ভোটে জিতলেও ত্রিপুরার সংস্কৃতি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি বিজেপি
এই প্রথম পুরোপুরি একটি দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে পুরোপুরি বামপন্থী দলের সরাসরি লড়াই হল
- Total Shares
ত্রিপুরার নির্বাচনে যে বিজেপি সিপিএমকে পরাজিত করেছে তা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, আর বোধহয় কিছু না বললেও চলে।
এই প্রথম পুরোপুরি একটি দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে বামপন্থী দলের সরাসরি লড়াই হল। ত্রিপুরায় যে সিপিএম হেরে যাবে সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বিজেপি আর সিপিএম-দু'দলের ভোটের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোন 'পুরোপুরি দক্ষিণপন্থী' দল (Centre-Right) আর একটি 'পুরোপুরি বামপন্থী' (Centre-Left) দলকে এ ভাবে পরাজিত করেছে। লড়াইটা ছিল এক্কেবারে হাডাহাড্ডি।
ত্রিপুরায় বামেদের এবং অন্যান্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উদারনৈতিক শক্তিকে একেবারে ধরাশায়ী করে দিয়েছে বিজেপি। ত্রিপুরায় বিজেপির এই জয় হয়ত অনেক কিছু পরিষ্কার করে দেবে।
'আন্ডার নরেন্দ্র মোদী ইন্ডিয়াস রাইট ইস ফাইনালি উইনিং দা কালচারাল ওয়ার' এই হেডলাইনে দিয়ে একটি প্রতিবেদন দা ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির লিখেছিলেন বরখা দত্ত। বরখা দত্তের লেখা এই প্রতিবেদনটি তখন অনেকের নজর কেড়ে ছিল, কারণ নানা সময় তিনি বামেদের হয়ে কথা বলেছেন।
সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাট
ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের কথা বলতে গিয়ে বরখা দত্ত বলেন, “ভোট দেওয়ার সময় সাধারণ মানুষ খুব নিশ্চিত ছিলেন যে তারা এ বারের নির্বাচনে কাকে তাঁর ভোটটা দেবেন। তাই এই জয়টা দক্ষিণপন্থী দলের কাছে খুবই মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ। শুধুমাত্র ব্যালট বক্সে নয় দক্ষিণপন্থীরা ওখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও স্থানীয় মানুষের মন জয় করেছে"
আসলে ত্রিপুরায় বিজেপি শুধুই ভোটের সংখ্যার দিক দিয়ে বামকে পরাজিত করতে পেরেছে। বিজেপি কিন্তু এখনও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ওখানকার মানুষের মনে তেমন ভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। ত্রিপুরার খুব অল্প সংখ্যক জায়গায় বামেদের সরিয়ে মানুষের মনে নিজেদের জায়গা করে নিতে পেরেছে। ত্রিপুরায় নির্বাচনের জয়ের সমীকরণটা বাকি দেশের তুলনায় বেশ আলাদা। ভারত বিশাল দেশ। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও দেশ বিশাল বিরাট। বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের সমন্বয়ে ঘটেছে আমাদের দেশে। তাই যদি কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল মনে করে যে এ হেন বিরাট ও বৈচিত্র্যময় দেশকে তারা শুধু একটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক আবেগে বেঁধে ফেলবে, তা হলে তা সম্ভব নয়।
ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যে উত্তেজনা ও বিতর্কের ঝড় সারা দেশে বয়ে গেল, তা কিন্তু বিজেপির রাজনৈতিক আদর্শের পক্ষে একেবারে ভালো কথা নয়। সাধারণ মানুষ বিজেপিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে যদি বিজেপি মনে করে থাকে যে তারা সারা ভারতে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে কায়েম করবে তাহলে তারা মস্ত ভুল করছে।
মূর্তি ধ্বংসে যে বিজেপির কোনও রকম ভূমিকা নেই সেটা দল তড়িঘড়ি জানিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, দলের সভাপতি অমিত শাহ এই পুরো ব্যাপারটার এমন ভাবে বিরোধিতা করলেন যেন একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার হয়ে গেল, সেটা হল সংখ্যার দিক থেকে ভোটে জিতলেও ত্রিপুরার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জমি অধিকারের লড়াইতে বিজেপি কিন্তু এখনও জয়ী হতে পারেনি।
ত্রিপুরায় দলের সাধারণ সম্পাদক হলেন রাম মাধব। ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের প্রধান কাণ্ডারী তিনি ছিলেন। তিনিও ভেবেছিলেন যে ওখানকার মানুষের ভাবাদর্শকে দল বোধহয় তাঁদের মতো করে গড়ে নিতে পেরেছেন, কিন্তু তিনি ভুল প্রমাণিত হলেন।
কেউ কি কোন দিন ভাবতে পেরেছিল যে বিজেপির মতো একটি জাতীয় দল ত্রিপুরায় লেনিনের মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে বলে আগেভাগেই নিজেদের পিঠ বাঁচাবার চেষ্টা করবে? কারণ পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরার বাইরে লেনিনের মূর্তি ধ্বংস করার সঙ্গে নির্বাচনের তেমন একটা যোগ নেই। তা ছাড়া লেনিনের মূর্তি ধ্বংসে বামেদের আবেগে আঘাত লাগার কথা।
ঠিক মনে পড়ছে না শেষ কবে মোদী এত দ্রুত ও সতর্কতার সঙ্গে কোনও ঘটনার এ ভাবে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন? দেশজুড়ে গোহত্যা মহা পাপ বলে হইচই এবং একই সঙ্গে মুসলমান হত্যা এবং দলিতদের বিরুদ্ধে নানা অবিচার চলছিল তখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাস পার হয়ে গেলেও মোদী কোথাও কোনও কথা বলেলন না কেন?
