ভারতের কাছে এই চিন-জাপান বন্ধুত্বের অর্থ এবং দক্ষিণ চিনসাগর দ্বন্দ্ব
জাপান জানে যে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায় ভারতই চিনের পাল্টা, তবে চিনের সখ্যও তাদের দরকার
- Total Shares
তারা যখন পরপর তিনটি প্রধান দেশের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হচ্ছে তখন তুলনামূলক হিসাব কষা শুরু হয়ে যাবেই, সেটি অবশ্যম্ভাবী। অক্টোবর মাসের ২৭-২৯ ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী- জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বৈঠক এবং অক্টোবর মাসের ২৫-২৭ ছিল চিনের রাষ্ট্রপ্রধান জাই জিনপিং- ও শিনজো আবের মধ্যে বৈঠক।
উত্তর-পূর্ব ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়ন করছে জাপান (ছবি: রয়টার্স)
ভারত ও চিনের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে এ কথা ধরে নিয়েই বলা যায় যে চিন-জাপান বৈঠক ছিল আরও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
দীর্ঘ প্রতীক্ষারও অবসান ঘটেছে – ২০১১ সালের পরে, এই প্রথমবার সরকারি ভাবে চিনের নেতা জাপানের কোনও নেতার সঙ্গে সরকারি ভাবে বৈঠক করলেন।
২০১৪ সালে বহুদেশীয় মঞ্চে দুই দেশের নেতার যে ছবি দেখা গিয়েছিল তাতে তাঁরা নিয়মরক্ষার জন্য করমর্দন করেছিলেন।
জাইয়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকের পরে আবে জিনিয়ে দিয়েছেন যে দুই দেশের সম্পর্ক এখন এগোচ্ছে “প্রতিযোগিতা থেকে সহাবস্থানেকর দিকে।”
জাই বলেন, বিশ্ব এখন যে ‘অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা’র মধ্য দিয়ে চলেছে সেখানে একযোগে কাজ করার গুরুত্ব কী।
বৈঠকের পরে যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প সংক্রান্ত নীতি নিয়ে সামান্য ধন্ধ রয়েছে।
প্রতিযোগিতা থেকে পারস্পরিক সহাবস্থান (ছবি: রয়টার্স)
চিনের অংশীদারিত্ব
রুটিন মাফিক কয়েকটি ঘোষণা করা এবং ছবির জন্য পোজ দেওয়া ছাড়াও দুই দেশ কয়েকটি বাস্তবোচিত পদক্ষেপ করেছে, যেমন ৩০,০০০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি যেখানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে প্রকৃতপক্ষে জাপানও অংশীদার হয়ে যাচ্ছে এবং তারা যৌথ ভাবে ৫০টি পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্প করবে।
ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত যখন একত্রিত হচ্ছে এবং যেটির ফল চিনের প্রতিকূলে যাচ্ছে সেখানে জাপানের এই ধরনের যোগদানের অর্থ হল বিষয়টিতে উপযুক্ত ভারসাম্য রক্ষিত হওয়া।
প্রকৃতপক্ষে বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যোগদানকারী দেশ জাপানও (ছবি: রয়টার্স)
এই অঞ্চল সম্পর্কে জাপানের বেশ ভালো অভিজ্ঞতা আছে এবং এখনও পর্যন্ত এই অঞ্চলে তারা যে পরিকাঠামো গড়েছে তাকে উপযুক্ত মানের পরিকাঠামো বলা চলে।
চিনের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে গেলে আরও অনেক পরিমাণে ব্যবসা আসবে জাপানি সংস্থাগুলির কাছে, তাতে লাভ জাপানের, যখন আমেরিকা ও চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মধ্যে অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তার জেরে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তখন স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পদক্ষেপ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
তদের এই পারস্পরিক সম্পর্ক অনেকটা শ্রমিকদের সম্পর্কের মতো, বাস্তব পরিস্থিতি ও ব্যক্তিস্বার্থের উপরে জোর দেওয়া। চিন যে পদ্ধতিতে ব্যবসা করে তাতে মোটেই খুশি নয় জাপান ও জাপানের মতো রপ্তানিকারক দেশগুলো, কারণ তারা বিদেশি সংস্থাগুলোর থেকে প্রযুক্তি নিয়ে পুরো অর্থনীতিতেই তাদের ব্যবসায় বন্ধ করে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে।
তবে জাপান ও চিন এখন ৩,৫০,০০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য ও পরিষেবার ব্যবসা করবে এবং মার্কিন নীতি অনুযায়ী তারা যে ভাবে চিনের সাপ্লাই চেনে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করছে তার গভীর ও নেতিবাচক প্রভাব জাপানের উপরে পড়তে পারে।
মার্কিন নীতির বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলে জাপান (ছবি: রয়টার্স)
এ সবরে অর্থ এই নয যে জাপানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শিথিল হচ্ছে।
তারা যেটা করছে তা হল মার্কিন নীতির বাস্তব দিক বিচার করছে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক প্রভাব বিবেচনা করছে, দেখছে কোন ক্ষেত্রে একলা চলো নীতি নিচ্ছে ওয়াশিংটন।
দক্ষিণ চিনসাগর নিয়ে অবশ্য কড়া মনোভাব দেখিয়ে আসছে জাপান, এ বছর সেপ্টেম্বরে সেখানে জাপান শুধুমাত্র হেলিকপ্টার-ক্যারিয়ার নিয়েই মহড়াই করেনি, তাদের মহড়ায় ডুবোজাহাজও ছিল। পরে সেই ডুবোজাহাজটিকে ভিয়েতনামের ক্যাম রান বে-তে নোঙর করে।
দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে এখনও কঠোর অবস্থান নিয়ে রয়েছে টোকিয়ো (দক্ষিণ চিন সাগরে ভিয়েতনাম নিয়ন্ত্রিত দ্বীপের ছবি: রয়টার্স)
ভারতকে সহায়তা
জাপানীদের আরেকটি দিক পরিলক্ষিত হয়েছিল মোদী-আবে বৈঠকে যেটা ঠিক আগের বৈঠকের পরে পরেই হয়েছিল।
নতুন দিল্লির ক্ষেত্রে আবে ক্ষেত্রে যে নীতি নিয়েছেন তা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে তিনি মনে করেন এই ভৌগলিক অঞ্চলে উদীয়মানে চিনের প্রতি-ভারসাম্য রক্ষা করছে ভারতই।
তিনি নরেন্দ্র মোদীর বন্ধু হওয়ার জন্য বাড়তি খানিকটা পথও হেঁটেছেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ভ্যাকেশন হোমে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
এটা ছিল মোদীর তৃতীয় জাপান সফর এবং আবের সঙ্গে দ্বাদশ বৈঠক।
৫জি ফোনের প্রযুক্তি, রোবটিক্স ও কৃত্তিম মেধার প্রসারে ভারত ও জাপান সহমত হয়েছে এই সব ক্ষেত্রগুলো নিয়ে বেজিং এখন সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ।
এ ক্ষেত্রে কাজের ধাঁচটা হল হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে জাপানের যে দক্ষতা রয়েছে এবং সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে ভারতের যে দক্ষতা রয়েছে সেই দুটির মেলবন্ধন ঘটানো।
শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মতো তৃতীয় দেশগুলিতে ভারতের পরিকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্পগুলি নিয়ে জাপানের সঙ্গে চুক্তি চিনকে টক্কর দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন দিল্লির পক্ষে সুবিধা হবে।
সম্পদ তো বটেই দক্ষতার ক্ষেত্রেও যে সমস্যা হচ্ছিল, জাপানের সঙ্গে চুক্তির ফলে এই দুই সমস্যায়ই দূর হবে।
উত্তরপূর্ব ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নে ইতিমধ্যেই যুক্ত হয়েছে জাপান। ভারতকে জাপানি মুদ্রা ইয়েনে অত্যন্ত কম সুদে ৫৩০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ঋণ ইতিমধ্যেই দিয়েছে জাপান।
সমতা বজায়ের উদ্দেশ্য
সাম্প্রতিক বৈঠকে দেখা গিয়েছে যে সামুদ্রিক ক্ষেত্রে আরও বেশি সহযোগিতা করবে ভারত ও জাপান, এই মর্মে একটি চুক্তিও হয়েছে।
জোগান ও পরিষেবার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক অধিগ্রহণ ও পারস্পরিক পরিষেবা প্রদানের ব্যাপারে এখন তারা কথাবার্তা চালাচ্ছে।
নভেম্বর মাসেই দুই দেশ এই প্রথমবারের জন্য জঙ্গি দমনের উদ্দেশে যৌথ সেনা-মহড়া করবে।
দুই দেশের ক্ষেত্রেই এটি একটি সমস্যা। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা সীমায়িকত হলেও বলা যায় যে উচ্চ পর্যায়ের সফর, যৌথ মহড়া প্রভৃতি কার্যকলাপ খুব বড় ব্যাপার।
দুই পক্ষই এ ব্যাপারে বাকসংযম দেখানোর জন্য তা হয়েছে। তবে এ থেকে একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তা হল কৌশলগত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে দুই পক্ষ অসমর্থ।
চিন তাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে গাঁটছড়া বাঁধতে পারে, তবে এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয় যে কী পরিস্থিতিতে ও শর্তে তারা সহযোগিতা করবে। মার্কিনদের সঙ্গে তাদের যে সমঝোতা আছে তা নিয়ে জাপান বেশ স্বচ্ছন্দ উল্টোদিকে এ ব্যাপারে কারও সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারে ভারত যথেষ্ট সাবধানী।
(সৌজন্য: মেল টুডে)
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে