কংগ্রেস কী ভাবে মুছে গেল উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য থেকে?

তিন রাজ্যে জয়ী কংগ্রেস, তবে উত্তরপূর্ব ভারত তাদের কাছে কাঁটা

 |  6-minute read |   15-12-2018
  • Total Shares

পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি ধরাশায়ী, তবে ভোটের ফলাফল দেখে একথা বলা যাবে না যে বিজেপি গো-হারান হেরেছে। যদিও ভোটে জেতাটাই শেষ কথা, স্কোর-খাতার বাউন্ডারি, ওভারবাউন্ডারি, বাই রান, নো বল ইত্যাদি প্রসঙ্গ আসে তারপরে। তাই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল পড়তে হবে এই ভাবে:  কংগ্রেস ৩ এবং বিজেপি ০। কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও বলতে হবে মিজোরামে পরাজিত হয়ে উত্তর পূর্ব ভারতে নিজেদের শেষ ঠিকানাটাও হারাল কংগ্রেস।

পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি যেমন ছত্তীশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে তেমনই আঞ্চলিক দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের কাছে বিপুল ভোটে হেরে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল কংগ্রেস। উত্তর-পূর্ব ভারতে কংগ্রেস আর কোনও রাজ্যেই ক্ষমতায় থাকল না। এমনকি জোটসঙ্গী হিসাবেও কংগ্রেসের অস্তিত্ব থাকল না উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনও রাজ্যে। উত্তর-পূর্ব ভারতের যে সব রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, এক এক করে তার সবক’টিই কংগ্রেসের হাতছাড়া হল।

cong_pti_121518051731.jpg তিন রাজ্যে জয়ী কংগ্রেস, তবে কাঁটা উত্তর-পূর্ব ভারত (ছবি: পিটিআই)

উত্তর-পূর্ব ভারতে কংগ্রেসের শাসন কায়েম ছিল বিগত বেশ কয়েক দশক ধরেই। কেবল ত্রিপুরা ও সিকিম ছিল ব্যতিক্রম। বাকি রাজ্যগুলি যেমন অসম, অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয় ছিল কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের দুর্গ। কিন্তু শেষ কয়েক বছরের নির্বাচনে কংগ্রেস একের পর এক সব ক’টি রাজ্য থেকে তাদের শাসন ক্ষমতা খুইয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। টিম টিম করে জ্বলছিল একমাত্র মিজোরাম। সেটাও স্থানীয় দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ছিনিয়ে নিল এবার কংগ্রেসের কাছ থেকে।

উত্তর-পূর্বে পালাবদল

উত্তর-পূর্ব ভারতে কংগ্রেসের দুর্জয় ঘাঁটিতে বিজেপি প্রথম আঘাত হানে ২০১৬ সালের মে মাসে। একইসঙ্গে বিজেপির জয়যাত্রা শুরু হয় প্রথমে অসম দিয়ে। ২০১৬ সালের শেষে অরুণাচলপ্রদেশ, তারপরে মণিপুর হয়ে অবশেষে ত্রিপুরা; যদিও ত্রিপুরা ছিল বাম দুর্গ। হিসেব মতো উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি দখল করতে বিজেপির সময় লেগেছে ১৮ মাস। গত দেড় বছরে তারা এক এক করে চারটি রাজ্যে নিজেদের শাসন কায়েম করে। ঠিক একই ভাবে কংগ্রেসের হাতছাড়া হয় একদা শাসিত রাজ্যগুলি। একমাত্র ত্রিপুরায় বাম দুর্গ ছিল অটুট, সেখানেও বিজেপি থাবা বসায়।

এই ভাবে উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যের মধ্যে পাঁচটিতে সরাসরি অথবা জোট সরকার করে বিজেপি তাদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য হল অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অসম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা। যার  সিংহভাগ বিজেপি দখল করে ফেলেছে কেবল মিজোরাম ছাড়া।

কী ভাবে নিঃস্ব হল কংগ্রেস

  • অরুণাচলপ্রদেশ

অরুণাচলে একেরপর এক পালাবদল ঘটে ২০১৬ সালে। ওই বছর জুলাই মাসে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হন পেমা খাণ্ডু। কিন্তু তিনি সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে পেমা পিপলস পার্টি অব অরুণাচলে যোগ দেন। সরকার তখন বদলে হয়ে যায় পিপলস পার্টির। তারপর ফের পালাবদল হয় ডিসেম্বরে। পেমা এবার দল বদলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। ৬০টি বিধানসভা আসনের রাজ্য অরুণাচলপ্রদেশে টিমটিম করা জ্বলা বিজেপি একলাফে ৪৮ জন বিধায়কে পৌঁছে যায় আর নিঃস্ব হয়ে যায় কংগ্রেস। বিধায়ক আসনের ছবিটা এখন পিপলস পার্টি ৯টি, নির্দল ২টি ও  কংগ্রেসের ১টি। অথচ ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ৪২টি আসন পেয়েছিল। তারপরে সে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল।

pema-khandu-arunacha_121518051950.jpgপেমা খাণ্ডুকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন রাজ্যপাল তথাগত রায় (ছবি: পিটিআই)

  • মণিপুর

মনিপুরেও ২০১৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হয়। যদিও পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। মণিপুরের ৬০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ২৮টি ও বিজেপি ২১টি পায়। কিন্তু এনপিএফ, এনপিপি, এলজেপি ও নির্দল প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে বিজেপি। তারপরও কংগ্রেস ছেড়ে অনেকে বিজেপিতে যোগ দেয়। সবমিলিয়ে বিজেপির বিধায়ক ৩১ ও কংগ্রেসের কমে গিয়ে ১৯জন। এখন দল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেয়ে গিয়েছে। 

  • অসম

অসমে ২০১৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতা দখল করে বিজেপি ইতিহাস তৈরি করে। যে রাজ্যে মাত্র ২৭টি আসন ছিল গেরুয়া শিবিরের সেখানে ১২৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি তথা এনডিএ পায় ৮৬টি আসন। অসমে প্রথম বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। তার আগে বহুবছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।

  • নাগাল্যান্ড

নাগাল্যান্ডের ৬০টি আসনের মধ্যে নাগা পিপলস ফ্রন্টের আসন ছিল ৪৫টি। বিজেপির ছিল মাত্র ৪টি ও জেডিইউ-র ছিল একটি আসন। এই অবস্থায় এনপিএফ ভেঙে তৈরি হওয়া ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্র্যাটিক পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ২০০৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত একটানা মুখ্যমন্ত্রী থাকা নেইফিউ রিও। দলের নেতৃত্ব সামলে বিজেপির সঙ্গে তিনি জোট করে ভোটে লড়েন।  জোটবদ্ধ এনডিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে নাগাল্যান্ডের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী ফের ক্ষমতা লাভ করেন।

neiphiu_rio_121518051912.jpegনেইফিউ রিও (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রীর হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হওয়ার আশায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে লোকসভার সদস্য হন নেইফিউ রিও। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন সফল না হলেও তিনি ও তাঁর দল বিজেপিকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ায় তিনি চতুর্থবারের জন্য নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন।

  • মেঘালয়

এই রাজ্যে মাত্র দু'জন বিধায়ক নিয়েও কংগ্রেস-বিরোধী জোট তৈরি করতে সফল হয়েছে বিজেপি। এনপিপির ১৯ জন বিধায়ক ছাড়াও এই জোটে রয়েছে ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ছ' জন, পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের চার জন, হিল স্টেট পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দু' জন এবং এক জন নির্দল বিধায়ক। সব মিলিয়ে ৩৪ জন বিধায়ক নিয়ে তৈরি হয়েছে মেঘালয়ের অকংগ্রেসি সরকার, মেঘালয় ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এমডিএ)। দল হিসেবে বিজেপির তেমন প্রভাব ছিল না, কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে বিজেপি যে ভাবে ক্ষমতা দখলের ঝড় তোলে তাতে মাত্র দু’জন বিধায়ক নিয়েই ক্ষমতায় আসীন তারা।

  • মিজোরাম

মিজোরামই ছিল উত্তর-পূর্বে কংগ্রেসের শেষ আশ্রয়। এ রাজ্যে ১০ বছর পর ক্ষমতায় ফিরল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট। মোট ৪০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২৬টিতে জিতেছে জোরামথাঙ্গার নেতৃত্বাধীন এমএনএফ। যেখানে ২০১৩ সালের ভোটে তারা পেয়েছিল মাত্র পাঁচটি আসন। এ বারে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৭.৬ শতাংশ আর কংগ্রেসের ৩০.২ শতাংশ।

