স্কুলস্তরে কেমন করে তুলে আনা হয় সুপ্ত প্রতিভা
গরিব ছেলেরা বাড়িতে যে জীবনের লড়াইটা শেখে, সেই লড়াইেটাই মাঠে লড়তে শেখাই
- Total Shares
“কোণার্কের মন্দির, তার অপূর্ব কারুকার্য, সে যেন জীবন্ত মর্মর মূর্তি – এই নিপুণ শিল্পকর্মের কারিগর কারা? ইতিহাস কি তার সাক্ষ্য রেখেছে?” – শংকর
বিগত দুই দশক ধরে কি এমন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় কোনও পরিকাঠামোহীন একটি বিদ্যালয় থেকে উঠে আসে কলকাতা মাঠ ফুটবলের মারাদোনা, মেসিরা। দেশের জন্য জন্য ক্রিকেট-দল বাছাই হয়, তখন রঞ্জি বা আইপিএলের দিকে নজর রাখেন নির্বাচকরা। সুপার লিগের জন্য বাছাই হবে ফার্স্ট ডিভিশন থেকে, ফার্স্ট ডিভিশনের জন্য বাছাই হবে সেকেন্ড ডিভিশন থেকে, এটাই দস্তুর। প্রশ্ন হল একেবারে ছোটদের মধ্য থেকে কী ভাবে আমরা প্রতিভা খুঁজে বার করি।
চলছে প্রশিক্ষণ (ছবি: লেখক)
দীর্ঘ তিন দশক ঘরে মাঠের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। ক্রিকেট খেলেছি, ইউনিভার্সিটি ব্লু বলতে যা বোঝায় আমি তাই-ই – কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় প্রশিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছি। গত বছর অনূর্ধ্ব ১৭ (স্কুল) ক্রিকেট দলের বাংলার কোচ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। প্রতিভা খুঁজতে খুঁজতে আমাদের চোখ এখন জহুরির চোখ হয়ে গিয়েছে। ছেলেরা যখন পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিভার খোঁজ।
এটা ঘটনা যে আমাদের বিদ্যালয়ের নিজের মাঠ পর্যন্ত নেই এমনকি প্রাথমিক স্তরে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তারও অভাব রয়েছে। তাই সেই অর্থে কোনও স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট আমরা নিতে পারি না। তবে তাতে হতাশ হওয়ার কোনও জায়গা নেই। আমরা প্রথমে কয়েকটি অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে ছেলেদের পরীক্ষা করে নিই। তাদের দৌড়, শরীরের গঠন, উদ্যম, একাগ্রতা, লড়াইয়ের মানসিকতা – প্রভৃতি নানা ব্যাপারে ইঙ্গিত আমরা তখনই পেয়ে যাই। প্রাথমিক এই বাছাইপর্বের পর চলে পরের ধাপের প্রস্তুতি।
আমরা ছেলেদের থেকে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি। যদি সম্ভাবনাময় ছাত্ররা আগে থেকে কোনও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে থাকে তখন আমরা স্থানীয় কোনও ক্লাবের মাঠে আমরা তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কর থাকি।
এমন নয় যে তাদের ফুটবলার বা ক্রিকেটারই হতে হবে। তাদের সুনির্দিষ্ট প্রবণতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্রীড়া অভিমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। এখানে কয়েকটি ক্লাব আছে যারা বিশেষ বিশেষ কয়েকটি খেলায় অগ্রণী যেমন ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, খো খো প্রভৃতি।
কী ভাবে একটি এলাকার বিদ্যালয় ও স্থানীয় ক্লাবগুলি পারস্পরিক সহাবস্থান এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে খেলাধূলার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, এই ব্যবস্থাপনা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। স্কুল ও ক্লাবের মধ্যে এই সমন্বয়ের কাজটি আমি খুব যত্ন করেই করে থাকি।
প্রশিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্ররা (ছবি: লেখক)
আমাদের স্কুলের সামর্থ্য খুবই সীমিত। আর এই জায়গাতেই এগিয়ে আসে ক্লাবগুলি। প্রত্যেক ক্লাবেরই খেলাধূলার কিছু না কিছু পরিকাঠামো থাকে। তবে এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য চাঁপদানি বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব এবং তার প্রশিক্ষক অরূপ ভট্টাচার্য। মাটির তাল থেকে প্রতিমা তৈরির মতো করেই তিনি গড়ে তোলেন ছেলেদের।
কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম চেনা মুখ হীরা মণ্ডল তো প্রায়ই বলে, “দুষ্টুদা (অরূপ ভট্টাচার্য) সারা জীবন অলক্ষ্যে থেকে নিজের কাজ করে গেলেন আর নাম করলাম আমরা। ওঁর কি কোনও স্বীকৃতিই প্রাপ্য ছিল না?”
অরূপের অবশ্য কোনও অভিযোগ অনুযোগ বা আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। সে প্রায়ই বলে যে নামের পিছনে সে কোনও দিনই ছোটেনি, তার কাজ ফুটবলার তৈরি করা, সে সেই কাজটিই করে গিয়েছে।
কাজ শুধু মাঠের ভিতরেই রয়েছে তা নয়, মাঠের বাইরেও কাজ রয়েছে। কারণ খুবই দুর্বল আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে আমাদের এখানে ছেলেরা স্কুলে ভর্তি হয়। স্কুলে তারা ভর্তি হয় লেখাপড়া শেখার জন্য। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা করা তাদের মা-বাবার কাছে বিলাসিতা মাত্র। ওঁরা চান ছেলে কোনও একটা কাজে যোগ দিক, পরিবারে দু-পয়সা দিয়ে সাহায্য করুক।
তাই সম্ভাবনাময় ছেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের বোঝাতে হয় যে এই পথে এগোলে তাঁদের ছেলে কোন জায়গায় যেতে পারে, কী সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর্থিক সম্ভাবনার দিকটাও তুলে ধরি। তাঁরা চুপ করেই শোনেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য তারপরে আর কোনও বাধা দেন না। কেউ কেউ আবার খুব উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
আমি আর অরূপ মিলে সম্ভাবনাময় ছাত্রদের সামনে ভবিষ্যতের রোডম্যাপ তুলে ধরি। স্পষ্ট করে দিই উন্নতির প্রতিটি ধাপ। প্রথমে ইন্টারক্লাস ফুটবল, তারপরে মহকুমা স্তরে স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা, তারপরে জেলাস্তরে লিগ। এখানে যারা ভালো ফল করে তাদের জন্য খুলে যায় কলকাতা ফুটবল লিগের লোয়ার ডিভিশনের দরজা। যাদের প্রতিভা সবচেয়ে বেশি তারা পায় প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ।
ওদের সামনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরলে ওরা অনেক বেশি ফোকাসড হয়। উৎসাহ-উদ্যমের কোনও খামতি থাকে না। ক্রীড়াবিদ হওয়ার এটাই মূলমন্ত্র। এর পরে দরকার হয় ধাপে ধাপে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।
কোনও অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এই ধরনের শহরতলিতে থাকে না, তবে সময়-পরীক্ষিত যে প্রশিক্ষণ আমরা দিয়ে থাকি তাতেই কাজ হয়। ফুটবলারের সর্বাঙ্গীন বিকাশের কথা মাথায় রেখেই এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের শরীরচর্চা, খাওয়াদাওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে নজর দেওয়া হয়। চোট-আঘাত যাতে না লাগে সে দিতেও আমাদের নজর থাকে।
প্রশিক্ষণ চলছে (ছবি: লেখক)
বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয় সার্কিট ট্রেনিং, পারফর্ম্যান্স রিলেটেড ফিজিক্যাল ফিটনেস, সুনির্দিষ্ট দক্ষতা বিকাশের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এমন বিশেষ কয়েকটি প্রশিক্ষণ যার ফলে খেলোয়াড়ের গতি, শক্তি, সহ্যক্ষমতা ও সক্ষমতা যথাযথ ভাবে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি সাইকোলজিক্যাল বা মানসিক প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় যাতে কোনও অবস্থাতেই কোনও খেলোয়াড়ের মানসিক অবসাদ না আসে এবং হার না মানা মনোভাব বিকশিত হয়। ছেলেদের মধ্যে সেই কিলার ইন্সটিঙ্কট থাকা দরকার। এটাই তো জেতা-হারার ফারাক গড়ে দেয়!
এর পরের ধাপ ম্যাচ প্র্যাক্টিস। আমাদের লক্ষ্য থাকে ছেলেদের যত বেশি সম্ভব ম্যাচ প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। আমরা প্রায় প্রতিটা টুর্নামেন্টে যোগ দিই তা সে আন্তঃবিদ্যালয় স্তর হোক বা মহকুমা স্তর বা জেলা স্তর।
আরও একটা ব্যাপারে আমরা ভীষণ ভাবে সচেতন। বয়স অনুযায়ী যার যে স্তরে খেলা দরকার তাকে সেই স্তরেই খেলাই।
আমাদের এখানে যারা আসে তারা সকলেই প্রায় গরিব ঘর থেকে বা অতি সাধারণ পরিবার থেকে। তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে লড়াইয়ের যে কৌশল রপ্ত করেছে আমাদের লক্ষ্য থাকে সেই কৌশল যাতে খেলার মাঠেও প্রতিফলিত হয়। আমরা চাই তারা যাতে তাদের হার-না-মানা অনমনীয় মনোভাবটাই খেলার মাঠেও নিয়ে আসে।
অরূপও বলেছে যে আমরা প্রতিনিয়ত একটা সাপোর্ট সিস্টেমের মতো কাজ করে যাই। অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা হীরা মণ্ডল এখন কলকাতা মাঠের হীরা, সে পিয়ারলেসের মধ্যমণি। আমাদের এখানের জগন্নাথ সানা বাংলা দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০১৬ সালের সন্তোষ ট্রফিতে। সে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও আই-লিগে খেলেছে। শুভঙ্কর সানা, অতনু মণ্ডল, শুভজিৎ বর্মণ, নিরঞ্জন মণ্ডল, অরিজিৎ দাস – এরা সকেলেই কলকাতা ফুটবলে বেশ নামী।