ব্যাঙ্গালোরের বাঙালিরা ফেরার কথা ভাবেন না, কলকাতা শুধুই নস্ট্যালজিয়া
বাঙালির খাদ্য রসিকতা যাতে ভরপুর বজায় থাকে, সে ব্যবস্থা রয়েছে ব্যাঙ্গালোরে
- Total Shares
চাকরির তাগিদে বহু মানুষকে আজ বাংলা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন শহরে চলে যেতে হচ্ছে। সেই সব শহরের তালিকায় ব্যাঙ্গালোরের নাম হয়তো রয়েছে সবার উপরে। এই শহরের প্রতি বাঙালির ভালোবাসা একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা নয়; প্রায় দেড় দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে এই ব্রেন ড্রেন চলে আসছে। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে, তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উত্থানের ফলে যে শহরগুলি উপকৃত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ব্যাঙ্গালোর অন্যতম।
ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠান
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের গার্ডেন সিটিতে এই মুহূর্তে, প্রায় পাঁচ লক্ষের উপর বাঙালি বাস করে। কলকাতার বাইরে এত বাঙালি, একসঙ্গে একটা শহরে... হয়তো শুধু দিল্লি আর বারাণসীতেই পাওয়া যাবে। একটাই তফাত, দিল্লি ও বারাণসীতে যে বাঙালিরা থাকেন, তাঁরা হয়তো তিন-চার পুরুষ ধরে ওখানেই বাস করছেন, সেই তুলনায় ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি কমিউনিটির ইতিহাস খুব একটা বেশি পুরোনো নয়। অনেক বাঙালি, যাঁরা এক দশক আগে পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা ছেড়ে এই শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ এখন ঘর-বাড়ি করে পাকাপাকি ভাবে ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। নিজের জন্মস্থানে ফেরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা অবকাশ কোনওটাই নেই, বরং উল্টোটা সত্যি। কারণ অনেকের কাছে ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে কলকাতায় ফেরা মানে একটা ভুল 'ক্যারিয়ার মুভ' ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্যাঙ্গালোরে এই মুহূর্তে বাঙালিদের দাপট ঠিক কতটা, সেটা এই শহরের রাস্তায় বেরোলে বোঝা যায় — শুধু একটু চোখ আর কান খোলা রাখলেই হবে। রেস্তোরাঁয় হোক বা শপিং মলে, মাসকাবারির দোকন বা সিনেমা হলে, রাস্তা-ঘাট বা অলি-গলি, সবেতেই অন্তত জনা দশেক বাঙালির দেখা পাওয়া যাবে না, সেটা একটা অসম্ভ ব্যাপার।
বাঙালির খাওয়া দাওয়া থেকে পুজোপাঠ – সবই হয় এখন ব্যাঙ্গালোরে, ঠিক কলকাতার মতো নিয়ম মেনেই। এই শহরে এখন প্রচুর ছোট ছোট বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে উঠেছে। এই অ্যাসোসিয়েশনগুলোর প্রাথমিক কাজ হল, সকল প্রবাসী বাঙালিকে একসঙ্গে করে নানা ধরণের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্ততি করা এবং সর্বোপরি দুর্গাপুজোর আয়োজন করা। ব্যাঙ্গালোরে বর্তমানে দুর্গা পুজোর সংখ্যা একশো ছড়িয়ে গেছে। সব কটা পুজোই, সপ্তমী থেকে দশমী – নিয়ম ও নিষ্ঠা মেনেই হয়। এই সব প্যান্ডেলগুলোতে আরও ঘরোয়া টাচ দিতে কলকাতা থেকে নানাবিধ শিল্পী ও কলাকুশলীদের আমন্ত্রণ করা হয়।
কর্নাটকের এই ব্যস্ত শহরে বাঙালির খাদ্য রসিকতা যাতে ভরপুর বজায় থাকে, সে ব্যবস্থা রয়েছে ভীষণমাত্রায়। কলকাতার রোল আর চাট এখন পৃথিবী বিখ্যাত। ভারতের অনেক জায়গার মতো ওই জিনিষ এখন বাঙ্গালোরেও সহজেই পাওয়া যায়।
ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি খাবরের দোকান
শুধু তাই নয়, বাঙালির পাতে যাতে মাছের ঠিকঠাক পিস পড়ে, তার জন্য মাছের বাজারে 'বেঙ্গল কাট' এখন খুব পপুলার। ব্যাঙ্গালোরের জ্যোতি নগরের, এইচএএল মার্কেট, মাছের জন্য বেশি বিখ্যাত। এই বাজারে প্রত্যেক রবিবার যে ভিড় হয়, সেটা কলকাতার কোনও মাছের দোকানের চেয়ে কম নয়। রুই, কাতলা, মাগুর, সোল, পাবদা, এমনকি কই মাছও মেলে এই বাজারে। এ ছাড়া, রান্নার মশলাপাতিরও আলাদা বিভাগ রয়েছে — বড়ি, পাঁচফোড়ন, রাঁধুনি, বিশেষ ব্র্যান্ডের ঘি প্রভৃতি সবই পাওয়া যায় অনায়াসে। একঘেঁয়েমি কাটাতে, স্বাদ বদলের জন্য, ঢুঁ মারা যায় ব্যাঙ্গালোরের নানা বাঙালি রেস্তোরাঁগুলিতে! ওহ্ ক্যালকাটা, ভজহরি মান্না, এসপ্ল্যানেড, পাঁচ ফোড়ন, হাওড়া ব্রিজ আর চাকুম চুকুম কলকাতা অন আ রোল হলো কিছু নাম করা বাঙালি খাবারের রেস্তোরাঁ, এদের মধ্যে প্রথম দুটোর ভারতে বিভিন্ন শহরে শাখা রয়েছে।
এই সবের মাঝে, বাঙালি কি আদেও কলকাতাকে মিস করে? ব্যাঙ্গালোরের গতিময় জীবনে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে নিজের বেড়ে ওঠার সেই শহরকে যে একটু মনে করবে বাঙালি, সেই সময় টুকুও নেই। কলকাতা এখন শুধুই নস্টালজিয়া।
সোম থেকে শুক্র আপিসের হাল টানার পর, উইকেন্ড বিলাসিতা বলতে হয় একটানা লম্বা ঘুম বা ছোট করে বন্ধুদের সঙ্গে একটা গেট টুগেদার। সেই আসরে বসে, বিয়ার গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে মন যদি ম্লান হয়ে যায়, কলকাতার কথা যদি মনেও পড়ে, আবার একটা সোমবার বাস্তবের আয়না নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। আবার শুরু সেই রেস।