নেতাজি, সর্দার প্যাটেল ও আম্বেদকরের প্রতি কংগ্রেসের আচরণ কী ভাবে বিজেপিকে সাহায্য করছে
পরিবারতন্ত্রের দিন শেষ, ক্ষমতায় ফিরতে হলে কংগ্রেসকে মহাজোটে সামিল হতেই হবে
- Total Shares
গত রবিবার, ২১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। সিঙ্গাপুরে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ সরকার ঘোষণার ৭৫ বছর উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজন করা হয়েছিল। তবে ুএই অনুষ্ঠানটি আরও কয়েকটি বিষয়ের জন্যেও গুরত্বপূর্ণ ছিল।
২১ অক্টোবর আবার জাতীয় পুলিশ স্মৃতিরক্ষা দিবস হিসেবেও পালিত হয়। তাই লালকেল্লার অনুষ্ঠাটির ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে জাতীয় পুলিশ স্তম্ভ উৎসর্গ করলেন।
জাতীয় সমর স্মারকের মতোই পুলিশ স্মারকও বহু প্রতীক্ষিত ছিল। ৩০ ফুট লম্বা ২৩৮ টনের গ্রাফাইটের স্তম্ভ, একটি সংগ্রহশালা ও ৩৪,৮০০জন পুলিশ শহীদের নাম বিশিষ্ঠ একটি প্রাচীর মনকে সত্যি সত্যিই নাড়া দিয়ে যায়। এই মিনারের মাধ্যমে পুলিশকর্মী ও আধাসামরিক বাহিনীর কর্মী-আধিকারিকদের বলিদানকে সম্মান জানানো হল যা অনেক সময়ই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।
পুলিশ দিবসের অনুষ্ঠানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামাঙ্কিত একটি পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী, যা জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জওয়ানরা পাবেন বীরত্বের জন্য। সত্যি বলতে কী, জাতীয় বিপর্যয়ের সময় এনডিআরএফ জওয়ানদের অবদান অনেক সময়তেই স্বীকৃতি পায় না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাতেই হচ্ছে।
Netaji had promised an India where everyone has equal rights&equal opportunities. He had promised a prosperous nation which was proud of its traditions, development in all areas. He had promised to uproot 'divide & rule'. Even after so many yrs those dreams remain unfulfilled: PM pic.twitter.com/SwrxDR54d0
— ANI (@ANI) October 21, 2018
এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই দু'টি অনুষ্ঠানেরই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনও চেষ্টার কমতি করেননি। পুলিশ সৌধ উন্মোচনের সময় তিনি বলেন, "কেউ বলতে পারবেন কেন এই সৌধ উন্মোচন করতে সত্তরটি বছর লেগে গেল?"
লালকেল্লায় মোদীর বক্তব্য তো আরও ধারালো ছিল। সেখানে তিনি বলেছেন যে সুভাষচন্দ্র বসু, বিআর আম্বেদকর এবং সর্দার প্যাটেলের অবদান খাটো করে দেখানো হয়েছে যাতে 'একটি পরিবারের' অবদানকে তুলে ধরা যায়।
এর আগে অবশ্য মোদী একটা কথা বারংবার বলেছেন, কংগ্রেস যে সব মহাপুরুষদের অবজ্ঞা করেছে তাঁদের যোগ্য সম্মান দেবে বিজেপি।
প্রধানমন্ত্রী যে এ ধরণের কথাই বলবেন তা আশা করা গিয়েছিল। বিজেপি সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এই প্রতিক্রিয়ায়। উল্টোদিকে মোদী ও বিজেপির সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে কংগ্রেস। কংগ্রেসের অভিযোগ বিজেপি নাকি সুভাষচন্দ্র বসু, সর্দার প্যাটেল ও আম্বেদকরের মতো ব্যক্তিত্বকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে।
একটা কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে আম্বেদকরের স্মৃতিসৌধ, পুলিশ সৌধ এবং লালকেল্লা থেকে নেতাজির লড়াইকে দেওয়া স্বীকৃতি - এ সব কিছুই বিজেপির আমলে ঘটেছে। কিন্তু এই বিষয়ে বেশি রক্ষণাত্মক হতে গিয়েই নিজের গোলে নিজেরাই বল ঢুকিয়ে ফেলছে কংগ্রেস।
