একবারই মাত্র প্রকাশ কারাট এসেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে, কেন?
মমতা কি বিরোধীদের মুখ হয়ে উঠতে পারবেন? কতদিন থাকবেন মোদী?
- Total Shares
বয়স নব্বই ছুঁই-ছুঁই। দশ বারের সাংসদ, লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ২০০৭ সালে তিনি সর্বসম্মত ভাবে দেশের রাষ্ট্রপতিও হতে পারতেন, কিন্তু তাঁর দল সিপিএমের তৎকালীন সম্পাদক প্রকাশ কারাটের আপত্তিতে হতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা নিয়ে তিনি বললেন অনেক কথা।
দিল্লিতে মোদী আর বাংলায় দিদি। এ নিয়ে কী বলবেন, আর নরেন্দ্র মোদী কতদিন দেশকে নেতৃত্ব দেবেন?
ভারতের নাগরিক হিসাবে বলতে পারি, এটা বেশ চিন্তার। এখন ভারত সরকারি ভাবেই ধর্মীয় নীতি গ্রহণ করছে এবং নিরলস ভাবে তাদের বিভাজনমূলক নীতি কার্যকর করার জন্য নিরলস ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাতে সফলও হচ্ছে। তারা আয়করের জুজু দেখিয়ে লোককে সন্ত্রস্ত করছে, তারা ধর্মীয় আবেগ নিয়ে খেলা করছে। গো-রক্ষকরা তো মারাত্মক! কোনও সভ্য দেশ বেশি দিন এ সব সহ্য করবে না। বিহারেও এখন তারা তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ নেতা হিসাবে সকরেলর শ্রদ্ধা অর্জন করলেও, এখন নীতীশ কুমারও তাদের নাগপাশে বন্দি হয়েছে।
বামেরা কি তাদের পথ থেকে সরে এসেছে? কী ভাবে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব?
টিঁকে থাকার জন্যই তাদের ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। নেতৃত্বে বদল আনতে হবেকারণ সিপিএম নেতাদের উপর থেকে লোকের আস্থা পুরোপুরি চলে গেছে। লোকে এমন সিপিএম নেতাই চান যিনি তাঁদের সঙ্গে সব সময়ই থাকবেন, তাঁদের লড়াইয়ে সময় পাশে থাকবেন—লড়াই মানে অন্নের জন্য লড়াই, কাজের জন্য় লড়াই। সমর্থকরা তাঁদের নেতাদের লড়াইয়ের মধ্যে দেখতে চান। বহু ঘটনা ঘটছে, কেউ কেউ সে সব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। ঠ্যাঙাড়ে (তৃণমূলের গুণ্ডা) ও পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তাঁদের থাকতে হবে। ওই সব গুন্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নেতাদের অবশ্য গুন্ডা হতে হবে না, নির্বাচনে তামাশাও করতে হবে না। তাদের নিজেদের দলের কথা ভাবতে হবে, নিদের পদর কথা নয় তাদের এমন কাজ করতে হবে যাতে জনতা তাঁদের উপরে আস্থা রাখতে পারে। নবান্ন অভিযানকে আপনারা কেন বিরাট সাফল্য বলে মনে করেন? এর কারণ হল, সাধারণ লোক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা মনে করেছিলেন, সিপিএম আছে তো, তাই তাঁরা নিরাপদ। এখন সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গাটা পুরোপুরি খালি। তারা বুঝতেই পারছে না যে কী করতে হবে।
মমতা নিজেকে বিরোধী-মুখ হিসাবে তুলে ধরছেন। তাঁকে কি সকলে মেনে নেবেন?
দুঃখের ব্যাপার হল, ২০১১ সালে উনি একার ক্ষমতায় নির্বাচন জিতেছিলেন বলে ওঁর প্রতি আমার কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা আছে। যখন উনি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন ভালো লেগেছিল, আমি বলেছিলাম শান্তি বজায় রাখতে। তা অবশ্য হয়নি, ইচ্ছাকৃত ভাবে হোক বা অন্য কোনও কারণে। এখন আমার মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ হল একটি সমস্যাসঙ্কুল রাজ্য। এই রাজ্য এখন ফ্যাসিস্তদের মুক্তাঙ্গন হয়ে উঠেছে যেখানে যুবশক্তির কোনও আদর্শ নেই, রাজনীতি সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই, নীতির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অপরাধপ্রবণতা ও দমননীতি। মমতা খুব নির্মম ভাবেই এ সবের শীর্ষে থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করছে। তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থন আদায় করছে প্রলোভন দেখিয়ে, টাকা দিয়ে, ক্ষমতার বুনিয়াদ তৈরি করছে টাকা ও ক্ষমতা দিয়ে। তরুণদের কর্মসংস্থান নেই, শিল্প নেই। বেকাররা এখন তোলাবাজি করছে আর বাঁচার তাগিদে অবৈধ কাজ করছে। আমার মনে হয় না যে উনি মুখ হয়ে উঠতে পারবেন।
২০১৯ সালে ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলি কি নরেন্দ্র মোদীকে হারাতে পারবে?