এরপর বিজেপির আর এক নেতা এইচ রাজা যখন তামিলনাড়ুর নেতা ইভিআর রামস্বামীর (যিনি পেরিয়ার নামেই সমধিক পরিচিত) মূর্তি ভাঙার কথা বললেন তখন নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ দলকে এই ধরনের মন্তব্য না করার জন্য সতর্ক করে দিলেন।
মানিক সরকার
বিজেপির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দর্শন এবং পেরিয়ারের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দর্শন দুই ভিন্ন মেরুর। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন না, ভগবান রামের পুজো অন্যান্য দেবী-দেবতার মূর্তি পুজোতেও তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের তৈরি করা বিভিন্ন সামাজিক নিয়ম তিনি কোনও দিন মেনে নেননি। তাই তাঁর মূর্তি ভাঙায় বোধহয় আরএসএস একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
তামিলনাডুতে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট পেরিয়ারের মূর্তি ধ্বংসের বিরোধিতা করে বিজেপির বিরুদ্ধে স্বরব হয়। তারপরে বিভিন্ন এলাকায় ব্রাহ্মণদের উপর হামলা করা হয়, তাতে বিজেপিও চমকে ওঠে। বিজেপি ভুলে গিয়েছিল যে তামিলনাড়ুতে স্থানীয় দলগুলো বেশি প্রভাবশালী। তা ছাড়া আরএসএস এবং বিজেপির সাংস্কৃতিক চিন্তাধারার সঙ্গে এখানকার চিন্তাধারার কোনও মিল নেই।ত্রিপুরায় বিজেপির জয়ের আর একটা কারণ হল, ওখানে সিপিএমর জোরদার প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে একমাত্র কংগ্রেসই ছিল, কিন্তু দলটি এখন ওখানে এক রকম মুছে গেছে বললেই চলে।
২০১৩ সালে কংগ্রেস বিধায়কের সংখ্যা ছিল ১০, এখন সেই সংখ্যা শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালে ভোট ভাগাভাগিতে কংগ্রেস ৩৬.৫ শতাংশ ভোট পেলেও, ২০১৮তে সংখ্যাটি ১.৮ এ এসে ঠেকেছে। ত্রিপুরায় বিজেপি সামাজিক ভাবে, সাংস্কৃতিক ভাবে ও রাজনৈতিক ভাবে আগের কংগ্রেসের চেয়ে তেমন একটা আলাদা নয়। বিজেপিও হয়ত তার বিরোধীদের মতো ভুল করে ফেলেছে। যে সব রাজ্যে তাদের কোনও রকম উপস্থিতি নেই সেই সব রাজ্যেই আগে তাদের ভিত গড়তে বোধহয় বেশি মনোনিবেশ করা উচিত ছিল তাদের।
ত্রিপুরায় বিজেপির হয়ে এমন ১৪জন প্রার্থী ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন যাঁরা প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক। এঁদের মধ্যে দুজন ছাড়া আর সকলেই জিতেছেন। নির্বাচনের সময় কংগ্রেস থেকে সাতজন বিধায়ক দল ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। পরে অবশ্য দেখা যায় মোটামুটি সকলেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সিপিএম থেকেও কয়েকজন গিয়েছিলেন, যদিও তাঁদের মধ্য থেকে মাত্র একজন জেতেন।
পশ্চিমবঙ্গেও মানুষ বামদের বিকল্প হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছিলেন। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভোটগুলোও তৃণমূলের দিকেই গিয়েছিল। ত্রিপুরায় বিজেপির জয় হয়েছে, তবে তারা আগের কংগ্রেসের থেকে কোন ভাবেই তেমন একটা আলাদা হতে পারল না। ওখানকার মানুষের মনে তারা জায়গায় করে নিতে পারেনি।
বিজেপি ত্রিপুরায় ভোটের লড়াই জিতলেও, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক লড়াইতে এখনও তারা অনেক পিছিয়ে। ওখানে বিজেপি কংগ্রেসের নামান্তর মাত্র। মোদী মুখে যতই বলুন না কেন তিনি ভারতকে কংগ্রেস-মুক্ত করবেন কিন্তু আসলে তিনি কংগ্রেস মতোই আচরণ করছেন।