পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সিন্ডিকেট রাজ ফাঁস ইন্ডিয়া টিভির ক্যামেরায়

দলের নেতাদেরও ছাড় দেয় না সিন্ডিকেট রাজ

 |  5-minute read |   31-08-2018
  • Total Shares

তৃণমূল কংগ্রেস অফিসে জরুরি বৈঠকে দলের বরিষ্ঠ নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে সিন্ডিকেট নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে টিভি টুডের গোপন ক্যামেরায় করা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে রাজ্যের শাসকদল ও সরকারি আধিকারিকদের ষড়যন্ত্র – এই অনুসন্ধান শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কাজকর্ম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েই দিল না, এবাং মুখ রক্ষা করতে যুক্তি খুঁজতে হবে রাজ্যের শাসকদলকে।

কিছুদিন আগে এ রাজ্যে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে সিন্ডিকেট রাজ নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, সেই অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে টিভি টুডে নেটওয়ার্কের স্টিং অপারেশনে। এই অপারেশনের পরেই তৃণমূলের যে সব নেতারা সরকারি প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের সরবরাহের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত তাদের নিয়ে গভীর রাতে উত্তর ২৪ পরগনা ও দমদমে জরুরি বৈঠক বসে।

রিয়েল এস্টেস থেকে দুর্গাপুজো – এই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তৃণমূল কাউন্সিলর, তৃণমূল সদস্য ও সরকারি আধিকারিকদের বদান্যতায় কী ভাবে এই সিন্ডিকেট রাজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। এই সব গোষ্ঠীই জমি-বাড়ি কেনাবেচা, নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে যদি কোনও ক্রেতা ন্যায়বিচার চাইতে যান, তা হলে এই গোষ্ঠী তাঁকে ধনেপ্রাণে শেষ করে দেয়।

বেশ কিছুদিন ধরেই ইন্ডিয়া টুডের দু’জন সাংবাদিক এই স্টিং অপারেশন করছিলেন, তাঁদের গোপন ক্যামেরাতেই ধরা পড়েছে একজন কাউন্সিলর, অন্য একজন কাউন্সিলরের স্বামী, একজন সরকারি আধিকারিক ও একজন সিন্ডিকেট সদস্যের কথা, যেখানে তাঁরা বলছেন কী ভাবে এই সিন্ডিকেটের কাজ চলে, কী ভাবে ব্যবসায়ীদের থেকে জুলুমবাজি করে টাকা আদায় করা হয়।

ব্যাবসায়ী সেজে যখন টিভি টুডের সাংবাদিক কথা বলছিলেন বিধাননগরের তৃণমূল কাউন্সিলর স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বামী সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখন তিনি বিশ্রী ভাবেই বলেন, “যদি প্রতিবাদ করতে যান তা হলে ভুগবেন, ওরা দেখে নেবে। ওরা ভয়ঙ্কর লোক। ওদের নেতা হল রাজ্যের একজন বড় নেতা। উনি বিধায়কও হয়ে যেতে পারেন। উনি সব তছনছ করে দেবেন। হয় ব্যবসা বন্ধ করে দিন, না হলে ১০ লাখ টাকা দিন।” একটি রেস্তোরাঁ খোলা কথার মধ্যে পুলিশ কেন কিছু করবে না, এই প্রশ্ন করতেই তিনি কথাগুলো বলেন, এক কথায় উত্তরটা ছিল – পেশীশক্তি ও সিন্ডিকেট-রাজ।

রানা বসু নামে সিন্ডিকেটের একজনের সঙ্গে সৌমেন ছিলেন, তাঁরা সাংবাদিকের থেকে চার লক্ষ টাকা দাবি করেন। “আমি তো আপনাকে বলেইছি যে একবারই মাত্র টাকাটা দিতে হবে। আমার ওয়ার্ডে নয়, ও (রানা) অন্য একটা ওয়ার্ডে দুর্গাপুজোর আয়োজন করছে, সেটা দেখুন। ব্যস এটুকুই। ওকে ২৫,০০০ টাকা দিয়ে আলোচনা এখানেই বন্ধ করুন।”

যখন কাউন্সিলর স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই সাংবাদিক কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তাঁর স্বামী সৌমেন বলেন, “একই পরিবারের ব্যাপার তো, ও কী করবে? যা বলার আমাকে বলুন। একই ব্যাপার।”

এই সিন্ডিকেট সরল একটি দমনপীড়ন নীতিতে বিশ্বাস করে – “হয় টাকা দাও না হলে ভোগান্তি সহ্য কর” – পশ্চিমবঙ্গ যেন এখন জঙ্গলের রাজত্ব!