এটা হতেই হবে, এটা হওয়া দরকার। আমি বিরোধী দলগুলো এক হওয়ার জন্য আবেদন করব। যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো ইস্যুভিত্তিক বোঝাপড়া করেও সকলে জোট গড়েন ভয়াবহ বিপদ (বিজেপি) থেকে রক্ষা পেতে, তা হলেও সকলেও একত্রিত হোক। বিভিন্ন কারণে বিরোধী দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে, বিরোধী হিসাবে তারা একেবারেই ব্যর্থ। তার পরেও একটি মঞ্চ তৈরি হতে পারে এবং ফ্রন্ট গড়া যেতে পারে। তবে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে হতে রাতারাতি তা করা সম্ভব নয়। কিছুটা সময় লাগবে। হয়তো বিজেপির মুখোশ খুলে দিতে আরও একটা টার্ম বা ওই ধরনের কিছু একটা সময় লাগতে পারে। এখনই তা সম্ভব নাও হতে পারে। বিজেপি কী ক্ষতি করছে তা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে লোকের। আর বিরোধীদের এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিৎ ও একজোট হওয়া উচিৎ।
বর্তমান সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা নেওয়াকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন?
বিপজ্জনক বললেও কম বলা হয়। আমি আহত ও গভীর ভাবে চিন্তিত। যে ভারতের স্বাধীনতার জন্য গান্ধী লড়াই করেছিলেন, তার পক্ষে এটা খারাপ। কোনও রকম বিভেদ না করে নেহরুও প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বিজেপি ধর্মের ভিত্তিতে লোককে বিভাজিত করছে। বড় সংখ্যায় মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন যে তাঁরা মূল ধারার বাইরে একটা নির্দিষ্ট বিভাগের মানুষ, যাঁদের কোনও ক্ষমতা নেই, কোনও পদ নেই এবং কোনও সুযোগসুবিধার তাঁরা যোগ্য নন। এই কুণ্ঠাবোধও দুশ্চিন্তার কারণ, এটাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করা যাবে না, এই অনুভূতি কাজে লাগিয়েও কৌশল তৈরি করা যেতে পারে।
বিজেপি কি হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে এগোচ্ছে?
বর্তমান সংবিধানে সেটা সম্ভব নয়। ভারতেরক সংবিধান সংবিধান ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল দেশবাসীকে সমান অধিকার দিয়েছে, ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধা দিয়েছে। কিন্তু তাকে সরিয়ে রেখে তারা অজ্ঞতাবশত নীতি নির্ধারণ করে চলেছে এবং কাউকে কাউকে পাইয়ে দিয়ে সুবিধাভোগী ও স্তাবকশ্রেণী তৈরি করছে। ধর্মের ভিত্তিতে এ সব করা হলে তা দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র বলে ঘোষণা করারই নামান্তর।
জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া ছিল ঐতিহাসিক ভুল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি হতে না দেওয়াটা কী ধরনের ভুল?
(সহাস্যে) প্রতিভা পাটিলের নাম উঠে আসার আগে আমাকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করার জন্য প্রস্তাব করেছিল ইউপিএ। তাকে সমর্থন করেছিল জেডিইউ, আরজেডি, এসপি, বিজেপি, ডিএমকে এমনকি অকালি দল ও শিবসেনার কয়েকজন সদস্য। দক্ষিণী পুরো লবি, টি আর বালু আমাদর দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বেশ কয়েকবার এবং আমাকে প্রার্থী করার কথা বলেছিলেন। যদি এনডিএ এ ব্যাপারে বিভক্ত না হত, তা হলে আমি হতাম সর্বসম্মত প্রার্থী। পাঁচ বছর লোকসভার অধ্যক্ষ থাকাকালীন উনি (পড়ুন প্রকাশ কারাট) একবারই মাত্র প্রকাশ কারাট আমার বাড়িতে এসেছিলেন এই কথা বলতে যে বামদলগুলি রাষ্ট্রপতি পদে আমার নাম প্রস্তাব না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই একটা কথা বলতেই উনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আমি জানতে চাই যে যদি আমি তাঁকে সেটি করতে অনুরোধ করি, তিনি কোনও উত্তর না দিয়েই চলে যান। পরে তিনি সিপিআইয়ের বর্ধনকে দিয়ে প্রতিভা পাটিলের নাম প্রস্তাব করান এবং ইউপিএ তাতে রাজি হয়, কারণ তারা এর ফলে বামেদের ভোট পাবে।
(ছবিগুলি তুলেছেন সুবীর হালদার)