পঞ্চায়েতে সন্ত্রাস ছাপ ফেলবে জাতীয় স্তরে মমতার ভাবমূর্তিতে
বিজেপি বিরোধী যে শিবির মমতার উত্থানের আশায়, তাঁরা আশাহত হবেন
- Total Shares
গত ১৬ এপ্রিল ঝাড়খণ্ডে নগর নিগমের নির্বাচন (পুর নির্বাচন) হয়েছে। আমরা কী চাই কেউ জানতে পেরেছি? গত দু’বছরে ওড়িশা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র বা গুজরাটে হয় পঞ্চায়েত না হয় নগর নিগমের নির্বাচন হয়েছে। আমরা কি জানতে পেরেছি? হ্যাঁ পেরেছি। কখন পেরছি? যখন ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। তাও আবার নিজ নিজ স্বার্থে সেই যখন বিভিন্ন পক্ষ সেই ফলাফল সামাজিক মাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাংলা পঞ্চায়েত নির্বাচন এখন সারা ভারতে প্রচারিত, আলোচিত বা সমালোচিত।
এটা তো আমাদের গর্বের বিষয় হওয়া উচিৎ। তা হলে এত উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হচ্ছে কেন? উৎকণ্ঠার কারণ আছে। বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন সারা দেশে বাঁকা ভাবে আলোচিত হচ্ছে তার সন্ত্রাসের জন্য, আদালত কক্ষে খণ্ডযুদ্ধের জন্য। এটা রাজ্যের পক্ষে নেহাত অপমানজনক। রাজ্য মানে কী? মানে এক দিকে রাজ্যবাসী এবং অন্যদিকে রাজ্যের শাসনের শীর্ষে থাকা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যবাসী মানে একটা সমষ্টিগত আধার। ওরা এই অপমান নিজগুণে এবং নিজের তাগিদে মোকাবিলা করার পথ খুঁজে নেবে। কিন্তু মমতা? নির্বাচনের মতো একটা সন্ধিক্ষণে তাঁর গায়ে কালির ছিটে লেগে চলেছে। তাঁকে এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের রাস্তা খুঁজতে হবে।
বেঙ্গালুরু, পুনে, আমেদাবাদ, ইন্দোর, মুম্বই, রাঁচি, জামসেদপুর – দেশের শহরে শহরে মোদী-বিরোধী রাজনীতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক মানসিকতায় চর্চিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা। সেই আলোচনায় চোনা ফেলেছে পঞ্চায়েতের কলঙ্ক। মমতার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি সে কথা অনুভব করছে?
বদলা নয় বদল চাই সারা দেশে সমাদৃত হয়েছে, মমতার ভাবমূর্তি তুঙ্গে উঠেছে
যে কোনও নির্বাচনই হার-জিতের নির্বাচন। প্রশ্নটা হচ্ছে, কখন একটা প্রতিপক্ষের মনঃস্তত্ত্বে হারের আতঙ্ক চেপে বসে। সন্ত্রাস কি শুধু হারের আতঙ্কে নাকি জেতার নেশায়? এটা বোঝা মুশকিল যে তৃণমূল কংগ্রেস যে বাতাবরণ তৈরি করেছে তা হারের আতঙ্কে নাকি জেতার নেশায়? কিন্তু মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি অনেক অনেক বড় মাপের এবং সেখানে সন্ত্রাসের কলঙ্ক তাঁকে বেশ কিছুটা পিছনে ঠেলে দিয়েছে, গত পনেরো দিনে। আবার এটা ঠিক যে অনুব্রত মণ্ডলদের মতো সৈনিকরা মমতার বৃহত্তর রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক একটা স্তম্ভ। কিন্তু লড়াইয়ের পরিসর যখন দেশব্যাপী তখন কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা ঠিক করতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই।
রাজ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। সন্ত্রাস তাই হারের আতঙ্ক বা জেতার নেশার নয়, এটা বাংলার রাজনীতির চারিত্রিক বিপর্যয়ের কারণেই। আর এই ফাঁসে আবদ্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের শক্তি অটুট রেখে জাতীয় রাজনীতিতে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে মমতাকেই এই সন্ত্রাসের পাঁক থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে দেওয়ার কেউ নেই, গড়তে হলে নিজেদেরই গড়তে হবে, কিন্তু চুরমার হতে সময় লাগবে না এক মুহূর্তও।
বদলা নয়, বদল চাই – মমতার এই স্লোগান ছিল ঐতিহাসিক। ৩৪ বছর শাসনের পরে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে যে জনরোষ পুঞ্জীভূত ছিল, তা একটু উস্কানি পেলে দাবানলে পরিণত হতে পারত। কিন্তু তারপর যত সময় গেছে, তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন যত সুসংহত হয়েছে, ততই যেন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। বদলা নয় বদল চাই সারা দেশে সমাদৃত হয়েছে, মমতার ভাবমূর্তি তুঙ্গে উঠেছে। তারপরে যতবারই স্থানীয় নির্বাচন এসেছে, মমতার সেই ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে। ভাবমূর্তির প্রশ্নে স্ববিরোধিতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজেপি-বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতির একটা বড় অংশ মমতার উত্থানের আশায় দিন গুনছে। সন্ত্রাসের মতো একটা এঁধো গলিতে যদি মমতা পথভ্রষ্ট হয়ে যান, তা হলে ভারতের একটা বড় অংশের জনমানস আশাহত হবে। তাই সারা দেশ অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের গতিপ্রকৃ্তির দিকে নজর রাখছে। সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন মমতাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। সন্ত্রাসদীর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন সন্দেহের উদ্রেক করবে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মমতার প্রশংসাকারীদের মধ্যে।