যাঁরা মেহুলকে অ্যান্টিগা যেতে পরামর্শ দিলেন, তাঁদের কেন ধরা হচ্ছে না?

অ্যান্টিগায় আবেদনের সময়ে ভারতের তরফে নেতিবাচক কোনও রিপোর্ট দেওয়া হয়নি

 |  4-minute read |   09-08-2018
  • Total Shares

মেহুল চোকসিকে কবে দেশে ফেরত আনা হবে, তা বুক ঠুকে কেউ বলতে পারছেন না। লোলিত মোদী ও বিজয় মালিয়াও বিদেশে, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ওঁরা অভিযুক্ত। এঁদের কাকে কবে দেশের প্রশাসন ফেরায়, তা নিয়ে যত না আগ্রহ তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ‘লুটে’ নেওয়া টাকা উদ্ধার হবে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে।

এখন সব স্থানে,  ‘মেহুলের হুল’ নিয়ে হইচই চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব‍্যাঙ্কের ১৪,৩৫৬ কোটি টাকা গায়েব!

মেহুল কোন সময় অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডার নাগরিক হওয়ার আবেদন করেন? তথ‍্য বলছে, ২০১৭ সালের মে মাসে। সেই মাসেই তাঁর ৫৯ বছর বয়স হয়। যাবতীয় নিয়ম মেনে নাগরিকত্ব পেয়ে যান ন’মাসের মধ‍্যে। ২০১৭ ডিসেম্বরে। সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (সিআইইউ) নামে সে দেশে একটি আইন আছে যখন, তখন তার ব‍্যবহার করা অন‍্যায় নয়। সেই রাস্তায় হেঁটে নিজের দেশ ভারত থেকে সমস্ত ইতিবাচক সঙ্কেতও পেয়ে যান। একজন ব্যক্তির নামে তাঁর দেশ যেখন সব ইতিবাচক তথ্য দিচ্ছে তখন তাঁকে কেন বিনিয়োগকারী হিসাবে গ্রহণ করবে না অন্য দেশ? ক‍্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসনিক মহল জানাচ্ছে, অনুসন্ধান করার পরে তাঁর সম্বন্ধে কোনও বিরূপ  তথ‍্য দিতে পারেনি মুম্বই পুলিশ। অ্যান্টিগাতে ব‍্যবসা বিস্তার করবেন বলে মোটা অর্থ দিয়ে তবে নাগরিকত্ব নেওয়ার আবেদন করেছিলেন তিনি।

body1_080918063338.jpgমেহুল চোকসি

ভারতে সবচেয়ে বড় জালিয়াতির খবর ২০১৭ সালের মে মাসে কারও জানা ছিল না? সেবি দাবি করেছে, ২০১৪ এবং ২০১৭ তে মেহুল চোকসি ও নীরব মোদীর আর্থিক লেনদেন নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তা হলে ২০১৪ সালের পর ২০১৭ সালে মেহুল ক্লিন চিট পেলেন কী ভাবে? আরও বিস্ময়কর তথ‍্য মিলছে সেবি'র ওয়েব সাইট ঘাঁটলে। সেখানে লেখা আছে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর এস রমণ ১৮ জুলাই ২০১১-এ নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে তদন্ত শুরু করতে। ২৬ অক্টোবর ২০১২য় শোকজ নোটিশ পান মেহুল। ২০১৭ সালের মে মাসে অ্যান্টিগার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। কোনও সরকারি তথ‍্যে বিরোধিতা ছিল না। তাই ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব মেলে মেহুলের। এখন দৌড় ঝাঁপ করে জনতাকে কী বোঝানো হচ্ছে? মেহুল সুপার পাওয়ার সিরিজের নয়া চরিত্র?

‘গীতাঞ্জলি’ নামে গয়নার ব্র্যান্ড সম্বন্ধে দেশের রথী-মহারথীরা জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ‍্য? মানতে কষ্ট হচ্ছে। এমনকি ললিত মোদীর মতো তাঁর আইনজীবীর মাধ‍্যমে মুম্বই কোর্টে মেহুল আবেদন জানিয়েছিলেন (নন বেলেবল ওয়ারেন্ট প্রসঙ্গে), ভারতে এলেই তাঁর প্রাণ সংশয় হতে পারে। 

কলকাতায় বসে প্রায়ই শুনি ইনকাম ট‍্যাক্স রেড চলছে অমুকের অফিসে কিংবা বাড়িতে। ইকনমিকাল অফেন্স শাখা নাকি, সবসময় তৎপর। তা হলে সরকারি এই সব সংস্থার নজরই পড়েনি ৩০০০ কোটি চাকার সোনা-হিরের ব‍্যবসায়ী মেহুলের উপর! মানতে কষ্ট হচ্ছে।

