ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার মঞ্চে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই গেল
যে কোনও মূল্যে বিজেপিকে সরানোর বার্তা জোটের মঞ্চ থেকে
- Total Shares
কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে পরাজিত করতে ফেডারেল ফ্রন্টের নাম বদলে ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’ করে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মমতা যে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের এক মঞ্চে তুললেন, সেখান থেকে একটি বার্তাই সকলে মিলে দিলেন: সংবিধানের মূল ভাব অর্থাৎ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখতে, ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে এবং সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করতে সবার আগে বিজেপিকে কেন্দ্র থেকে সরানো দরকার।
বিজেপি-বিরোধী ইউনাইটেড ফ্রন্ট জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রিত্ব যে কোনও ইস্যু হবে না, কৌশলী ভাবে নিজেদের মধ্যে সেই প্রশ্ন জিইয়ে রাখেন নেতারা। কারণ তাঁরা জানেন, এই জোট টিকিয়ে রাখতে হলে প্রধানমন্ত্রীর নাম আগাম ঘোষণা করা যাবে না। আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেই দেন যে – যে করেই হোক মোদী-শাহ জুটিকে সরাতেই হবে, না হলে কেউ বাঁচবে না, দেশও নয়।
উনিশে জানুয়ারি ব্রিগেডের মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ ভারত। (ছবি: সুবীর হালদার)
জোটের সম্মেলন যে এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, তাও স্পষ্ট করে দেন তেলুগু দেশম পার্টির নেতা তথা অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি জানান পরের সভা হবে অমরাবতীতে। কেজরিওয়াল চান, জোটের তৃতীয় সভাটি হোক তাঁর রাজ্য তথা দেশের রাজধানীর বুকে।
জোটের এই সভায় কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধি আসবে কিনা তা নিয়ে যে তাঁর সন্দেহ ছিল, সে কথা বলেন জনতা দল (সেকুলার) নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া। কিন্তু লোকসভার কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে শুধু আসেনইনি, তিনি সনিয়া গান্ধীর বার্তাও পাঠ করে শোনান। সনিয়া গান্ধী তাঁর বার্তায় বলেন, “২০১৯-এর নির্বাচন কোনও সাধারণ নির্বাচন নয়, এই নির্বাচন গণতন্ত্রে মানুষের আস্থা ফেরানোর নির্বাচন, মোদীর ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার নির্বাচন।” তবে সোনিয়া গান্ধীর বার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছিল না।
মল্লিকার্জুন খাড়গে ও অভিষেক মনু সিংভি উপস্থিত থাকলেও, এ দিনের সভায় প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্রদেশ কংগ্রেস আলাদা করে ব্রিগেড সমাবেশ করবে।
প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন জিইয়ে রাখার সবচেয়ে বড় কারণ হল, এই মঞ্চে যাঁরা ছিলেন বা যাঁদের প্রতিনিধিরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই প্রধানমন্ত্রিত্বের স্বপ্ন দেখেন, এই তালিকায় রয়েছেন ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির প্রবীণ নেতা শরদ পওয়ার এবং তেলুগু দেশম নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু। আবার তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবিদারদের তালিকায় রয়েছেন বহুজন সমাজপার্টির নেত্রী মায়াবতী, তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী।
মঞ্চে সারা দেশকে একত্রিত করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ছবি: সুবীর হালদার)
তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নেতৃত্বের প্রসঙ্গে কোনও নাম না করে সেই প্রশ্নের উত্তর নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে স্থির হবে বলে এড়িয়ে যান। ঐক্যবদ্ধ ভারতে যে নেতার অভাব নেই এবং সকলেই নেতৃত্ব দেওয়ার জায়গায় রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিজেপির পরেই কংগ্রেস দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হওয়ায় কর্নাটক নির্বাচনের সময় রাহুল গান্ধী তাঁর ইচ্ছার কথা প্রকাশও করে ফেলেছিলেন। যদিও পরে জোট রাজনীতির কথা ভেবে চুপ করে যান। তবে তাঁকেই প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসাবে তুলে ধরেন তামিলনাড়ুর দল ডিএমকে-র নেতা এমকে স্ট্যালিন। এ দিনের মঞ্চে স্ট্যালিনও উপস্থিত ছিলেন।
এ দিন মঞ্চে স্ট্যালিন এবং একাধিক কংগ্রেস নেতা উপস্থিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রসঙ্গই তাঁরা কোনও ভাবে উল্লেখ করেননি। তবে ব্রিগেডে উপস্থিত জনতা দীর্ঘক্ষণ প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনার অপেক্ষায় ছিল।
এ রাজ্যে বিহারীদের উদ্দেশে মমতার হাত শক্ত করার করার বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের কথা কথা উল্লেখ করেন বিহারের আরজেডি নেতা তথা লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে তেজস্বী যাদব। তখন উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান।
ব্রিগেডে শেষ বক্তা মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, বাংলার মাটি স্বাধীনতা নবজাগরণের পথা দেখিয়েছিল। বিজেপি সরকারের মেয়াদ ফুরিয়েছে এবং তাদের ক্ষমতাচ্যুতি শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
আঞ্চলিক দলগুলির পাশাপাশি কংগ্রেসও এই জোটে সামিল হওয়ায় ফেডেরাল ফ্রন্টের নাম বদলে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সমাবেশের আগে তিনি ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী সমাবেশে সামিল করেছেন বিজেপির বর্তমান সাংসদ (যিনি তীব্র মোদী-বিরোধী বলে পরিচিত) শত্রুঘ্ন সিনহাকে। তাই এই সমাবেশকে মোদী-বিরোধী সমাবেশ করে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আশা, এই শিবিরে মোদী-বিরোধী মুখের সংখ্যা আরও বাড়বে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্ব হল, একের বিরুদ্ধে এক জন প্রার্থী। যে দল যেখানে শক্তিশালী সেই দল সেখানে প্রার্থী দেবে বিজেপির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই তত্ত্ব বাস্তবায়িত হওয়ার মুখে প্রথম চ্যালেঞ্জ হল উত্তরপ্রদেশ। এখানে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের জোটে কংগ্রেসকে সামিল না করায় ৮০টি আসনের প্রতিটিতেই তারা প্রার্থী দেবে বলে জানিয়েছে কংগ্রেস। জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লা-সহ একাধিক নেতাই জোটের বার্তা দিলেও চন্দ্রবাবু নাইডুই নিজের রাজ্যে এখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যেতে চাইছেন না। তাই এই তত্ত্ব বাস্তবায়িত হবে নাকি কাগজেকলমেই থেকে যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল এই সমাবেশ থেকেই। প্রশ্ন করা যেতে পারে, বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাব দেখানো আদপে জনতাকেই ধোঁকা দেওয়া নয় তো?
ব্রিগেডের জনতা। (ছবি: সুবীর হালদার)
তা ছাড়া সামনেই তো সিপিএমের ডাকে আরও একটা ব্রিগেড হতে চলেছে। আজ যে সব দলের প্রতিনিধি মঞ্চে ছিলেন, সে দিনও সেই সব দলের প্রতিনিধিরা এই মঞ্চে থাকবেন না তো? কেরলের বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নকে আমন্ত্রণ জানালেও দল হিসাবে সিপিএম-কে আমন্ত্রণ জানাননি মমতা। এই মঞ্চে সিপিএমের কোনও প্রতিনিধি ছিলেন না। তাই ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার ছবি কোথায়, সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।