বাঙালি নয়, ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে বাংলাদেশকে এশিয়া সেরা দেখতে চাই আমি
ক্রিকেটবিশ্ব এখন নতুন মুখের খুঁজছে, নতুন মুখের অভাব মেটাতে পারে বাংলাদেশ
- Total Shares
ক্রিকেট বিশ্বে দু'টি শব্দের প্রচলন আছে - আন্ডারডগ ও ডার্কহর্স।
প্রতিদ্বন্দ্বী দু'টি দলের মধ্যে যদি শক্তি ও অভিজ্ঞতার ফারাক থাকে তা হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলটিকে আন্ডারডগ বলা হয়। যদিও এই তকমা এখন স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। হাড্ডাহাড্ডি বা মরণ-বাঁচন ম্যাচের আগে নিজেদের আন্ডারডগ বলে প্রতিপন্ন করতে পারলে মানসিক সুবিধা পাওয়া যায়। আমি দুর্বল, অত এব আমার হারানোর কিছুই নেই, জিততে পারলে তা হবে বাড়তি পাওনা - এই মানসিকতা নিয়ে খোলা মনে খেলা যাবে। চাপটা উল্টোদিকের 'ফেভারিট' দলের উপরে থাকবে। তাদের শক্তি বেশি। অর্থাৎ, জেতার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং, তাদের উপর প্রত্যাশাতার চাপটাও বেশি।
সহজ সরল অঙ্ক। আর, এই সহজ সরল অঙ্ক কষতে বসলে মাঝে মাঝে হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে ম্যাচ শুরুর আগে যুযুধান দুই দলের সদস্যরাই নিজেদের আন্ডারডগ বলে দাবি করছেন। এর মাধ্যমে বোধহয় সমর্থকদের একটি বার্তাই দিতে চান তারা - আমাদের জেতার সম্ভাবনা কম, চেষ্টা করব, হারলে পরে দয়া করে খামোকা আমাদের দোষ দিতে যাবেন না।
এবার আসি ডার্কহর্স প্রসঙ্গে। ডার্কহর্স মানে সহজ সরল বাংলায় কালোঘোড়া। অর্থাৎ, সেরা বাজি। কোনও দল হয়ত অভিজ্ঞতা বা শক্তির দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। তাই সেই দল কোনও মতেই ফেভারিট নয়। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যে ছন্দে রয়েছে তাতে অঘটন ঘটিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর, সেই দলটাকেই টুর্নামেন্টের কালো ঘোড়া বলা হয়ে থাকে।
৯৬ বিশ্বকাপে ক্রিকেট বিশ্বে সূর্যোদয় হয়েছিল অর্জুন রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কার [ছবি: এপি]
১৯৮৩ বিশ্বকাপের ভারতকে কেউ সেই টুর্নামেন্টের কালোঘোড়া বলে উল্লেখ করেছিল কি না তা আমার জানা নেই। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে কপিল ডেভিলস নিঃসন্দেহে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে আন্ডারডগ হিসেবে শুরু করেছিল। দিনের শেষে অবশ্য আন্ডারডগরাই প্রথম দু'বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে তৃতীয় বিশ্বকাপ ফাইনালে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল।
পরবর্তীকালে, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের অর্জুন রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কাকে সেই টুর্নামেন্টের 'কালো ঘোড়া' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইয়ান চ্যাপেল থেকে শুরু করে অনেক বিশেষজ্ঞই অরবিন্দ ডি সিলভা, সনৎ জয়সূর্য, রমেশ কালুভিথারনা সমৃদ্ধ শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপের সেরা বাজি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আসলে টুর্নামেন্ট শুরু আগে দুরন্ত ছন্দে ছিল রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। প্রথম ১৫ ওভারে মাত্র দু'জন ফিল্ডারের ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে থাকার সুবিধা নিতে এই দলটি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল।
বিশ্বকাপেও দেখা গেল এর প্রতিফলন। শুরুতে দু'জন পিঞ্চ হিটার নামানোর স্ট্রাটেজিকে সফল প্রমাণ করে একের পর এক বাধা টপকে শ্রীলঙ্কা পৌছে গেল বিশ্বকাপ ফাইনালে। লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হল অস্ট্রেলিয়ার। গোটা টুর্নামেন্টে অনবদ্য খেললে বিশ্বকাপ ফাইনালে কিন্তু বিশেষজ্ঞরা অস্ট্রেলিয়াকেই এগিয়ে রেখেছিল। অর্থাৎ, ম্যাচের আন্ডারডগ ছিল শ্রীলঙ্কা। কী আশ্চর্য! ফাইনাল জিতে নিয়ে উপমহাদেশের তৃতীয় দেশ (১৯৮৩ সালে ভারতের পর ১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল) হিসেবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হল আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কা।
ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের কাছে এই বিশ্বকাপ জয় নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এই জয় ক্রিকেট বিশ্বের কাছে ঢের বেশি গুরুত্বের ছিল।
কিন্তু কেন? এবার এই প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক।
ক্রিকেট নিন্দুকেরা বলে থাকেন হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি দেশ ক্রিকেট খেলে। নামেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ, কিন্তু যে ক'টি দেশ খেলে তাতে নাকি প্রকৃত অর্থে ক্রিকেট বিশ্বকাপকে ঠিক 'বিশ্বকাপ' বলা চলে না।
আশির দশকে অবশ্য ভারত একদিনের ক্রিকেট বেশ কয়েকটি সাফল্য পায়
সত্তরের দশকে একদিনের ক্রিকেট চালু হওয়ার পর ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করত ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। আশির দশকে অবশ্য ভারত ও পাকিস্তান একদিনের ক্রিকেটে বেশ কয়েকটি সাফল্য পায়। ১৯৯২ সাল অবধি যে পাঁচটি বিশ্বকাপ হয়েছে তাতে চারটি দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে - ওয়েস্ট ইন্ডিজ (দু'বার), ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তান। ইংল্যান্ড অবশ্য এই পাচঁটির মধ্যে তিনটি বিশ্বকাপে রানার্স হয়েছে।
কিন্তু এই পরিসংখ্যান থেকেও যে পরিসংখ্যানটি বেশি উল্লেখযোগ্য তা হল এই পাঁচটি বিশ্বকাপে এই পাঁচটি দলের বাইরে আর কোনও দল বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেনি। তার মানে জিম্বাবোয়ে, কেনিয়া (যদিও ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ে ও ২০০৩ বিশ্বকাপে কেনিয়া বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলেছিল) বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মতো বাকি দলগুলো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করত শুধুমাত্র 'নাম ক্যা ওয়াস্তে'। ১৯৯০-এর শুরুতে নির্বাসন কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যাবর্তনে অবশ্য আরও একটি শক্তিশালী দল পেয়ে ছিল ক্রিকেট বিশ্ব।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া ক্রিকেট বিশ্বের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই মুহর্তে ক্রিকেট বিশ্বের নতুন মুখের প্রয়োজন রয়েছে। আর, এই নতুন মুখের সন্ধানে নেমে মাত্র দু'টি দলকেই এখন পাখির চোখ হিসেবে দেখা যাচ্ছে -বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান।
বাংলাদেশ কি পারবে এশিয়ার সেরা হতে? [ছবি: এএফপি]
ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেকে সুবিধা করতে পারেনি আফগানরা। কিন্তু টি-২০ ও একদিনের ক্রিকেটে ভালোই খেলছেন রশিদ খানরা। এই এশিয়া কাপেও শুরুটা ভালো করেছিল। কিন্তু সুপার ফোর পর্যায়ে দু'টি ম্যাচ হেরে আপাতত টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে আফগানিস্তান। এর মধ্যে অবশ্য বাংলদেশের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে শেষ ওভারে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে তাদের।
উল্টোদিকে, বাংলদেশ টেস্ট ক্রিকেটে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারিয়েছে। তবে একদিনের ও টি-২০ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অনেক বেশি সফল। সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একদিনের ও টি-২০ সিরিজে হারিয়ে এসেছে। একদিনের খেলায় বিশ্বের প্রতিটি দেশকে হারিয়েছে। শেষ (২০১৫) বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালেও খেলেছে। কিন্তু যেটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা এখনও করে উঠতে পারেননি শাকিব আল হাসানরা - একটি গুরত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট জেতা।
আসছে বছর বিশ্বকাপ। তার আগে এশিয়ার সেরা হওয়ার লড়াই এখন দুবাইতে চলছে। টুর্নামেন্ট প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভারত ইতিমধ্যেই ফাইনালে উঠেছে। বুধবার বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ কার্যত সেমিফাইনাল। যে জিতবে সেই ফাইনাল খেলবে।
ক্রিকেট বিশ্বে এখন নতুন মুখের প্রয়োজন, তাই বাঙালি নয়, একজন ক্রিকেট সমর্থক হিসেবে আমি চাই বাংলদেশ এশিয়া কাপ জিতুক।
আর, হ্যাঁ! ভারত পাকিস্তানের সামনে বাংলাদেশ এখনও আন্ডারডগ। তবে, শুরুর দিন থেকেই সাকিবরা এই এশিয়া কাপের কালোঘোড়া।