এই রোগ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।

 

didi_083018031858_083118011353.jpgতৃণমূল কাউন্সিলর, নেতা ও সরকারি আধিকারিকদের বদান্যতায় এখন রাজ্যজুড়ে চলছে সিন্ডিকেটরাজ (ছবি: ইন্ডিয়া টুডে)

তৃণমূল কর্মী সুশান্ত দাস আবার ক্যামেরার সামনে বড়াই করে বলছিলেন “পুরো দলটাই আমদের, সব নেতাই আমাদের সঙ্গে আছে।” দমদমের তৃণমূল কাউন্সিলর বিধান বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সুশান্ত দাস শাসানি দিয়ে বলেন, “অন্য কারও মাধ্যমে জমি কিনলে যা করার আমরা করে নেব।”

কোনওরকম রাখঢাক না করেই সুশান্ত বড়াই করে বলেন, “এটা (উত্তর দমদম) আমাদের এলাকা। আমরাই সবই দেখে নেব – চেয়ারম্যান থেকে কাউন্সিলর, বাড়ির প্ল্যান সবকিছুই। কোনও কিছু নিয়েই আপনাকে ভাবতে হবে না।” কথা হচ্ছিল জমি কিনতে চাইলে উনি কী ভাবে সাহায্য করবেন তা নিয়ে।

স্টিং অপারেশনে দেখা গেল যে এইসব সিন্ডিকেটগুলো সেই বস্তাপচা গোপন ডেরা থেকে পরিচালিত হয় না, তারা আধিকারিকদের মদতে খুল্লমখুল্লা ভাবে তাদের কাজ করে যায়।

শোনা যাচ্ছে যে দলের উপরমহল থেকে এই সব লোকজনকে কিছুদিনের জন্য একেবারে চুপচাপ থাকতে বলা হয়েছে এবং লোকজনের সঙ্গে আপাতত মেলামেশা করতেও নিষেধ করা হয়েছে। গণমাধ্যম তো নয়ই, অন্য কোনও ব্যাপার নিয়েও কোনও কথা বলতে তাঁদের নিষেধ করা হয়েছে।

পানিহাটির তৃণমূল বিধায়ক নির্মল ঘোষ বলেন, “আমাদের দলের নেত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন যে দলের কেউই যেন এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত না থাকে তা সে লোকাল হোক বা সেন্ট্রাল। আমি এ সব কথায় বিশ্বাসই করি না আর কোথাও কোনও অভিযোগ দায়ের হলে আমরা তা খতিয়ে দেখব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করব।”

ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা চন্দ্রকুমার বসু টিভি টুডেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, “আগের মতোই এখনও পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট রয়েছে, তবে তা ছিল অসংগঠিত ভাবে। এখন তারা সংগঠিত ভাবে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী না হয়ে সিন্ডিকেট রাজের প্রধান হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”

সিন্ডিকেটের এই থাবা থেকে তৃণমূলের নেতারাও বাদ পড়েন না। চন্দ্রকুমার বসু বলেন, “আমার খুড়তুতো ভাই সুগত বসু নিজে যাদবপুর কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেল সাংসদ, সেও বাদ পড়েনি। আমার কাকিমা কৃষ্ণা বসুর বয়স এখন ৯০ বছর, তাঁর উপরেও চড়াও হয়েছিল। তাঁদের পুরো পরিবারকেই হুমকি দেওয়া হয়েছিল যে ওদের থেকে নির্মাণসামগ্রী না কিনলে বাড়ি সারাতে দেওয়া হবে না। এখন তৃণমূল নেতারা (ক্যামেরার সামনে) স্বীকার করছে যে সিন্ডিকেট রাজ রয়েছে।”

সিপিআই নেতা দীনেশ বর্ষনি মনে করেন, যদি একটি দলের মধ্য থেকে কেউ জানতে চায় যে কত টাকা তিনি দিতে পারবেন, তার মানে ধরেই নিতে হবে যে জুলুমবাজি রয়েছে। তিনি বলেন, “যেখানে এ রকম জোরজুলুম চলছে তার পিছনে রাজনৈতিক মদত রয়েছে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোমনাথ সিংহরায় অবশ্য পুরো ব্যাপারটাকেই নস্যাৎ করে দিয়ে একে “তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা (বন্দ্যোপাধ্যায়)কে অপদস্থ করার চেষ্টা বলে মনে করছেন।” তিনি বলেন, “যাদের দেখা যাচ্ছে (ইন্ডিয়া টুডে টিভি তদন্তে) তারা কেউই তৃণমূল নেতা নয়। সারা পৃথিবীতেই জমি-বাড়ির দালাল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন কী আছে? যদি কয়েকজন যুবক ইট-বালি সরবরাহ করতে চায় তাতে কার কী ক্ষতি হচ্ছে?

সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি উল্টে এই প্রকাশিত ছবিতে যাদের দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও রকম পদক্ষেপ করার ব্যাপারে তৃণমূলের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে এখন সিন্ডিকেট রয়েছে, এই বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য আমি টিভি টুডেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। যারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে তৃণমূলের কতটা সদিচ্ছা আছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। এটাই তৃণমূলের বৈশিষ্ট্য, যারা এর সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার ব্যাপারে তৃণমূলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।”

এই পুরো ব্যাপারটি প্রকাশিত হওয়ায় তৃণমূল নেতৃত্ব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে। যারা এলই রাজ্যের উন্নতিসাধনের জন্য কাজ করতে চাইছে তারাই এখন ভুক্তভোগী। যতদিন পশ্চিমবঙ্গে এই সিন্ডিকেটরাজ থাকবে, ততদিন উন্নয়নে দেওয়ালে মাথা খুঁড়বে।

(তথ্য সহায়তা: ইন্ডিয়া টুডের স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের সদস্য অমিত কুমার চৌধরী)

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MANOGYA LOIWAL MANOGYA LOIWAL @manogyaloiwal

Deputy Editor, AAJ TAK

Comment