মেহুলের জন্ম বৃত্তান্ত দেখছিলাম উইকিপিডিয়ায়। জন্ম মুম্বইয়ে। পড়াশোনা- গুজরাটের পালানপুরে। জি ডি মোদী কলেজে কমার্স নিয়ে পড়েছেন। তারপর আর চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার জন্য ছোটেননি। অর্থাৎ ব‍্যবসায়ী ঘরের ছেলে ব‍্যবসা করতেই নেমে গিয়েছিলেন। গীতাঞ্জলি  ব্র্যান্ড নাকি দুই বোন গীতা ও অঞ্জলির নামে। এ থেকে বোঝা যায়, পরিবারের প্রতি টান প্রবল।  তাহলে অ্যান্টিগা কেন? কার বা কাদের সাজানো রাস্তাতে তিনি হেঁটেছেন? ব‍্যাঙ্কে তো প্রতি বছর অডিট হয়, কারও নজরে এল না! টাকার অঙ্কও ১৪ হাজার কোটি।

আমাদের দৌড় ঝাঁপ কেন দেরিতে শুরু হয়? লোলিত মোদী, বিজয় মালিয়া (উনি আবার সাংসদও ছিলেন)এখন চোকসি। 

নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্রিকেট সিরিজ কভার করতে গিয়ে ( ২০০৭ সালে) বুঝেছিলাম, প্রশাসনিক স্তরে অর্থ ওদেশে দরকার। পাসপোর্টের জন্য তখন তৎকাল পদ্ধতি ছিল না। জেলায় বাড়ি আমার, তাই পুলিশ সুপারের থেকে প্রশংসাপত্র নিয়ে সাত দিনের মধ‍্যে উড়ে যেতে হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের মেল ছিল সঙ্গে। হার্ড কপিও খান কতক সঙ্গে রেখেছিলাম। ইংল‍্যান্ডে হিথরো বিমানবন্দর থেকে গ‍্যাটউইক এয়ারপোর্ট হয়ে নেমেছিলাম বারবাডোজে। ওখানে আমার অ্যরাইভেল ভিসা নিতে হবে।

অফিসারদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে আড্ডা দিতেই কাজটা সহজ হয়েছিল। ইন্ডিয়া, গাভাসকার, সচিন মানেই আলাদা খাতির। কিন্তু একটা চৌকাঠও সহজে হেলায় টপকে যেতে দেননি কাস্টমস অফিসাররা। অ্যারাইভ‍্যাল ভিসার জন‍্য নির্ধারিত মূল‍্য ধরে দিতে হয়েছিল। ওখান থেকে ঘণ্টাখানেক পরই উড়ে যেতে হয়েছিল জামাইকা। সেখানেও কাস্টমস চেকিং। আবার অ্যারাইভ‍্যাল ভিসা। এ ভাবে, সেন্ট লুসিয়া, ত্রিনিদাদ – এক সাংবাদিক হিসাবে উষ্ণতার ছোঁয়াই পেয়েছিলাম। আর টের পেয়েছিলাম, ফেলো কড়ি মাখো তেল।

body2_080918063436.jpgনীরব মোদী

মেহুলকে এমন দীপপুঞ্জে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্ব নেওয়ার রাস্তা কে বা কারা দেখিয়েছিল? তাঁরা নিশ্চই দেশ ছেড়ে পালাননি। তাঁদের হদিশের খবর কোথায়? 

ব‍্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে আমার বাড়ি, গাড়িও ব‍্যাঙ্কের ঋণ নিয়ে। তার জন‍্য নানান তথ‍্য, ছবি ব‍্যাঙ্কে দিতে হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব‍্যাঙ্ক। আগে নিজের কাগজপত্র নিয়ে দৌড়তে হয়েছে একাধিকবার। এখন তো শুনি, প্রতিনিধি বাড়ি বয়ে এসে কাগজপত্র নিয়ে যায়। ঋণ দিতে পারলে নাকি ব‍্যাঙ্ক ম‍্যানেজারদের পদোন্নতি দ্রুত হয়। এই প্রক্রিয়া যদি সত‍্যি হয়, তাহলে পঞ্জাব ন‍্যাশানাল ব‍্যাঙ্কের কেউ তো জানতেন, মেহুল চোকসির অ্যকাউন্টের আপডেট। কই, তাঁদের নাম তো শোনা যাচ্ছে না! জেমস বন্ডেরও সাপোর্ট স্টাফ লাগে মিশন সাকসেশফুল করতে। মেহুলের সেটাও লাগেনি! এটাও মানতে হবে?

মেহুল যে দোষী তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁকে যাঁরা একটার পর একটা চৌকাঠ টপকে যেতে সাহায‍্য করলেন, তাঁরা আজ ‘সাধু’। তাঁরাই আসল দোষী। কিছুর বিনিময়ে তাঁরা এইসব হস্তিদের সামনে রাখেন, বড় চেহারার আড়ালে সকলে মৌতাত নেন। 

মেহুল ও মালিয়া দু'জনই ব‍্যাঙ্ক স্ক‍্যামের খলনায়ক বলে অভিযুক্ত। আর যাঁরা এঁদের বাড়তে দিলেন, তাঁরা? তাঁদের আগে ধরা উচিত, কড়া শাস্তি দেওয়া উচিত‌ যাতে আরও মেহুল মালিয়ারা বাড়তে না পারেন। সর্ষের মধ‍্যে ভূত ঢুকে থাকলে, ভূতেদের পোয়া বারো। “সত‍্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!”

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

DIPANKAR GUHA DIPANKAR GUHA @dg_1965

The writer is a Senior Sports Journalist

Comment