কংগ্রেসের হাল বোঝার জন্য একটি তথ্য এখানে দেওয়া যেতেই পারে। বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী লাল থানওয়ালা তাঁর নিজের এলাকা সারচিপ-সহ দু’টি বিধানসভাতেই হেরে গিয়েছেন। অন্য যে আসনে তিনি হেরেছেন সেটি হল চম্পাই দক্ষিণ। মিজোরাম বিধানসভায় তুইচাওং কেন্দ্রে জিতেছে তারা। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত টানা দশ বছর ধরে মিজোরামে শাসন করেছে এমএনএফ। কংগ্রেসের এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব বলেই মনে করা যেতে পারে। ভোটের ঠিক আগে আগেই পদত্যাগ করেন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর লালজিরলিয়ানা, প্রাক্তন মন্ত্রী লালরিনলিয়ানা সাইলো এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ হিফেই।

এ বারের মিজেরাম ভোটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল নিষেধাজ্ঞা এবং উন্নয়ন। কংগ্রেস সরকার রাজ্যে মদ্যপানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পারমিট ব্যবস্থা লাগু করেছিল। মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট তাদের প্রচারে বলেছিল তারা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল চার্চও। উল্লেখ্য; মিজোরামে জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশই খ্রিস্টান।

কংগ্রেসের লাভ হল কি

মিজোরামের ফলাফলের পর কংগ্রেস উত্তর-পূর্বের মোট ৮টি রাজ্যেই ক্ষমতা হারাল। ২০১৪ সাল থেকে এই অঞ্চলে একের পর এক রাজ্যে জিতে চলেছে বিজেপি। এখন অসাম, অরুণাচলপ্রদেশ, ত্রিপুরা এবং মণিপুরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ডে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপির সহযোগী দল।

বিজেপির হোঁচট খাওয়া শুরু হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে গুজরাট নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি রাজ্যের উপনির্বাচন থেকেই। যার মধ্যে ১৩টি আসনের লোকসভা উপনির্বাচনে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গী মিলে পেয়েছিল মাত্র ৩টি আর ২২টি বিধানসভা উপনির্বাচনের মধ্যে ৫টি। ফলত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের এই ফলাফলকে বলা যেতে পারে  জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির আগাম দিকনির্দেশ।

বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে প্রায় ১৮ বছর যাবত কেন্দ্রে ছিল জোট সরকার। তার আগের পাঁচ বছর কেন্দ্রে ছিল সংখ্যালঘু সরকার, তার আগের দু’বছরও জোট সরকার – সব মিলিয়ে কার্যত তিন দশক ধরে ছিল জোট সরকার। সেই ট্রেন্ড ভেঙে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। কিন্তু তার পরবর্তীকালের নির্বাচনগুলিতে বিজেপি খুব যে ফায়দা তুলতে পেরেছে তাও নয়। তাই লোকসভার আগেই এতগুলি বড় রাজ্যের ভোট শাসক বিজেপির কাছে ছিল একটা পরীক্ষা।

rahul_naidu_121518051844.jpeg তেলঙ্গনায় চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে জোটে লাভ হয়নি রাহুল গান্ধীর (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

ভোটের লড়াই থেকে বিজেপি নিজেদের ক্ষমতা অনুধাবন করে লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারবে। সুযোগ রাহুল গান্ধীদেরও। কারণ তারাও বিজেপির কমজোর জায়গায় আঘাত করে ফায়দা তুলতে পারবে। কিন্তু পাঁচ রাজ্যের মধ্যে কংগ্রেস একমাত্র ছত্তিশগড়ে তার প্রবল প্রতিপক্ষকে সরাসরি ধরাশায়ী করতে পেরেছে।  মধ্যপ্রদেশ জিতলেও সেখানে বিজেপির পক্ষে খারাপ হলেও কংগ্রেসের পক্ষে ততটা ভাল নয়। গরিষ্ঠতার জন্য যে কয়টি আসন পাওয়া প্রয়োজন ছিল, অন্য দলের সাহায্য নিয়ে, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে তার চেয়ে দু’একটি বেশি আসন পেয়েছে মাত্র। তেলঙ্গনার বিপর্যয়ে বলা যায় চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাটাই ভুল, কারণ তেলঙ্গনার মানুষের একটা বড় অংশের চোখে চন্দ্রবাবু এখনও সেই খলনায়ক যিনি অন্ধ্রপ্রদেশ ভাগের তুমুল বিরোধিতা করেছিলেন।

তিন রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও মিজোরামে ক্ষমতাচ্যুত হওয়াতে  উত্তর-পূর্ব ভারতের কোথাও আর কংগ্রেস শাসন অবশিষ্ট রইল না।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

TAPAN MALLICK CHOWDHURY TAPAN MALLICK CHOWDHURY

The writer is a journalist.

Comment