ইতিহাস তো বদলাবে না, পশ্চিমবঙ্গ নাম বদলে বাংলা হল কেন?
সংবিধান অনুযায়ী আমাদের দেশেরও দুটি নাম, রাজ্যের তিন নামে আপত্তি কেন?
- Total Shares
পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল করে বাংলা করার প্রস্তাব রাজ্য বিধানসভায় সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়েছে। আগের বার তিনটি ভাষার জন্য তিনটি নামের প্রস্তাব গিয়েছিল, তাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক প্রশ্ন তুলেছিল, একই রাজ্যের নাম তিনরকম হয় কী ভাবে। তাই এবার রাজ্য বিধানসভা থেকে শুধুমাত্র বাংলা নামের প্রস্তাব গিয়েছে। প্রস্তাব সম্বন্ধে বিধানসভায় অন্তত দু’দশক ধরে আলোচনা হয়েছে (এক টানা নয়), তার পরেও প্রস্তাব ফেরত এসেছে, আবার নতুন করে প্রস্তাব যাচ্ছে।
বাংলা নামের উৎপত্তি
গঙ্গানদী যেখানে সাগরে মিশেছে, সেখানে গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিডাই নামে প্রাচীন এক সভ্যতা ছিল। গ্রিকদের রচনা থেকে সে কথা জানা যায়। কিন্তু তা থেকে কী ভাবে বঙ্গ ও বাংলা নাম এল, সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করে কিছু এখনও জানা যায়নি। দক্ষিণ ভারতের একটি জনজাতি, যারা এখন অধুনা ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা তাদের সূর্যের দেবতা সিঙ্গ বঙ্গা, তা থেকে বঙ্গ নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। আবার আর্যদের রচনা অনুযায়ী রাজা বলি এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গ নামের উল্লেখ রয়েছে এমন প্রাচীন লিপিটি মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরে পাওয়া গিয়েছে। আটশো খ্রিস্টাব্দে সেই নথিটি উৎকীর্ণ হয়েছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা।
টলেমির মানচিত্রে এই জায়গার ছবি থাকলেও বঙ্গ নামের উল্লেখ নেই (উইকিমিডিয়া)
সামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ খ্রিস্টাবে বাংলার শাসন হন তখন তিনি শাহ-ই-বাংলা উপাধি ধারণ করেছিলেন।
ধীরে ধীরে ভূখণ্ডের নাম হয় বঙ্গ, বঙ্গদেশ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গ। যদিও পূর্ববঙ্গ বলে কিছু গঠিত হল না, তৈরি হল পূর্ব পাকিস্তান, যা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলা সাহিত্যে বারে বারে অবিভক্ত ভূখন্ডের নাম বাংলা ও বাংলাদেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার “সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”তেও এই ভূখণ্ডকে বাংলা নামে ডাকা হয়েছে। আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বাংলাদেশ’ কবিতাতেও অখণ্ড ভূখণ্ডকেই বাংলাদেশ ও বাংলা বলে ছত্রে ছত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ নামের উৎপত্তি ও আপত্তি
১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গ হলেও তা স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পশ্চিমাংশের নাম হয় পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ব অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়, ইতিহাস হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। দেশ ভাগের সেই স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ নাম।
১৭৭৬ সালের বাংলা-বিহারের দেওয়াল মানচিত্র (উইকিমিডিয়া কমনস)
পঞ্জাবও ভাগ হয়েছে, কিন্তু ভারতে সেটি পঞ্জাব নামেই পরিচিত হয়েছে, সরকারি ভাবে কোনও দিনই তার নাম পূর্ব পঞ্জাব ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ১৯০৫ সালের ইতিহাস মেনেই বঙ্গভূমির একাংশের নাম হয় পশ্চিমবঙ্গ, ইংরেজিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল।
রাজধানীর নাম বদলে ইংরেজিকে ক্যালকাটা থেকে কলকাতা হলেও, রাজ্যের নাম বদল করা হয়নি। রাজ্যের নাম বদলের প্রস্তাব হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। তৃণমূল সরকার নাম বদলের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাজ্যের তিন নাম নিয়ে (বাংলা, বেঙ্গল ও বঙ্গাল) আপত্তি ছিল বামফ্রন্টের। কেন্দ্রীয় সরকারও একই ভাবে আপত্তি করে সেই নাম বদলের প্রস্তাব খারিজ করে দেয়।
এ বার অবশ্য রাজ্য বিধানসভায় সরকারি ভাবে কোনও রাজনৈতিক দলই আপত্তি করেনি। আশা করা হচ্ছে রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে বদলে শীঘ্রই বাংলা হয়ে যাবে। তবে বাংলা নামের অনেক অর্থ হতে পারে। বাংলা শব্দের অর্থ
বাংলা একটা ভূখণ্ডের নাম, বাংলা আবার একটা ভাষারও নাম। বাঙালির কাছে বাংলা শব্দের আরও অনেকগুলো অর্থ আছে। সহজ কথায় বলতে অনুরোধ করার সময়ে বন্ধুমহলে বলা হয়ে থাকে “বাংলায় বল”। বাংলা শব্দের আরেকটি অর্থ হল “দেশী মদ”। তাই এই নাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নামটি দেওয়ার আগে অন্য দিকগুলিও বিবেচনা করার দরকার ছিল। গাড়ির নাম্বাপপ্লেট নিয়ে ইতিমধ্যেই বিদ্রুপ শুরু হয়ে গেছে।
ইতিহাস, নামের গুরুত্ব, ভার, ঐতিহ্য প্রভৃতি বজায় রাখতে হলে বঙ্গদেশ নামটি অনেক বেশি উপযুক্ত হত বলে আমার ধারণা।
একই রাজ্যের তিন নাম সম্ভব?
পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল করা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রথম আপত্তিটাই ছিল একই রাজ্যের তিনটি নাম নিয়ে। সত্যি, তা সম্ভব নয়। তাই সেই আপত্তির কথা বুঝে রাজ্য সরকারও সব ভাষার জন্য একটিমাত্র নাম প্রস্তাব করে পাঠিয়েছে। কিন্তু এই প্রশ্ন অন্তত গতকাল বিধানসভায় ওঠেনি যে, সাংবিধানিক ভাবে আমাদের দেশের নাম যদি একই সঙ্গে ভারত ও ইন্ডিয়া হতে পারে, তা হলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তিন নামে আপত্তি কেন?
ভারতকে হিন্দুস্তান নামেও অনেকে চেনেন। বাংলাদেশের মানুষ এ দেশকে ইন্ডিয়া বলে থাকেন (যুক্তি হল ভারত বলতে তাঁরা ভারতবর্ষকে বোঝেন), আবার পাকিস্তান এই দেশকে হিন্দুস্তান নামে চেনে।
ভারতের একাধিক নাম থাকা অবশ্য ব্যতিক্রমী নয়। ডয়েশল্যান্ডকে বিদেশিরা জার্মানি বলে, মাজারকে বিদেশিরা হাঙ্গেরি বলে, মিশরকে বলা হয় ইজিপ্ট, সুয়োমেনকে বলা হয় ফিনল্যান্ড—অনেক উদাহরণ রয়েছে। ছোট উদাহরণও আছে। আমরা যাকে ইস্টার দ্বীপ বলে থাকি তার আরেকটি নাম হল ইসলা দে পাস্কুয়া। পশ্চিমবঙ্গও একাধিক নামে পরিচিত হলে সমস্যা কী ছিল!
কেন নাম বদল করা হয়
এক সময় নাম বদল করা হত রাজার ইচ্ছায়। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ বাইজানটিয়াম। রোমের অধীনে এই জায়গা আসার পরে সম্রাট কনস্টান্টাইন এই জায়গার নাম নিজের নামে রাখেন, নাম হয় কনস্ট্যান্টিনোপল। পরে ১৯২৮ সালে আরবির বদলে রোমান হরফে লেখা শুরু হয়, স্বদেশী ঝড় ওঠে, তখন নাম হয় ইস্তানবুল।
এ দেশে নাম বদলের অসংখ্য উদাহরণ হয়েছে। দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপন করে মহম্মদ বিন তুঘলক তার নাম দেন দৌলতাবাদ। দিল্লি শহরকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে সেখানে রাজধানী তৈরি করে তার নাম শাহজাহানাবাদ দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। এখন এই জায়গাটি পুরোনো দিল্লি নামে পরিচিত। বম্বে, মাদ্রাজ ও ব্যাঙ্গালোরের নামও বদলেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাজ্যের নামও বদলেছিল।
নাম বদল হয় সাংস্কৃতিক কারণে। সহজ উদাহরণ হল রোডেশিয়া। কোম্পানির ম্যানেজার সিসিল রোডসের নামে ভূখণ্ডটির নাম হয়েছিল রোডেশিয়া। পরে উত্তর রোডেশিয়া ও দক্ষিণ রোডেশিয়া নামে দুই দেশে ভেঙে যায়, স্বাভাবিক সীমান্ত ছিল জাম্বেজি নদী। পরে জাম্বেজি নদীর উত্তরের দেশটির নাম হয় জাম্বিয়া, দক্ষিণের দেশটির নাম হয় জিম্বাবোয়ে। স্বাভাবিক কারণেই তারা ইউরোপীয় সাহেবের নাম মুছে ফেলেছিল।
প্রতিবেশী সিলন তাদের ঐতিহ্যের শ্রীলঙ্কা নাম ফিরিয়ে এনেছিল ১৯৭২ সালে। আরও এক প্রতিবেশী ব্রহ্মদেশের নাম হয়েছিল বর্মা, এখন তা বদলে মিয়ানমার। শ্যামদেশের নাম বদলে হয়েছে থাইল্যান্ড। দেশের নাম বদলের অন্তত একশোটি উদাহরণ দেওয়া যায় সারা বিশ্ব জুড়ে।
পশ্চিমে সমস্যা?
পূর্ববঙ্গ যখন নেই তখন পশ্চিম কেন? অতএব পশ্চিম বাদ দিতে হবে। আর বদলাতেই যদি হবে তা হলে সহজ নাম বাংলা করে দাও। সংখ্যা থাকলেই হল। বিতর্ক ২৯৪-এর মধ্যে। রাজ্যের বাকি ৯ কোটির বেশি মানুষের মতামত দরকার নেই। কনস্টানটাইনের সময়েও যেমন রাজার ইচ্ছায় রাজ্যের নাম হত, এখনও তাই-ই হয়। শুধু রাজ্য নয়, রেলস্টেশনের নামও বদলায়।
ইস্ট তিমোর বা তিমোর লেস্টে নামে একটি দেশ আছে, গুগল করলেই পাওয়া যাবে। ওয়েস্ট তিমোর নামে কোনও দেশ নেই (যদিও ইন্দোনেশিয়ার একটা রাজ্য ওয়েস্ট তিমোর বা তিমোর বারাত)। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে একটি ক্রিকেট দল আছে, বেশ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দল একজোট হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে ক্রিকেট খেলে। তারা অবশ্য বিশ্বফুটবল ও অলিম্পিক্সে যে যার দেশের নামেই প্রতিনিধিত্ব করে। ইস্ট ইন্ডিজ নামে সেই অর্থে কিছু নেই। যদিও ঐতিহাসিক ভাবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি নামে ভূখণ্ড একসময় ছিল। তারাও নাম বদলে ফেলেছে।
ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান টেরিটরি, ইস্টার্ন গ্রুপ নামে ভূখণ্ড আছে, সবকটি দেশ মিলে একযোগে মুদ্রা প্রকাশ করে এখনও, কিন্তু ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান টেরিটরি, ওয়েস্টার্ন গ্রুপ নামে কিছু নেই। এই সব দেশ এখনই নাম বদল করছে বলে খবর নেই।
এ বার ফেরা যাক বাংলায়। যাঁরা পূর্ববঙ্গ থেকে এপারে এসেছেন তাঁরা বুক চিতিয়ে বলেন আমরা বাঙাল! সাধারণ ভাবে তাঁরা কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক। ঘটিরা সমর্থন করেন মোহনবাগানকে। দেশভাগের যন্ত্রণা মুছতে এ বার তা হলে কি ইস্ট শব্দটি মুছে দেবেন?
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, বঙ্গোপসাগরের নাম বদলাবে কি?
নাম বদল করলে নাম ছাড়া অন্য কিছু বদলায় বলে মনে হয় না। সময়ের সঙ্গে, ভাষা ও জনজাতি বদলের সঙ্গে নামও বদলে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সময়ের সঙ্গে বদলের অপেক্ষা করা হয় না, জোর করে বদলে দেওয়া হয়। সেই বদল সকলে মেনে নিতে পারেন না।
বদল যদি সর্বসম্মত হত, তাহলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা হাইকোর্ট প্রভৃতির নামও বদলে যেত। আর বাঙালিরা ইংরেজিতে কলকাতা লিখলেও বলার সময় ক্যালকাটাই বলে থাকেন।
রাজ্য জুড়ে একটা বিতর্ক হওয়া দরকার ছিল একতরফা নাম বদলে না দিয়ে। ১০ কোটি মানুষের রাজ্যের নাম কেন বদলানো হবে ২৯৪ জনের ইচ্ছায়? বঙ্গোপসাগরের নাম কি বদলাবে, কিংবা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নাম? বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট বলতে শিল্পের যে ধারার কথা বোঝানো হয় তাও কি বদলে যাবে? নাম বদলের সঙ্গে সাইবোর্ড ছাড়া আসলে আর কিছুই বদলায় না।