পাকিস্তানের সেনাবাহিনী-জিহাদি আঁতাত বন্ধ করতে এবার উঠে পড়ে নামতে হবে ভারতকে

দেশে ফিরেছেন অভিনন্দন, এখন আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে আসা উচিত হবে না ভারতের

 |  5-minute read |   05-03-2019
  • Total Shares

ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের মুক্তি বেশ কয়েকটি ইস্যু প্রকাশ্যে তুলে ধরল।

প্রথমত, বন্দি অবস্থায় এই উইং কমান্ডারের আচরণ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে মিগ-২১ যুদ্ধবিমান থেকে ইজেক্ট করার পর এক দল পাকিস্তানী জনতা তাঁর উপর চড়াও হয়। এর ফলে তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু আহত হওয়ার পরেও তিনি যে অনবদ্য পেশাদারিত্বের পরিচয় দিলেন, তা একজন ভারতীয় বায়ুসেনার আধিকারিকের কাছে আমরা সকলেই আশা করে থাকি।

body_030519122135.jpgবন্দি অবস্থায় উইং কমান্ডারের অভিনন্দনের আচরণ নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন [সৌজন্যে: ইন্ডিয়া টুডে টিভি]

দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান যে ভাবে কোনও শর্ত ছাড়াই তাঁকে মুক্তি দিল তা ভারতের পুরুষালী কূটনৈতিক জয় বলেই ধরে নিতে হবে - শুধুমাত্র পশ্চিমী শক্তিগুলোর কাছে নয়, পাকিস্তানের দুই প্রিয় 'বন্ধু রাষ্ট্র' চিন ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধেও।

এই বিষয়টি ভারতের বিদেশ নীতির পক্ষে অত্যন্ত সুখকর যা অতীতে বেশ ফ্যাকাসে ও অনুপযোগী ছিল। সেই দিনগুলো আমরা পার করে এসেছি। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ভারতের বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া ওঠার কথা স্বাভাবিক ভাবেই এখন সকলে স্বীকার করে নিয়েছে।

তৃতীয়ত, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে (এই অঞ্চল থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রাদেশিক নির্বাচন জিতে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন) ছ'একর জমির উপর অবস্থিত জৈশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি ঘাঁটি গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভারত যে সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিল তার থেকে পাকিস্তানকে একটা বার্তা দেওয়া গেল - জঙ্গিদের মদত দিলে কড়া মাসুল দিতে হবে।

মোটামুটি ৩৫০জন জঙ্গির থাকার সুবিধাযুক্ত একটি শিবিরকে ধ্বংস করে দিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনা নিজেদের ক্ষমতার পরিচয় দিল। বায়ুসেনার যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা গত দু'দশক ধরে পরীক্ষিত ছিল না। কিন্তু মিগ-২১ বিমান চেপে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান যে ভাবে একটি আধুনিক ও অনেক বেশি শক্তিশালী এফ-১৬ যুদ্ধবিমানকে পরাস্ত করলেন, তাতে নতুন করে ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেল।

body1_030519122407.jpgপাকিস্তানের সেনাবাহিনী হাফিজ সঈদের মতো জঙ্গিদের ছায়া যুদ্ধে পাঠায় [ছবি: রয়টার্স]

মুম্বাইয়ের ২৬/১১ জঙ্গিহামলার পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছেও পাকিস্তানে অবস্থিত লস্কর-ই-তৈবার ঘাঁটিগুলোর উপর এয়ার স্ট্রাইক করার সুযোগ ছিল। কিন্তু দিনের পর দিন আলোচনার পরেও এই সুযোগ হাতছাড়া করেছিল ভারত। এর ফলে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠনগুলো ও সেই সংগঠনগুলোর মদতদাতা, মানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ভারতকে একটি দুর্বল রাষ্ট্র বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছিল।

আর, এই বিশ্বাস থেকেই, পাকিস্তান 'কম খরচের' জঙ্গি আক্রমণের সরকারি নীতি নিয়েছিল। 'রাষ্ট্র কিছু করেনি' - এই তত্ত্বের আড়ালে পাকিস্তানের 'সেনাবাহিনী-জিহাদি' আঁতাত জঙ্গিহামলা সংগঠিত করতে শুরু করে দিল।

প্রধামন্ত্রী ইমরান খান দাবি করেছেন যে 'শান্তির সঙ্কেত' দিতেই অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আদতে অভিনন্দনের মুক্তি দেওয়া পাকিস্তানের কাছে বাধ্যতামূলক ছিল।

বালাকোটে জৈশের জঙ্গি শিবির ধ্বংস হওয়ায় পাকিস্তান প্রশাসনও বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। যে সময়ে ভারতীয় বায়ুসেনার ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান সেই শিবিরটি আক্রমণ করেছিল সেই সময়ে ওই শিবিরে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন জঙ্গি ও তাদের কমান্ডার উপস্থিত ছিলেন। এই শিবিরে একসঙ্গে ৬৫০ থেকে ৭০০জন জিহাদি প্রশিক্ষণ নিতে পারে। তাই কমপক্ষে কয়েকশো জন যে এই আক্রমণের শিকার হয়নি, তা মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন।

body3_030519122542.jpgবালাকোট জঙ্গি শিবিরে ৬৫০ থেকে ৭০০ জিহাদির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল [ছবি: রয়টার্স/ উপস্থাপনামূলক ছবি]

উল্লেখ্য, বালাকোট হামলার কথা অস্বীকার করার সময়ে পাকিস্তানের প্রশাসন কোনও সাংবাদিককেই ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে রাজি হয়নি।

ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলো গত এক বছরে যত সংখ্যক জঙ্গিদের খতম করেছে সম-সংখ্যক জঙ্গি, এই আক্রমণে এক রাতেই শেষ হয়ে গিয়েছে - জৈশের মদতদাতা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই শিক্ষা সহজে ভুলবে না। বিশাল সংখ্যক জঙ্গির মৃত্যুর ফলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী শুধুমাত্র লোকবল হারায়নি, তাদের সম্মানহানিও হয়েছে। পঞ্জাবি-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজেদের 'মাচো' বলে দাবি করে থাকে - এই আক্রমণে সেই দাবি অনেকটাই খারিজ করা গিয়েছে।

যে ভাবে গোপনীয়তা অবলম্বন করে ও পেশাদারিত্ব দেখিয়ে ভারতীয় বায়ুসেনা এই এয়ার স্ট্রাইক সংগঠিত করেছে তা রাওয়ালপিন্ডিতে বসে থাকা সেনাবাহিনীর জেনারেলদের যারপরনাই উত্তেজিত করে তুলবে। এদের অনেকেই বিশ্বাস করত যে পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে আক্রমণ করার দম ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেই।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অবশ্য যুদ্ধের জন্য আক্ষরিক অর্থে 'উপযোগী' নয়। তাদের হয়ে জিহাদিরা যুদ্ধ করতে নামে। আর সেনাবাহিনীর আধিকারিকরা নিজেদের সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত থাকেন। নির্মাণ শিল্প, উৎপাদন শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে তাঁদের প্রবল আগ্রহ। বিশ্বাসযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে, পাকিস্তানের অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ সেনাবাহিনীর আধিকারিকদের দখলে।

ভারতের নীতি নির্ধারককারীরা বরাবরই একটা ভুল করে আসছেন। তাঁরা মনে করেন যে বিবাদটা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়। বরঞ্চ বিবাদটা মূলত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে, যাদের পাকিস্তান তৈরি করে ও পোষে।

কিন্তু পাকিস্তানের জিহাদি আঁতুড়ঘরগুলোতে সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া কাকও ডাকতে সাহস পায় না। ভারতে এ  যাবৎ যতগুলো জঙ্গিহামলা হয়েছে এর প্রত্যেকটিতে রাওয়ালপিন্ডির সিলমোহর রয়েছে। তাই জৈশের বালাকোট শিবিরের উপর আক্রমণের পর ভারত যদি সাফল্যের ধারা বজায় রাখতে চায়, তাহলে ভারতকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি সংশোধন করে পাকিস্তানকে জল সরবারহ বন্ধ করে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রী নীতিন গডকড়ি। এর ফলে পাকিস্তানে ইতিমধ্যেই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।

body2_030519122704.jpgপরমাণু অস্ত্রের থেকে এই মুহূর্তে 'জল' অস্ত্র পাকিস্তানের কাছে বেশি ভয়াবহ [ছবি: রয়টার্স]

এই দাবির ফলে দুটি সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এক, চুক্তি অনুযায়ী দশকের পর দশক ধরে পাকিস্তানকে যে অযৌক্তিক ভাবে সাত শতাংশ জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে তা ভারত নিজের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

দুই, গডকড়ি যেমন বলেছেন, যেহেতু এই চুক্তি পাকিস্তানের মতো জঙ্গিদের মদতদাতা একটি দেশের সঙ্গে, তাই এই চুক্তি সংশোধন করা যেতেই পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন ও অন্য ক্ষমতাশালী দেশগুলো এই ধরণের চুক্তি প্রায়শই সংশোধন করে থাকে। চিন বহু আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করেছে। ব্রিটেনও ইউরোপীয় ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে ব্রেক্সিট চুক্তি সংশোধন করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

সিন্ধু জল চুক্তির বয়স নয নয় করে ষাট বছর। বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় হয়েছিল এই চুক্তি। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বয়ে চলা নদীগুলোর জলবন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি অনেকটাই পাকিস্তানের অনুকূলে। এই চুক্তি সংশোধন করার এটাই আদর্শ সময়। পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কথা মাথায় রাখলে এই মুহূর্তে পরমাণু অস্ত্রের থেকে 'জল' অস্ত্র পাকিস্তানের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় বায়ুসেনার এই এয়ার স্ট্রাইকের পরিণতিটা ঠিক কী? প্রথমত, পাকিস্তানের জঙ্গিদের মদত দেওয়ার প্রবণতা এ বার শেষ হতে চলেছে। দুই, এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার মাঝেই জঙ্গিদের মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে চড়া মূল্য দিতে হল।

তৃতীয়ত, ভারত পাকিস্তানের মধ্যে এই 'জুড়ে থাকার' সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছে। চতুর্থ, ইমরান খান যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চেয়ে আসছেন তা আর সম্ভব নয়। অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সে দেশের জঙ্গি ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।

একটা কথা মাথায় রাখতে হবে - এই মুহূর্তে ভারত যদি পাকিস্তানের উপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও চাপ সৃষ্টির জন্য উদ্যত না হয় তাহলে গত কয়েকদিন ধরে পাওয়া সাফল্যগুলো কিন্তু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে।

সন্ত্রাসবাদের বীজ রাওয়ালপিন্ডিতেই রোপণ করা রয়েছে। উইং কমান্ডার অভিনন্দন নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে এসেছেন। আর এই অবস্থায় আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে আসা কখনোই উচিত হবে না ভারতের।

জঙ্গিদের মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মাসুল গোনার পালাটা যেন বালাকোট থেকেই শুরু হয়। বালাকোট আক্রমণ যেন কোনও মতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ আক্রমণ না হয়ে ওঠে।

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MINHAZ MERCHANT MINHAZ MERCHANT @minhazmerchant

Biographer of Rajiv Gandhi and Aditya Birla. Ex-TOI & India Today. Media group chairman and editor. Author: The New Clash of Civilizations

Comment