'তিন-চক্ষু' ব্যবস্থা: আফগানিস্তান ও ইরানকে সঙ্গে নিয়ে ভারতকে সন্ত্রাস-বিরোধী জোট তৈরি করতে হবে
ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করার স্ট্রাটেজি গ্রহণ করুক ভারত
- Total Shares
পাকিস্তান মদতপুষ্ঠ সন্ত্রাসবাদের আঁচ তিনটি দেশকে বহন করতে হচ্ছে - ভারত, আফগানিস্তান ও ইরান। এই তিনটি দেশ কি এখন একজোট হয়ে সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে পারে না, যার জেরে কয়েকহাজার মানুষকে জীবন বলি দিতে হয়েছে?
গত সপ্তাহে, ইসলামিক রেভলিউশনারী গার্ড কর্পস-এর (আইআরজিসি) কমান্ডার কাসিন সুলেমানি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে সতর্ক করে বলেছেন, "পাকিস্তানের সরকারের কাছে আমার একটি প্রশ্ন রয়েছে - আমরা কোন দিকে এগিয়ে চলেছি? আপনারা আপনাদের প্রতিটি প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত বরাবর অশান্তির পরিস্থিতি বজায় রেখে চলেছেন। নিরাপত্তা ব্যাহত করার জন্য আর কি কোনও প্রতিবেশী বাকি রয়েছে? আপনাদের অঞ্চলে কয়েকহাজার জঙ্গি সংগঠন রয়েছে। পরমাণু শক্তির অধিকারী হয়েও আপনারা তাদের ধ্বংস করতে পারেন না।"
গত ১৩ ফেব্রুয়ারী, এক জঙ্গিহামলায়, ২৭ জন আইআরজিসি জওয়ানের মৃত্যু হয়েছিল। ইরানের দাবি, সেই জঙ্গি দলের তিনজন সদস্য পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন। কাকতালীয়ভাবে, এই জঙ্গি হামলা পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার ঠিক একদিন আগে ঘটেছিল।
উল্লেখ্য, কয়েকটি পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন ইরান-পাকিস্তান সীমান্তে বেশ সক্রিয়।
এই দুই দেশের সীমান্তের দু'ধরে বালোচ জাতির লোকেরা বসবাস করে। পাকিস্তান অবস্থিত জৈশ-আল-অদল জঙ্গি সংগঠনের তরফ থেকে ইরানের আইআরজিসির উপর হামলার দায়ে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
সন্ত্রাস দমনে ভারত আফগানিস্তান ও ইরান একযোগে কাজ করুক [সৌজন্যে: টুইটার]
ইরানের সর্বৈব নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনেয়ি এই ঘটনায় যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর ছায়াসঙ্গী মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সফভিকে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা পাঠানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।তিনি বলেছেন, "এই দাগি অপরাধীরা বালুচিস্তানের একটি উপজাতি পরিবারের সদস্য যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে আত্মঘাতী হামলার শিক্ষা অর্জন করেছে। আর, তাই, এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেই ইরানি সরকার, ইরানি নাগরিক ও আইআরজিসির কাছে জবাবদিহি করতে হবে কী ভাবে এই অপরাধীরা তাদের দেশের সীমান্ত টপকে আমাদের দেশে প্রবেশ করল। একই সঙ্গে, এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে জানাতে হবে কেন তারা নিজেদের দেশে জঙ্গি কারখানা খুলে সেই জঙ্গিদের বারংবার ইরানে পাঠাচ্ছে।"
ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবচাইতে বড় প্রাচীর হচ্ছে আইআরজিসি। সেই বাহিনীর কমান্ডার, আলি জাফারি, পাকিস্তানকে সতর্ক করে বলেছেন, "পাকিস্তানের জানা উচিত, তাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা যেভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে মদত দিচ্ছে তার জন্য পাকিস্তানকে কড়া মাশুল দিতে হবে।"
সৌদি আরবের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব হওয়ার পরেও পাকিস্তান কিন্তু বরাবরই ইরানের প্রতি সংযত ছিল। শিয়া ইরান ও সুন্নি সৌদি আরব বহুদিন ধরেই পরস্পরের বিরুদ্ধে মধ্যে এশিয়ার ভূরাজনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সে দেশে শিয়া মুসলমানের সংখ্যা নেহাতই নগন্য নয়। তাই, পাকিস্তান শিয়াদের বিরুদ্ধে সহজে শত্রুতা করতে পারে না।
সৌদি আরব যখন ইয়েমেনের উপর হামলার উদ্দেশ্যে ইসলামিক জোট বাহিনীর জন্য পাকিস্তানের কাছে সাহায্য চেয়েছিল তখন ইরানের কথা মাথায় রেখে ইসলামাবাদ কিন্তু সংকোচবোধ করেছিল। এর পর, পাকিস্তানকে খুশি করতে, সৌদি আরব পাকিস্তানের প্ৰাক্তন সেনাপ্রধান রশিল শরীফকে সৌদির নেতৃত্বাধীন ইসলামিক জোট সেনাবাহিনীর প্রধান করে রিয়াদে পাঠায়।
ইসলামিক সেনাবাহিনী চার বছর ধরে হাউথি বিদ্রোহীদের (শিয়া সম্প্রদায়ের) বিরুদ্ধে বিধ্বংসী যুদ্ধ চালিয়েও নিজেদের লক্ষ পূরণ করতে পারেনি। বরঞ্চ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পশ্চিমের ক্ষোভের স্বীকার হয়েছে এই বাহিনী।
পাকিস্তানের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া রাজকোষ অনেকটাই সৌদি আরবের দানের উপর নির্ভরশীল। তাই পাকিস্তান বর্তমানে রিয়াদের 'স্যাটেলাইট' হয়ে উঠেছে। এর ফলে, ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং ইরান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো জঙ্গিসংগঠনগুলোর আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে, আফগানিস্তান আবার তালিবানদের আত্মঘাতী হামলায় জর্জরিত। তালিবানেরও কিন্তু পাকিস্তানে আশ্রয়স্থল রয়েছে।
পাকিস্তানের ইরান লাগোয়া সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো জঙ্গি সংগঠনগুলোর আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে [ছবি: জিওকার্রেন্টস]
এক সময়ে, কাবুলের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন রাহমাতুল্লাহ নবিল। জুলাইতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলছে। সেই নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন নবিল।
সম্প্রতি নবিল দাবি করেছেন, "পাকিস্তানের মাটিতে মোট ৪৮টি জঙ্গি সংগঠন আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ভারতের এই প্রত্যাঘাত (বালাকোট এয়ার স্ট্রাইক) আরও আগেই করা উচিত ছিল। আমার ধারণা জৈশ-আল-অদলের বিরুদ্ধে ইরানও কঠোর পদক্ষেপ নেবে।কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি হটাৎ এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ার সিধান্ত নেয় (আশা করি তারা তা করবে না) তাহলে জঙ্গি সংগঠনগুলো কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখবে।"
বালাকোট এয়ার স্ট্রাইকের পর, পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করতে ভারত যে স্ট্রাটেজি নেবে তা ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলেই গ্রহণ করতে হবে। এই তিনটি দেশই এখন নিজেদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী তথ্য আদানপ্রদান করে থাকে। এই ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করে তুলতে হবে।
সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে সবচাইতে কার্যকরী সংগঠনটির নাম "ফাইভ আইস" নেটওয়ার্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা বিভাগগুলো এই সংগঠনের সদস্য। রিয়াল টাইমে এই সদস্যরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করে থাকে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা এড়ানো গিয়েছে। "ফাইভ আইসের" সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় সত্যিই অসাধারণ।
একই ভাবে, ভারত, আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যে যদি একটি "থ্রি আইস" সংগঠন গড়ে তোলা যায় তাহলে এই অঞ্চলের জঙ্গিহামলার আশঙ্কা অনেকটাই প্রশমিত করা সম্ভব হবে।
যুক্তরাষ্ট্র তালিবানের সঙ্গে ফৌস্তিয়ান চুক্তি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ছাড়লেই, পাকিস্তান (যারা তালিবানকে আশ্রয় দেয় ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে) কিন্তু ভারত ও আফগানিস্তানের উপর জিহাদি হামলা শুরু করে দেবে।
গৌতম মুখ্যোপাধ্যায় আফগানিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি সতর্ক করেছেন, তালিবানের উপস্থিতি ভবিষ্যতে আফগান সরকারের বিপর্যয়ের কারণ উঠতে পারে। লন্ডনে, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) এক সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'শান্তি প্রক্রিয়া' নিয়ে আলোচনা করার সময়ে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে মহিলাদের অধিকার নিয়ে তারা কিছুটা নরম হবে। এ হেন প্রতিশ্রুতি কিন্তু আদতে ক্ষমতা দখলের কৌশল ভিন্ন আর কিছুই নয়।
তবে, তালিবানদের খুশি হওয়ার খুব বেশি কারণ এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, আফগানিস্তান ছাড়লেও তারা একটি ছোট্ট বাহিনী সেই দেশে রেখে দেবে এবং তালিবান যদি ফের সন্ত্রাস ছড়ানোর চেষ্টা করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আবার আফগানিস্তানে 'পূর্ন শক্তির' সেনাবাহিনী পাঠাতে বাধ্য হবে।
আর, তালিবান যাতে সন্ত্রাস বন্ধ না করে তা নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তান তো রয়েছেই। কিন্তু ভারত, আফগানিস্তান ও ইরান যদি "থ্রি আইস" সমন্বয় গড়ে তুলতে পারে তাহলে জঙ্গি হামলার আশঙ্কাকে অনেকটাই প্রশমিত করা সম্ভব হবে।
পাকিস্তানের দুই মুখ্য অৰ্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, চিন ও সৌদি আরব, নিজেদের 'ঘরের' সন্ত্রাস নিয়েই বেশ চিন্তিত। সন্ত্রাসবাদ সহ্য করার একটি নির্দিষ্ট সীমা রয়েছে। বর্তমানে, সন্ত্রাসবাদ সহ্যের সীমায় পৌছিয়ে গিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ যাতে সেই সীমা অতিক্রম না করতে পারে তা এখন নিশ্চিত করতে হবে ভারতকে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে