গোরক্ষাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন যোগী সরকার, মানবরক্ষায় তিনি কী করছেন?
যোগী আদিত্যনাথ সরকার আসার পর থেকে ধর্ষণ, খুন, গণপ্রহারে মৃত্যু নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে
- Total Shares
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যিনি আইনশৃঙ্খলার রক্ষক হিসাবে বড়াই করেন, সেই মুখ্যমন্ত্রীর জমানায় বুলন্দশহরে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় একদল মারমুখী জনতা এক ইন্সপেক্টরকে পিটিয়ে হত্যা করে ফেলল, এর ফলেই দাবি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যেকার আকাশপাতাল ফারাকটাও স্পষ্ট হয়ে গেল।
একদল বজরং দল সমর্থক যে ভাবে ইন্সপেক্টর সুবোধ কুমার সিংকে হত্যা করেছে তা হৃদয়বিদারক, যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এটাই সবচেয়ে জঘন্য ঘটনা।
এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এই রাজ্যে এখনও অনেকেই যে মূল স্রোতে নেই শুধুমাত্র সেই চিত্রই ফুটে উঠছে না, যারা এ সব কাজ করছে তাদের কোনও রকম শাস্তিও ভোগ করতে হচ্ছে না।
এমন ঘটনা ঘটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও যে রাজ্যে বজরং দলের মতো দলের প্রভাব রয়েছে সেই জায়গায় এমন ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। যতই হোক, খুব বেশি দিনের ঘটনা নয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেও এই ধরনের সশস্ত্র রাজনীতির বড় সমর্থক। একটু অবাক হয়ে যাই যখন দেখি যে ঘৃণার রাজনীতি যারা করে উত্তরপ্রদেশে তারা সদম্ভে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে রাষ্ট্র এবং তার হাতে থাকা আইনশৃঙ্খলার রক্ষার ক্ষমতাকে বিন্দুমাত্র সমীহ না করেই। দেরি করে প্রেস রিলিজ দিয়ে সরকারের বক্তব্য জানিয়েই দায় সারা হয়েছে, নিহত ইন্সপেক্টর সম্বন্ধে কোনও কিছু বলার ব্যাপারে আগ্রহ নেই –সমস্ত আগ্রহ শুধু গোহত্যা বন্ধ করার ব্যাপারে।
আগে গোরু পরে মানুষ? উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এখন সজাগ রয়েছেন গোরক্ষায় (ছবি: পিটিআই)
ইন্সপেক্টরকে হত্যা করার সঙ্গে ও গোরক্ষাকে যে ভাবে নির্লজ্জের মতো সরাসরি যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশে এখন রাজ্য পরিচালনার যা রীতি তাতে সেই হত্যাকারী উন্মত্ত জনতাকে রক্ষা করছে রাষ্ট্রই এবং তারা সেই পরিস্থিতি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার রেকর্ড চিরকালই খুব খারাপ এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর রাজত্বে তা আরও খারাপ হয়েছে।
যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধর্ষণ, খুন এবং গণপিটুনিতে হত্যা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফ্যাক্টচেকার(ডট)ইন (Factchecker.in)-এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তরপ্রদেশে গবাদিপশু সংক্রান্ত অপরাধ আগের চেয়ে ৬৯ শতাংশ বেড়ে গেছে, এই ধরনের হিংসার ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে এই রাজ্যই এখন পয়লা নম্বরে। ২০১৮ সালে রাজ্যে মোট যতজন নিহত হয়েছেন তার ৪০ শতাংশ গোরক্ষা সংক্রান্ত কারণে (১০ জনের মধ্যে ৪ জন) এবং ২৯ শতাংশ হামলার কারণও তাই (২১টির মধ্যে ৬টি)।
উত্তপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হলেন বিজেপির অন্যতম মুখ এবং নিয়মিত ভাবে বিভিন্ন রাজ্যে যাচ্ছেন দলের হয়ে প্রচার করার জন্য। যেখানেই তিনি যাচ্ছেন সেখানেই তিনি নিজের রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বড়াই করছেন এবং কেরলের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দল-শাসিত রাজ্যগুলিকে বলছেন যাতে তারা তাঁর দেখানো পথে চলেন। তাঁর কথায় যাঁরা সায় দিচ্ছেন এবং যাঁরা তাঁর হয়ে সাফাই দিচ্ছেন তাঁদের ঠেকানোর জন্য এই রাজ্যে কতগুলি গুলির লড়াই হয়েছে এবং কতজন নিহত হয়েছেন সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরাই যথেষ্ট।
মুখ্যমন্ত্রীর বোঝা উচিত যে দেশের আর কোনও রাজ্যে এতগুলো শহরের নাম পরিবর্তন হয়নি। (ছবি: পিটিআই)
পুলিশের গুলি চালানোর শখও অনেক নিস্পাপ প্রাণ নিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে পুলিশের গুলিতে লখনউয়ে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। এই ধরনের পুলিশ ব্যবস্থা আরও একটা তথ্য গোপন করতে পারছে না, তা হল রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণের কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। আলাদা আলাদা ভাবে ১৯ ও ২৩ নভেম্বর মুজফফরনগর থেকে দুটি আলাদা ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এই ধরনের আরও একটি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ২৭ নভেম্বর, মথুরায় এক অনাবাসী ভারতীয়কে গণধর্ষণ করা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য থেকে পাঁচ বার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ। তাঁর এতদিনের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁকে মাঝারি মানের প্রশাসকও বলা চলে না। তিনি বিখ্যাত তাঁর আগুনে এবং জনতাকে খেপিয়ে তোলার মতো বক্তৃতা করার জন্য এবং বাহুবলী রাজনীতির জন্য।
তাঁর যা প্রকাশ দেখা যায় তাতে তাঁকে জ্ঞানী, বিদ্বান এবং দেশের বৃহত্তম রাজ্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত বলে মনে হয় না।
যোগীর উপলব্ধি করা উচিত যে একের পর এক শহরের নাম বদল করা ছাড়াও রাজ্য প্রশাসনের আরও অনেক কাজকর্ম রয়েছে এবং গুলিবিনিময় ছাড়াও রাজ্যের অন্য অনেক নীতি রূপায়ণ করার আছে।
উত্তরপ্রদেশের দরকার পরিকাঠামো, শিল্পের জন্য বিনিয়োগ, সকলের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা, মহিলা ও রাজ্যের অন্য বাসিন্দাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।
যেটা একেবারেই দরকার নেই, তা হল গণপ্রহারে হত্যা।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে