লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে কেন বামফ্রন্টের সঙ্গে জোটে আগ্রহী কংগ্রেস?
রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে কী জানিয়ে এলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা?
- Total Shares
জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ ও বিধায়ক এবং বিভিন্ন পদাধিকারীদের ডেকেছিলেন দিল্লিতে। তিনি একটা বিষয়েই জানতে চেয়েছিলেন যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কার সঙ্গে জোট বাঁধতে চায়। প্রত্যেক নেতা ও নেত্রী তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত জানিয়েছেন।
এই বৈঠকে আমাদের যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, উনি ধৈর্য ধরে সরলের মতামত শুনেছেন এবং মতামতের পিছনে কী কী যুক্তি আছে সে কথা উনি জানতে চেয়েছিলেন। যাংরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করতে চেয়েছেন তাঁরা তো বলেইছেন, এ ছাড়া কয়েকজন তাঁদের বক্তব্য লিখিত ভাবে রাহুল গান্ধীকে জানিয়েছেন। কাদের সঙ্গে জোট হলে দলের কী অবস্থা হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ২০১৯ সালের নির্বাচনে হয় ইউপিএ জোট না হয় এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসবে এ ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত। ইউপিএ জোটের সঙ্গে কারা থাকবে এবং এনডিএ জোটের সঙ্গে কারা থাকবে সে ব্যাপারে আমাদের একটু চিন্তা করতে হবে। তার কারণ হল, আমাদের ফাইনাল ম্যাচ যদি লোকসভা ভোট হয়, তা হলে তার আগে তিনটি সেমিফাইনাল ম্যাচ আছে, তা হল রাজস্থান, ছত্তীশগড় ও মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা ভোট, যা জানুয়ারি মাসে হওয়ার কথা।
জাতীয় কংগ্রেস কমিটি এখনও অবধি শরদ পওয়ারের এনসিপি, দক্ষিণের ডিএমকে এবং লালুপ্রসাদের আরজেডি, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি, জেএমএম, ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং কুমারস্বামীর জেডিএস-দের নিয়ে ইউপিএ শৃঙ্খল তৈরি করতে চলেছে। এই শৃঙ্খলের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হল সাম্প্রদায়িক বিষ বিজেপি যে ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল একটি জোট তৈরি করে।
২০১৪ সালে বিজেপির যে রমরমা ছিল, এখন আর বিজেপির সেই রমরমা নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে কী ফল হবে, তা আমি বলতে পারব না। ফলে ২০১৯ সালে বিজেপি যদি জয়ী না হতে পারে তা হলে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কতটা গুরুত্ব থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
কংগ্রেসকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং নিজের ক্ষমতায় লড়তে হবে সে কথা আমরা রাহুল গান্ধীকে বলে এসেছি। কংগ্রেসকে নিজের ক্ষমতায় লড়তে গেলে ৬৫,০০০ বুথে এজেন্ট দিতে হবে, সে জন্য সংগঠন তৈরি করতে হবে। এখন ২০১৮ সালের জুলাই মাস। ২০১৯ সালে যদি নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে ৬৫,০০০ বুথে আমাদের পক্ষে সংগঠন তৈরি করা সম্ভব নয়, এটা পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বাস্তব চিত্র।
একদিকে তৃণমূলের তোলাবাজি ও ভীতি প্রদর্শন, অন্য দিকে বিজেপির সন্ত্রাস। এই দুইয়ের মধ্যে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতে হয়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আজকের তারিখেও যাঁরা কংগ্রেস করছেন তাঁরা কংগ্রেসের নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখেই তাঁরা কংগ্রেসের প্রতি ভালোবাসা দেখান এবং কংগ্রেসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
২০১৬ সালে কংগ্রেস এবং বাম জোটের একটি পরিসংখ্যান দিলে দেখা যাবে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মানুষ কংগ্রেসের কত কাছে আসতে চায়। ২০১৬ সালে কংগ্রেস এবং বাম জোটের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৯ শতাংশ। ২০১৬ সালে বিজেপি সেই প্রাপ্ত ভোট ছিল ১০.৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে, যখন মোদীর প্রবল হাওয়া, সেখানে কংগ্রেস চুরি করেছে, কংগ্রেসের নামে দুর্নীতি, কংগ্রেস স্বজনপোষণ করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম প্রচার করছে, রাহুল গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী ও ডঃ মনমোহন সিংয়ের নামে প্রচণ্ড কুৎসা করছে সেখানেও ২০১৪ সালে বিজেপির ভোট দাঁড়াল ১৭.২ শতাংশে।
রাহুল গান্ধী এ কথা বলে দেননি যে আমাদের কার সঙ্গে জোট করতে হবে
রাহুল গান্ধীকে আমরা যে কথা বলে এসেছিলাম, যেটা আমাদের ঐকান্তিক ইচ্ছাও বটে। আমরা বলে এসেছি যে এখনই আপনি যদি কোনও ফল চান তা হলে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে গেলে যেটা আমরা দেখেছি, যেহেতু সমমনোভাবাপন্ন একটি দল, নীতি ও আদর্শগত খুব একটা ফারাক না থাকলেও, ৪২ জন বিধায়ক দিয়ে শুরু করে আমরা দেখলাম যে আস্তে আস্তে তৃণমূল কংগ্রেস আমাদের ১৫ জন বিধায়ককে তাদের দলে টেনে নিল। ২০১১ সালে বামবিরোধী সমস্ত দলকে একত্রিত করে ছাতার তলায় আনার জন্য দিল্লি থেকে সোনিয়া গান্ধী নির্দেশ দিলেন। আমাদের দলের বিভিন্ন নেতা ও নেত্রীর নির্দেশে আমরা আত্মত্যাগে বিশ্বাসী হয়েছিলাম।
আমরা বলেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে একটা মুক্তির সূর্য উপহার দিতে হবে যে মুক্তির সূর্যের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে, জেলা পরিষদ-পঞ্চায়েতে যাতে মানুষ আলোর ছটা পায়। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে আমরা দেখলাম, এই বামফ্রন্ট সরকার প্রতিবারই কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট না হওয়ার ফলে ওরা সুবিধা পেয়ে যায় এবং প্রতি বারই ওরা জিতে আসে। তাই সমস্ত বা-বিরোধী জোট একত্রিত হয়ে আমরা ভোট করলাম। তখন দেখা গেল যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেই বামবিরোধী ভোট দিয়ে সেই জোটকে জয়যুক্ত করল।
এখানে একটা প্রশ্ন রয়েছে, ২০১১ সালের নির্বাচনে মানুষ মানুষ ভেবে নিয়েছিল যে তৃণমূল কংগ্রেসকে আমরা ভোট দেব, কেন ভোট দিচ্ছি আমরা জানি না, তবে এ কথা নিশ্চিত যে বামফ্রন্টকে ভোট দেব না। কারণ বামফ্রন্টের অত্যাচার-অনাচার দেখে দেখে মানুষ প্রচণ্ড ভাবে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালে আমরা তৃণমূলের এই পরিবর্তন থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিলাম। আমরা বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট করেছিলাম। তবে জোটে একটা অসুবিধা হয়েছিল। আসলে নির্বাচনের দিন ঘোষণার পরে আমরা এই জোটের কথা আলোচনা করলাম। মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে পৌছতে পারলাম না। জানাতে পারলাম না, এই জোট কী ভাবে হবে এবং তার কাণ্ডারী কে হবেন।
যে কোনও খেলা বলুন বা দল, একজন অধিনায়কের দরকার হয়, নেতার দরকার হয়, যাঁকে দেখে মানুষ ভোট দেবেন। যাঁকে সামনে রেখে আমরা লড়াই করব। তিনি সিপিএম থেকেও কেউ হতে পারতেন, আমাদের দল থেকেও কেউ হতে পারতেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে যে ভোট হয়েছিল, ২০১৬ সালে সেই প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে ভোট হয়নি। আমরা কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরিনি, কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন তা নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২১১টি আসন পেয়েছিলেন ঠিক কতা, কিন্তু ভোটের ব্যবধান ছিল ১.২ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ রাজনীতি-সেচতন। তাই আমরা যদি ২০১৬ সালে একটি জোট করি, তা ভেঙে দিয়ে আবার ২০১৯ সালে পৃথক ভাবে জোট গড়ি, ২০১১ সালে আবার জোট গড়ি, তা হলে লোকে মনে করতেই পারেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর জন্যই একটা সুবিধাবাদী জোট হচ্ছে। কিন্তু এই জোটকে সুদূরপ্রসারী করলে আমরা মনে করি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরানো সম্ভব হবে। গ্রামগঞ্জে ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মানুষ আর এই তৃণমূল সরকারকে পছন্দ করছে না।
আমাদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কেউ ভোট দিলে ২ টাকা কেজি রেশন পাচ্ছে না, অথবা তাঁর ঘরে বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হচ্ছে। বামফ্রন্ট যে অত্যাচার করেছিল, সেই একই অত্যাচার তৃণমূলও করছে। মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ চাইছে।
রাহুল গান্ধী এ কথা বলে দেননি যে আমাদের কার সঙ্গে জোট করতে হবে। জোট করতে হবে সেই দলের সঙ্গে যেকানে কংগ্রেসের রাজনৈতিক লাভ আছে। তিনি ওয়ার্কিং কিমিটির বৈঠক ডাকবেন, সেখানে এই বিষয়ে আবার আলোচনা হবে। একটা সময় ছিল যখন দিল্লি আমাদের উপরে জোট চাপিয়ে দিত, কারণ আমরা সর্বভারতীয় দল। তবে রাহু গান্ধী একটা কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে বাংলার কংগ্রেস কর্মী ও নেতাদের যে “তোমরা যদি মনে করি ক-দলের সঙ্গে জোট করে তোমরা লাভবান হব, তা হলে আমরা সেই দলের সঙ্গেই জোট কর। যদি মনে করি খ-দলের সঙ্গে জোট করে তোমরা লাভবান হব, তা হলে আমরা সেই দলের সঙ্গেই জোট কর। যদি তোমরা মনে কর যে একা লড়ে বেশি আসন পাবে ২০১৯ সালে, তা হলে তোমরা সে দিকে এগোতে পার।”
আমাদের বিশ্বাস, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস যদি জোট করে লড়াই করে তা হলে পশ্চিমবঙ্গে আমরা অনেক ভালো ফল করতে পারব
স্বীকার করতে বাধা নেই এ রাজ্যে আমাদের সংগঠনম দুর্বল হয়ে গেছে। বহু দিন কংগ্রেস সরকারে নেই আর বিভিন্ন ভাবে তৃণমূল যে ভাবে কংগ্রেসকে ভাঙার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে তাতে আগে সংগঠন বাঁচাতে হবে তার পরে একার পায়ে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে।
কংগ্রেস আত্মত্যাগে বিশ্বাসী। ইউপিএ ১ ও ২-এ প্রধানমন্ত্রীত্বের সুযোগ পেয়েও সোনিয়া গান্ধী অবহেলায় তা পরিত্যাগ করে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করেন। কর্নাটকেও সম্প্রতি আমরা তা করেছি, কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী করেছি। কংগ্রেস কোনও দিনই ক্ষমতার পিছনে দৌড়য় না। কংগ্রেসের মানুষ উন্নতি ও সামাজিক উন্নয়নের পিছনে দৌড়য়।
মমতা এখন বুঝেছেন যে ফেডেরাল ফ্রন্ট তিনি তৈরি করতে পারবেন না। আজ যাঁরা এই ফেডেরাল ফ্রন্টের কথা বলছেন, তাঁদের একসঙ্গে বসিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করেন কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, কেউ বলবেন না আমি প্রধানমন্ত্রী হব, সকলেই চুপ করে থাকবেন। সকলেরই ক্ষমতার লিপ্সা এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। আমি তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে রাজ্যের ৪২টি আসনেই তৃণমূল কংগ্রেস জিতল। লোকসভার মোট আসসেন নিরিখে এই আসন সংখ্যা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে না।
আমাদের প্রথম ইচ্ছা নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তা না হলে এমন কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দল, যারা আর যাই হোক এনডিএ সরকারে যাবে না, অর্থাৎ বামফ্রন্ট, তাদের সঙ্গে জোট করা। আমাদের বিশ্বাস, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস যদি জোট করে লড়াই করে তা হলে পশ্চিমবঙ্গে আমরা অনেক ভালো ফল করতে পারব, সাম্প্রদায়িক বিজেপি ও আগ্রাসী তৃণমূলকে আমরা আটকাতে পারব।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমরা জোট গড়ে লড়লেও দেখব যে উনি এনডিএতে যোগ দিলেন। কারণ বিজেপির ওঁর বিরুদ্ধ সারদা-নারদের মতো অস্ত্র আছে। বিজেপি তা প্রয়োগ করলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার আমাদের ছেড়ে নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরবেন। জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিনই সেই বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেননি। কখনও আন্না হাজারের কাছে গেছেন, কখনও বিজেপির সঙ্গে জোট করেছেন, কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছেন। যার সঙ্গে জোট করেছেন সেই দল পারভূত হয়েছে।