বারো বছর পরেও দেশের একটি রাজ্যেও স্টেট সিকিউরিটি কমিশন গঠন করা হয়নি

পুলিশের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে এই কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট

 |  4-minute read |   11-04-2018
  • Total Shares

সুস্থ গণতন্ত্রের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। যার মধ্যে প্রথম শর্তই হল জনগণকে নিজেদের ইচ্ছে মতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া। কিন্তু তা আর হচ্ছে কোথায়? নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোর করে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দিচ্ছেন। ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দিচ্ছেন না ভাবখানা এমন, গণতন্ত্র চুলোয় যাক, আরও পাঁচ বছরের জন্য নিজেদের গদিটা নিশ্চিত করি।

এ ধরণের পরিস্থিতিতে আইনরক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁরাও তো আমার আপনার মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁদেরও তো নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর (কখনও কখনও বিরোধী দলগুলোরও) চোখ রাঙানি থেকে আইনরক্ষকরাও বাদ যান না। তাঁদের বিরুদ্ধেও নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। তাই 'নিজের ভালো' বুঝতে এদেরকেও সব মেনে নিতে হয়, কখনও কখনও ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই।

ভারতীয় রাজনীতির এই বিপজ্জনক প্রবণতার আমদানি খুব সম্ভত সত্তরের দশকে, ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালে। সেই সময় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। চলেছিল আমজনতা বা বিরোধী রাজনীতির উপর নির্মম অত্যাচার। সব মিলিয়ে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে টালমাটাল পরিস্থিতি। এর ফল স্বরূপ ১৯৭৯ সালে পুলিশ রিফর্ম কমিটি গঠন করা হয়। মূলত, চাপের মুখে বাধ্য হয়ে যে পুলিশকর্মী দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়ছেন, সেই সব পুলিশকর্মীকে কী ভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায় বা তাঁদের কী ভাবে আইন রক্ষা করতে বাধ্য করা যায়, তার উপায় বের করতে এই কমিটির প্রস্তাবনা। কমিটির পোশাকি নাম ছিল ধর্মবীর কমিটি।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল - তিন বছর ধরে কাজ করে এই কমিটি এবং ১৯৮২ সালে এই কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে আবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে কংগ্রেস। তাই এই রিপোর্টে সুপারিশ করা পদক্ষেপগুলোর আর দিনের আলো দেখা হল না।

body_041118020050.jpgশাসক দল ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে দিচ্ছে না [ছবি: পিটিআই]

এর ১৪ বছর পর এই বিষয়টি নিয়ে আবার নড়াচড়া শুরু হল। দুই প্রাক্তন আইপিএস অফিসার এন কে সিং এবং প্রকাশ সিং জনস্বার্থ মামলা করলেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিলেন। এই কমিটিগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০৬ সালে শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে একটি ১০-দফা নির্দেশিকা জারি করা হল।

এই রিপোর্টেও মেনে নেওয়া হয়েছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো বা রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনওরকম আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে এবং সব জেনে শুনেও পুলিশ প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সুপ্রিম কোর্টের এই ১০ দফা নির্দেশিকার মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ নির্দেশ ছিল যে, প্রতিটি রাজ্যে একটি করে স্টেট সিকিউরিটি কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের নেতৃত্বে থাকবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নিরাপত্তা-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এই কমিশনের সদস্য হবেন। এ ছাড়াও, কয়েকজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কয়েকজন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকেও এই কমিশনের সদস্য করতে হবে। কমিশনের প্রাথমিক কর্তব্য - পুলিশের ভূমিকার মূল্যায়ন করা।

এর পর ১২ বছর কেটে গিয়েছে। অথচ দেশের একটি রাজ্যেও এই কমিটি গঠন করা হয়নি।

২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশিকার পরে পাঁচ বছর বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার কোনওদিনও এই কমিটি গঠনের চেষ্টা করেনি। ২০১১ তে তৃণমূল এল। যা মনে করা হয়েছিল তাই-ই হল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও গত ৮ বছরে এই কমিটি গঠনের প্রয়োজন মনে করেনি।

পুলিশের কাজের মূল্যায়ন করলে পুলিশ যদি আইন মেনে কাজ করে তাহলে শাসক দল বিপদে পড়তে পারে। তাই উল্টে পুলিশকে ভয় দেখিয়ে যদি তাদের অঙ্গুলিহেলনে পুলিশকে চালানো যায় তাতে লাভ বেশি।

শেষ বিধানসভা নির্বাচনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে একেবারে শেষ লগ্নে কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে সরানো হল। নতুন কমিশনার দায়িত্ব পেয়েই 'ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন' করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। বেশ কয়েকজন আইপিএস অফিসার ও পুলিশকর্মী তাঁকে যোগ্য সহায়তা করলেন। সংবাদমাধ্যমে পুলিশের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করা হল। সাধারণ ভোটাররাও পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন।

কিন্তু পুলিশের লাভের লাভ কী হল? ভোটে জিতে সরকার গঠন করে পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিতে শুরু করে দিল তৃণমূল। কয়েকজন আইপিএস অফিসারদের মাসের পর মাস কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে (সাময়িক বরখাস্ত বলতে পারেন) পাঠানো হয়েছিল। কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে যা কোনওদিনও হয়নি, তাই হল। বেশ কয়েকজন ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টরকে জেলায় বদলি করে দেওয়া হল। কলকাতা পুলিশের আইন অনুযায়ী কলকাতা পুলিশের আধিকারিকদের জেলায় বদলি করা যায় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আপৎকালীন অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে তাঁদের ডেপুটেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পঞ্চায়েত ভোটে তাই রাজ্য পুলিশের আধিকারিকরা আর শাসক দলের বিরুদ্ধে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে গোটা রাজ্য জুড়ে অরাজকতা চলছে। রাজ্যের দুই বর্ষীয়ান বিরোধী নেতা বাসুদেব আচারিয়া ও রামচন্দ্র ডোম শাসক দলের কর্মীদের হাতে প্রহৃত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। গণতন্ত্র ধ্বংসের এর চাইতে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আর কী হতে পারে? গোটা রাজ্য জুড়ে অস্ত্রহাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিকদলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি বা চিত্রগ্রাহকদেরও কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। খাস কলকাতাতে তো এক চিত্রসাংবাদিককে নগ্ন করে নিগ্রহ করা হয়েছে।

পুলিশ বা সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা তো পথে নেমে কাজ করেন। কিন্তু রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকদেরও তো একই অবস্থা। তাঁরা যে খুব নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছেন তা কখনওই বলা যাবে।

সোমেন মিত্র পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন মীরা পান্ডে। রাজ্য তথা দেশের এখন হাজারও সোমেন-মীরার প্ৰয়োজন।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

Sandhi Mukherjee Sandhi Mukherjee

The writer is a former IPS officer.

Comment