প্রভু হনুমান কি দলিত ছিলেন? লোককথা ও তথ্য কী বলে?
পৈতা ও অস্ত্রসজ্জিত বানরের অর্থ নিরুপণ সহজ নয়, তবে যোগী মহাকাব্যিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন
- Total Shares
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দাবি করেছেন যে প্রভু হনুমান ছিলেন দলিত। রাজস্থানে একটি নির্বাচনী সভায় ২৭ নভেম্বর এই বিজেপি নেতা বলেন, “হনুমান ছিলেন বনবাসী, বঞ্চিত এবং দলিত।”
যখন এই মন্তব্য করা নিয়ে যোগী আদিত্যনাথকে আইনি নোটিস পাঠানো হল তখন তিনি বললেন এ নিয়ে একটি বিতর্ক হোক। রাহুল গান্ধীর গোত্র নিয়ে প্রশ্ন করার পরে পরে, তাকে সরিয়ে এবার ধাপে ধাপে ঈশ্বরের জাত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সারবত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কি একবার শাস্ত্রজ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়া দরকার? (ছবি: পিটিআই/ফাইল)
মুখ্যমন্ত্রী যে দাবি করেছেন তার সবচেয়ে ভালো জবাব হল, হনুমান হলেন স্বর্গীয়, তাই মানুষের মধ্যে যে জাতপাতের বিচার আছে তা তাঁর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা চলে না।
তবে ব্যাপারটা এতটা সরলও নয় – হনুমানের জন্মনিয়েও নানা ধরনের তত্ত্বকথা প্রচলিত রয়েছে। তিনি অবশ্যই বানরদের গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন যারা বনে বাস করত, যোগী আদিত্যনাথ সে কথা বলেছেন।
অবশ্যই তাঁর বক্তব্যের এই অংশটুকু একেবারেই ঠিকঠাক।
হনুমানকে কোনও মনেতই বঞ্চিত বলা চলে না – তাঁর বাবা কেশরী ছিলেন অত্যন্ত সাহসী বানর এবং তাঁদের সর্দার। তাই তাঁর জাত নিয়ে অনেক লম্বা বিতর্ক চলতে পারে।
তিনটি উপায়ে কারও জাত নিরুপণ করা যেতে পারে – জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং আচরণ।
যেমন কর্ণ ছিলেন জন্মসূত্রে রাজপুত, তবে তিনি সূতের (মানে সারথির) ঘরে বড় হয়েছেন এবং সূতপুত্র বলে পরিচিত ছিলেন। রাবণ ছিলেন ব্রাহ্মণের সন্তান এবং অতি পণ্ডিত, তবে আচরণের জন্য তাঁকে অসুর বলে বিবেচনা করা হয়।
এই হিসাবে হনুমানের জাত নির্ধারণ করা খুবই কঠিন কাজ।
পৌরাণিক কাহিনিতে যাঁদের কিংবদন্তী হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাঁদের নিয়ে নানা অস্পষ্টতা রয়েছে। হনুমানকে নিয়ে সবচেয়ে সহজলভ্য যে লেখাটি আছে, সেটিকে দিয়েই শুরু করা যাক – হনুমান চালিশা।
হনুমান চালিশায় এক জায়গায় বলা হয়েছে:
হাথ বজ্র ও ধ্বজা বিরাজে, কান্ধে মুঞ্জ জানিউ সাজে
(তোমার হাতে ধ্বজ ও বজ্র রয়েছে, কাঁধে রয়েছে পবিত্র উপবীত)
আরেক জায়গায় বলা হয়েছে:
শঙ্কর শুভান কেশরী নন্দন তেজ প্রতাপ মহা জঙ্গবন্দন
(শিবের অবতার এবং কেশরীর সন্তান, তোমার সাহস ও ঐশ্বরিক শক্তিকে সারা বিশ্ব পুজো করে)
আরও এক জায়গায় বলা হয়েছে:
রাম-দূয়াত অতুলিত বাল-ধামা অঞ্জনি-পুত্র পবন-সূত নন্দন
(তুমি রামের দূত, অসীম শক্তির অধিকারী। অঞ্জনিপুত্র বা অঞ্জনির ছেলে এবং পবননন্দন বা পবনদেবের পুত্র)
অর্থাৎ হনুমানের জন্ম সম্বন্ধে আমরা যা জানলাম তা হল তিনি শিবের অবতার, কেশরীর পুত্র, অঞ্জনির পুত্র এবং বাতাসের দেবতা পবনের পুত্র।
এর মধ্যে যেটিই হোক, একটা বিষয় স্পষ্ট যে তিনি আর যাই হোন, জন্মসূত্রে অন্তত দলিত ছিলেন না।
হনুমানের মা-বাবা কে ছিলেন তা নিয়ে নানা কাহিনি রয়েছে।
তাঁর মা অঞ্জনি ছিলেন বানরী। তবে পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী তিনি ছিলেন অপ্সরা যিনি অভিশাপের ফলে বানরী রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অন্য আরেকটি কাহিনি হল, মিলনে তিনি বাধা দেওয়ায় দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। আরেকটি মত হল যে তিনি এক সন্ন্যাসীর তপস্যা ভাঙতে গিয়েছিলেন। আগেরটি হোক বা পরেরটি, দুটি গল্পেই তিনি স্বয়ং মহাদেবকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে তাঁকে পুত্র রূপে চেয়েছিলেন যাতে তিনি শাপমুক্ত হতে পারেন।
হনুমানের ছবিতে দেখা যায় যে তিনি পৈতে পরে আছেন, যা ব্রাহ্মণ্যের চিহ্ন (ছবি: ইউটিউব)
পরে কেশরীকে বিবাহ করেন অঞ্জনা। কেশরী শুধু যে বীর ছিলেন তা নয়, তিনি অত্যন্ত ধার্মিক বানর ছিলেন। তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় এক অরণ্য থেকে অন্য অরণ্যে যেতেন এবং ওই সব অরণ্যে ঋষিদের বসবাসের সুবিধা করে দিতেন। একটি গল্প অনুযায়ী, একবার ঋষিদের বাসস্থানে সম্ভাষণ নামে এক দৈত্য এসে সকলকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, তখন কেশরী তাঁকে হত্যা করেন। তখন ঋষিরা তাঁকে শক্তিশালী পুত্রের বর প্রদান করেন। আরেকটি গল্পে বলা হচ্ছে অঞ্জনা ও কেশরী দুজনে মিলে ওই দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তার পরে তাঁরা বিবাহ করেন।
বিবাহের পরে তাঁরা দু’জনেই শিবের তপস্যা করেন।
তাঁদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের শক্তিশালী ও ধার্মিক পুত্রের বর দেন।
কোনও কোনও গল্পে তাঁদের সন্তান হলেন একাদশ রুদ্র, যা শিবেরই এক অবতার। অন্য মতে তিনি বরুণ বা বায়ু যিনি শিবের বীজ অঞ্জনার কাছে বহন করে এনেছিলেন, তাই তাঁকে পবনপুত্র বলা হয়।
আরও একটি গল্প রয়েছে। অঞ্জনা তখন পুত্রের কামনায় প্রার্থনা করছেন। তখন অযোধ্যার রাজা দশরথ তাঁর উত্তরসূরী পাওয়ার আশায় পুত্রকামেষ্ঠী যজ্ঞ করছেন। শেষ পর্যন্ত হোমকুণ্ড থেকে অগ্নিদেব আবির্ভূত হলেন এবং দশরথকে আশীর্বাদী পায়েস দিলেন। দশরথ তাঁর রানিদের সেই ক্ষীর খেতে দিলেন। সুমিত্রার অংশটি একটি পাখি (তিনিও অভিশপ্ত অপ্সরা, যাঁর নাম সর্বাচলা) নিয়ে পালায়। বায়ু সেটি অঞ্জনাকে দেন এবং হনুমানের জন্ম হয়। কৌশল্যা ও কৈকেয়ী তাঁদের অংশ থেকে সুমিত্রাকে ভাগ দেন, সে জন্য সুমিত্রার দুই পুত্র হয়, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
হনুমান ছিলেন আশীর্বাদধন্য স্বর্গীয় শিশু, তিনি কুণ্ডল ও কবচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি অসীম ক্ষমতাধারী ছিলেন। তাঁর শৈশবও ছিল বৈচিত্রময়।
তাই যোগী আদিত্যনাথ যে বলেছেন হনুমান ছিলেন বঞ্চিত, সেটিও তিনি ঠিক বলেননি।
এবার জাত-বিচারের অন্য দিকগুলো (চিহ্ন) নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
