১১ ডিসেম্বর পাঁচ রাজ্যে ফলাফলের উপরে নির্ভর করছে এ রাজ্যে বিজেপির সাফল্য
রাজ্যে বিজেপি যে উগ্র ভাব দেখাচ্ছে তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে
- Total Shares
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে এখন সাজো সাজো রব। রথ বেরবে। এই রথে ভর করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পালাবদলের সূচনা হবে – এমনটাই স্বপ্ন। কেন্দ্রীয় স্তর থেকে বিজেপির আপ্রাণ চেষ্টা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একটা সম্মানজনক সংখ্যার আসন পশ্চিমবঙ্গ থেকে জিতে আসে। কেন্দ্রীয় বিজেপির রণকৌশলকে ও ভাবনাকে ব্যবহার করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে রাজ্য বিজেপি।
স্বপ্ন দেখা কোনও অপরাধ নয়। কিন্তু স্বপ্ন দেখানোটা অপরাধ না হলেও আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে।
অমিত শাহদের রথযাত্রা কতটা সফল হবে তা বোঝা যাবে ১১ ডিসেম্বরের পরে (ফাইল ছবি: পিটিআই)
ভারতের গণতন্ত্রে এটা একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য যে, মানুষ যখন যাকে চেয়েছে তাকে নির্বাচিত করেছে এবং অপছন্দের প্রার্থীকে পরাজিত করেছে। তবুও নির্বাচনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা পালন করে একটা রাজনৈতিক দলের সংগঠন, প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, দর্শন, মানুষের চাওয়া-পাওয়া এবং হাওয়া।
রথযাত্রা-জাতীয় কর্মসূচিগুলি দু’ধরনের উদ্দেশ্য সাধন করে – সংগঠনকে মজবুত করা এবং হাওয়া তোলা। তৃতীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল দলের পরিচিতিটা বেশি বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
পশ্চিমবঙ্গের এখন যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে দল হিসাবে বিজেপির পরিচিতি রাজ্যবাসীর কাছে প্রতিষ্ঠিত। এর জন্য রাজ্য নেতৃত্বকে কোনও কাঠখড় পোড়াতে হয়নি, জাতীয় রাজনীতির ঘটনাক্রমই পুরো দেশে বিজেপিকে পরিচিত করে তুলেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে হাওয়া।
ভোটের রাজনীতিতে হাওয়া এবং চাওয়াপাওয়া – এই দু’টি বিষয় আনুপাতিক। মানুষের চাওয়াপাওয়া কখন কী ভাবে ওঠানামা করে তার সঙ্গে হাওয়া নির্ভর করে এবং সেই সঙ্গে এই রাজনৈতিক দলগুলির বিভিন্ন কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কেন্দ্রীয়স্তরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে হাওয়া তুলতে মরিয়া। কিন্তু তার পাশাপাশি দলের বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন যে নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার ব্যাপারে সংগঠনও একটা অত্যন্ত গুরুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। আর ঠিক এই জায়গাতেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির রথযাত্রার ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই নির্ধারণ করা বেশ কষ্টকর।
মুকুল রায়, দিলীপ ঘোষরা যাই বলুন, রাজ্যের বিজেপির সংগঠন এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয় (ফাইল ছবি: আজতক)
যে কোনও লোকসভা আসনে ভোটদাতার সংখ্যা কমবেশি ১২ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র এবং মোটামুটি ৮৫,০০০ বুথ। এই ৮৫,০০০ বুথের মধ্যে প্রায় ২০,০০০ বুথে ধর্মীয় কারণে বিজেপির কোনও রকম উপস্থিতি নেই। প্রায় ১৫,০০০ বুথে তৃণমূল কংগ্রেসের অতিরিক্ত দাপটের কারণে বিজেপির উপস্থিতি নামমাত্র। পড়ে থাকে ৫০,০০০ বুথ। এই ৫০,০০০ বুথে প্রতিটি ভোটদাতার কাছে পৌঁছানো, ব্যক্তিগত ভাবে, সংবাদমাধ্যমে নয় – এমন দাবি অতিবড় বিজেপি সমর্থকও এখনও অবধি করে উঠতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, এই ৫০,০০০ বুথে ভোটদাতাদের আশ্বস্ত করার জন্য কমপক্ষে ১ লক্ষ বুথকর্মী প্রয়োজন যাঁরা ভোটের দিন বুথ আঁকড়ে বসে থাকাটাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। এই এক লক্ষ বুথকর্মীকে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সমর্থকরা এখনও পর্যন্ত দেখে উঠতে পারছে না।
এটা ঠিক যে গত বছর দুয়েক ধরে বিভিন্ন নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। কিন্তু ভোট রাজনীতিতে দ্বিতীয় হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম হওয়া – এই দুটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
২০০১ সালে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে সরকার প্রায় গঠনই করে ফেলেছিলেন, তিনি শেষ পর্যন্ত মহাকরণে ঢুকতে পেরেছিলেন ২০১১ সালে। এরকম একটা অবস্থায় ৭-৮ বছর বাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু সমর্থক বিজেপিকে বিকল্প হিসাবে বেছে নিয়ে গত কয়েকটি ভোটে বিজেপির ভোট বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে। তাতে উৎসাহিত বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বারে বারে আসছেন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ (ডেইলিও বাংলা)
কিন্তু পাশাপাশি মুষের মধ্যে একটা উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। যে উগ্রতার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব রাজনৈতিক বয়ানবাজি শুরু করেছেন তার পরিণতি কী হবে!
রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ সব সময় ভারতের মধ্যে শীর্ষে। বামপন্থী থেকে তৃণমূল, সকলেই এই দোষে দুষ্ট এবং সেই একই লাইন বাজার গরম করার চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। কিন্তু সাংগঠনিক দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ যে এখনও অমিত শাহের স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি, তার প্রমাণ – এক দিকে নেতৃত্বের উগ্র বক্তৃতা, পরিণতিতে নীচুতলার কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এবং সবার শেষে সেই আক্রান্ত কর্মীদের কাছে পৌঁছানোর মতো বিজেপি নেতৃত্বের অভাব।
দলের নিম্নস্তেরর সমর্থকরা এখন এই চক্রব্যুহের মধ্যে আটকে পড়েছেন। দলের আসন্ন রথযাত্রা এই উগ্রতাকে আরও কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা ক্রমশ প্রকাশ্য কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিংসার রাজনীতির অপবাদ থেকে বেরিয়ে আসের আপ্রাণ চেষ্টায় রয়েছে, নতুন করে সেই একই রাজনীতিকে হাতিয়ার করে রাজ্যবিজেপির অগ্রগতি তাদের মস্তিষ্কের দিক থেকে হতাশ করছে কিন্তু হৃদয়ের দিক থেকে তাঁরা এখনও দিশাহীন।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এতকাল ভিনরাজ্যে সাফল্যের ভিত্তিতেই ঢোল বাজিয়েছে এবং আবির ছড়িয়েছে। এ বার রাজ্য নেতৃত্ব স্বপ্ন দেখাচ্ছেন যে এবার তাঁরা নিজের সাফল্যেই ঢোল বাজাবেন। এমন অবস্থায় আগামী ১১ ডিসেম্বর এই উৎসাহকে কতটা ইন্ধন জোগাবে অথবা কতটা নিরাশ করবে তা নিয়ে কিন্তু প্রবল শঙ্কায় রাজ্য থেকে কেন্দ্র – বিজেপি নেতৃত্ব।