পৃথ্বী সাউকে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটে এত উন্মাদনা কেন?
সর্বকণিষ্ঠতম ভারতীয় হিসেবে অভিষেক টেস্টে শতরান করেছেন তিনি
- Total Shares
ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ চলাকালীন অনভিজ্ঞ ইংরেজ বোলারদের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল বহু চর্চিত ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয়দের হতদরিদ্র পারফর্মেন্সের পর একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল - টপ অর্ডারে পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
গত এক বছরে ভারতকে ওপেনিং জুটি নিয়ে বেশ কিছু রদবদল করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে একটিও উপমহাদেশের বাইরে সাফল্য পায়নি। কিন্তু নতুন মুখের খোঁজ করতে নেমে টিম ম্যানেজমেন্টকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।
পৃথ্বী সাউ ও হনুমা বিহারির মতো তরুণ প্রতিভারা ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত রানের মধ্যে থাকায় সহজেই নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান। ইংল্যান্ডের মাটিতে ১৩৬ বলে ৫৬ রানের ইনিংসে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল বিহারিকে। উল্টোদিকে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনভিজ্ঞ বোলারদের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টেই একটি অনবদ্য অথচ সহজ সরল ইনিংস খেলে ফেললেন সাউ।
১৫৪ বলে ১৩৪ রানের ইনিংসটি খেলার সময় কখনই চাপে আছে বলে মনে হয়নি পৃথ্বীকে। বরঞ্চ, দেখে মনে হল চ্যালেঞ্জ নিতে সদা প্রস্তুত ভারতীয় ক্রিকেটের এই তরুণ প্রতিভা। ঘরোয়া ক্রিকেটের রানে থাকার জন্য বা রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে অনুর্ধ-১৯ পর্যায় ও ইন্ডিয়া-এ দলের হয়ে সময় কাটানোর জন্যে কিংবা ২০১৮ সালের আইপিএলের খেলার সুবাদে, যতক্ষণ তিনি ক্রিজে ছিলেন ততক্ষন পৃথ্বীর আত্মবিশ্বাস কিন্তু তুঙ্গে ছিল। তাঁর ১৩৪ রানের ইনিংস থেকে একটা কথাই পরিষ্কার - আন্তর্জাতিকস্তরে তিনি কিন্তু লম্বা রেসের ঘোড়া।
বড় মঞ্চে খেলার মানসিকতা রয়েছে মহারাষ্ট্রের কিশোরের [সৌজন্যে: টুইটার]
এই বয়সে ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেক কিন্তু সহজ নয়। সুযোগ পেলে, স্বাভাবিক নিয়মে সেই ক্রিকেটার পাদপ্রদ্বীপের আলোয় চলে আসেন। এর ফলে চাপে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু প্রবল। কিন্তু পৃথ্বীর ক্ষেত্রে চাপের কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। উল্টোদিকে স্ট্রাইক রেট প্রায় একশোর কাছাকাছি রেখে শতরান করে ফেললেন তিনি। ভারতের হয়ে সর্বকণিষ্ঠতম হিসেবে অভিষেক ম্যাচে শতরানের নজির এখন তাঁরই দখলে।
এছাড়া, আরও একটি নজির পকেটে পুড়ে ফেলেছেন এই কিশোর ক্রিকেটারটি। টেস্ট অভিষেকে দ্রুত শতরানকারীদের মধ্যে পৃথ্বীর স্থান তৃতীয়। এই তালিকায় এই মুহর্তে প্রথম নামটি শিখর ধাওয়ানের। ২০১৩ সালে অভিষেক টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মোহালিতে মাত্র ৮৫ রানে শতরান করেছিলেন শিখর। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেন স্মিথ। ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কেপটাউনে ৯৩ বলে অভিষেক টেস্টেই শতরান করেছিলেন তিনি।
এই শতরানের পর সাউ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র শেহবাগ, মহম্মদ আজহারউদ্দিন ও লালা অমরনাথের মতো প্রবাদপ্রতিমদের সঙ্গে নিজের নামটা লিখিয়ে ফেললেন - এরা প্রত্যেকেই নিজেদের প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন।
ওপেনার হিসেবে পৃথ্বীর ভয়ডরহীন ব্যাটিং বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করতে বাধ্য। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও নিজেকে প্রমান করেছেন পৃথ্বী। ২০১৩ সালে হ্যারিস শিল্ডের ম্যাচে স্প্রিংফিল্ড স্কুলের হয়ে ৩৩০ বলে ৫৪৬ রানের ইনিংসটি খেলে সকলের নজর কাড়েন পৃথ্বী। সেই ইনিংসে ৮৫টি চার ও ৫টি ছয় মেরেছিলেন তিনি।
একজন টিনেজারের কাছে ভারতের হয়ে টেস্ট অভিষেক সহজ নয় [সৌজন্যে: টুইটার]
তিন বছরের মধ্যে অনুর্ধ-১৯ ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে ছিলেন তিনি। সেই দলটি শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মাস দুয়েকের মধ্যে মুম্বাইয়ের হয়ে রঞ্জি অভিষেক হয় পৃথ্বীর। তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ম্যাচে রঞ্জি অভিষেকেই দ্বিতীয় ইনিংসে শতরান করে দলকে জেতান তিনি। পরের বছর, ২০১৭ সালে, দিলীপ ট্রফির অভিষেক ম্যাচে ফের শতরান করেন পৃথ্বী। সচিন তেন্ডুলকরেরও এই কৃতিত্ব ছিল।
এর পর দেশের অনুর্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক হতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি পৃথ্বীকে। ২০১৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়াকে পরাজিত করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় অনুর্ধ-১৯ ভারতীয় দল।
অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে এই শতরান নিঃসন্দেহে পৃথ্বীর মনোবল অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে। অস্ট্রেলিয়া সফর যে অনেক বেশি কঠিন হবে সে বিষয় কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় রানের ইনিংস কিন্তু আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবেই।
মহারাষ্ট্রের এই তরুণ ক্রিকেটার যে বড় মঞ্চের খেলোয়াড় তার প্রমান ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। এখন দেখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারেন তিনি। ক্রিকেট আইকন হয়ে উঠতে এখনও অনেকটা পথ পেরোতে হবে তাঁকে। নিজেকে ফিট রাখতে পারলে তিনি সফল হবে বলে আশা করাই যায়। ততদিন অবধি ও যাতে খেলাটা উপভোগ করতে পারে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।
খুব দ্রুত ক্রিকেট বিশ্ব পৃথ্বীর ব্যাটিংয়ের দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাটাছেড়া শুরু করে দেবে। পৃথ্বীকেও সেদিকে নজর রাখতে হবে। দিন যত এগোবে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাও আসবে, বোলাররা তাঁকে চাপে রাখতে চেষ্টা করবেন। এসব কিছুই তো ক্রিকেটের অঙ্গ। চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটাররা কিন্তু এই ধরণের প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়েই চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হন।
পৃথ্বীর কপাল ভালো। বিরাট কোহলির মতো নেতার অধীনে শুরুর দিনগুলো খেলবেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটারদের জন্য কোহলি তো আদর্শ রোল মডেল।