পরের দিকে রচিত রামায়ণে, যখন জাতপাতের বিচার আরও গভীর হয়েছে তখন দেখা যাচ্ছে যে কুণ্ডল ও কবচের সঙ্গে উপবীত ধারণ করা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেন হনুমান।
তবে সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ হল হনুমান চালিশার সেই অংশ যেখানে তাঁর সঙ্গে রয়েছে বজ্র, ধ্বজ এবং উপবীত।
হাতে অস্ত্র থাকা হল ক্ষত্রিয় বর্ণের পরিচায়ক, উপবীত হল ব্রাহ্মণের চিহ্ন যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
রামায়ণে বলা হয়েছে যে রাবণের সঙ্গে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেছিলেন হনুমান, তাতে ধন্ধ আরও বেড়েছে। সংস্কৃত হল ঈশ্বর ও ব্রাহ্মণদের ভাষা।
রামের প্রতি হনুমানের ভক্তি কোনও জাতপাতের বাধা মানেনি (ছবি: পিটিআই)
পতাকা মানে হল তিনি অন্য কারও হয়ে নিযু্ক্ত হয়েছেন। সাধারণ ভাবে যাঁরা রাজচ্ছত্র বা রাজধ্বজ বহন করতেন তাঁরা নিচু জাতেরই হতেন। তবে হনুমান চিরকালই রামের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং তিনি প্রায়ই নিজেকে রামের দাসানুদাস বলে পরিচয় দিতেন, তাই সব সময়ই যে কারও ধ্বজাধারী হলেই তিনি নিচুজাতের হবেন, এ কথা সর্বক্ষেত্রে সত্য নাও হতে পারে।
এই ধরণের অস্পষ্ট ও ধন্ধে ফেলে দেওয়া উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে তিনি জাতপাতের গণ্ডীর ঊর্ধ্বে ছিলেন – তিনি ছিলেন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ যিনি ক্ষত্রিয়দের চেয়ে অনেক বেশি বীর ছিলেন কিন্তু তাঁর নিজেকে তিনি রামের চরণে সঁপে দিয়ে সেই প্রভুর কাজেই নিজেকে চিরনিযুক্ত করেছেন।
আদিত্যনাথের মন্তব্য কি শুধুমাত্র “হাত বজ্র ও ধ্বজা”-র উপরে ভিত্তি করেই করা? আমরা অবশ্য সে কথা জানি না:
প্রকৃতপক্ষে বানরদের দিয়ে আদিবাসীদেরই উপস্থাপনা করা হয়েছে যাঁদের আর্যরা পরাজিক করেছিলেন, এখানে রাম হলেন আর্যদের প্রতিভূ, যারা বিজয়ী হওয়ার পরে পরাজিতদের দমিত করে রাখত যা আদিত্যনাথের কথায় ফুটে উঠছে এবং তাঁর এই মন্তব্যকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ তকমা দেওয়া যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী হিন্দু-বিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন? এ কথা অবশ্য আমাদের জানা নেই।
আমরা যেটা জানি তা হল যোগী আদিত্যনাথ দলিতদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন – তবে জানেন না যে কী ভাবে তা করবেন। তাই আম্বেদকরের নতুন নামকরণ করেছেন “ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর”।
দলিতদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করা একটা দারুণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে এবং সে জন্য মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ার আগে সেই সব বাড়িগুলিতে শ্যাম্পু ও সাবান বিতরণ করা হচ্ছে।
তারপরে এল মহাকাব্য থেকে হনুমান জাত নিয়ে বলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
দলিতদের কাছে আবেদনের অন্য কোনও উপায় ভাবতে হবে যোগীকে।
হে প্রভু রাম, ওঁর সহায় হোন।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে