাগ ব্যাটসম্যান তো তিন অঙ্কের ধারে কাছেও পৌঁছাননি।

বিরাটের দলের পেস আক্রমণ এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণ।বিরাটের দলের পেস আক্রমণ এ যাবৎকালের ভারতীয় দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সেরা পেস আক্রমণ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ যে ভারতীয় পেস ত্রয়ীদের কাজ অনেকটা সহজ করে তুলেছিল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তা সত্ত্বেও রবি শাস্ত্রীর মতো এত প্রখর ক্রিকেটবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এই কথা কী ভাবে বললেন? উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারবেন।

আমাদের কাজ একটাই। কোনও রকম তুলনা না টেনে, আসুন বিরাট বাহিনীর অস্ট্রেলিয়া জয়ের আনন্দ উপভোগ করি। এ ইতিহাসে যে সহজে ভোলার নয়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ARPIT BASU ARPIT BASU @virusfound007

Arpit Basu is the Special Correspondent with the India Today Group’s fact check team. With more than one-and-a-half decade's experience in print and digital media, he has reported on aviation, transport, crime, civic and human interests issues. His sting operation on how precious Aviation Turbine Fuel, meant for Kolkata airport, was pilfered and sold in local market as ‘white kerosene’ received widespread acclaim. Arpit has worked with reputed media houses like The Times of India and Hindustan Times and had received letter of appreciation for reporting during the Phalin cyclone in Odisha in 2013.

Comment