প্রথমত, এইসব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা যাতে সাধারণ মানুষদের স্মৃতিতে রয়ে যায় তার জন্য তো কংগ্রেস কিছুই করেনি আর, এই ফাঁক দিয়েই সহজেই গলে দিয়ে দিতে পারছে বিজেপি।
মোদী বলেছিলেন, কংগ্রেস যে ব্যক্তিত্বদের অবহেলা করবে তাদের যোগ্য সম্মান দেবে বিজেপি [ছবি: পিটিআই]
দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর কারও কোনও মালিকানা থাকতে পারে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আরএসএসের ভূমিকা নিয়ে অনর্থক তর্ক করে লাভ নেই। ভারতীয় হিসাবে তাদেরও এই সব ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কংগ্রেস তাদের এই প্রচেষ্টাকেই খাটো করতে চাইছে যেমন স্ট্যাচু অফ ইউনিটিকে তারা চিনা পণ্য বলে আখ্যায়িত করেছে। এই ভাবে বিজেপিকে খাটো করতে গিয়ে কংগ্রেস এই মহাপুরুষদের অসম্মান করছে।
এই মুহূর্তের কংগ্রেসকে কোনও ভাবেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের উত্তরসূরি বলা যাবে না। এই কংগ্রেস তো ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হয়েছে। এবং এই ভাঙাভাঙির সময় সত্যিকারের কংগ্রেস দল হারিয়ে গিয়েছে। এখন যে কংগ্রেসটি পড়ে রয়েছে তা সেই সত্যিকারের কংগ্রেস দলটির শুধুমাত্র আইনত উত্তরসূরী।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গলের কন্যা তথা সিপিআই নেত্রী সুহাসিনী আলি টুইট করেছেন:
Subhas used so many Urdu words for official purposes. Never used BharatMataKiJai or BandeMataram as slogans but only JaiHind. All this led Savarkar to label him a JihadiHindu
— subhashini ali (@SubhashiniAli) October 22, 2018
অনেকেই তর্ক করতে পারেন যে তিনি আজকের দিনে কী শব্দ ব্যবহার করতেন সে ব্যাপারে সুহাসিনী কী ভাবে নিশ্চিত হলেন। কিন্তু সে তর্কে না গিয়ে অন্য একটি প্রশ্ন করা যাক - তাঁর মা সারাজীবন ধরে এবং ২০১২ সালের মারা যাওয়ার সময় পর্যন্ত কতখানি সম্মান পেয়েছেন?
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে নেতাজি সরকারি কাজে উর্দু শব্দ ব্যবহার করতেন। কিন্তু তিনি তো অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখতেন এবং আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তিনি কোনও দিনও দেশভাগকে সমর্থন করতেন কিনা।
যাই হোক, এবার যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল স্বাধীনতার আগে নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের জওয়ানদের কী চোখে দেখা হত আর ১৯৪৭ সালের পর নেতাজি, প্যাটেল ও আম্বেদকরকে ভারতের ইতিহাসে কোন জায়গা দেওয়া হয়েছে।
যদিও কংগ্রেস এই বিষয়টি নিয়ে বিজেপিকে খোঁচা দিয়েছে, অন্যান্য বিরোধী দল কিন্তু বিজেপিকে নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শুধু একটি সাদামাটা টুইট করেছেন।
Today is the 75th anniversary of the formation of the Azad Hind Government. My heartfelt tribute to all the brave soldiers of INA who fought for India’s freedom under the leadership of Netaji. Jai Hind.
— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) October 21, 2018
কংগ্রেস হয়তো বৃহত্তর ছবিটা দেখতে পাচ্ছে না। তারা শুধুমাত্র মোদী ও বিজেপি নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দেশ আর পরিবারতন্ত্রের ধার ধারে না এবং একজন ব্যক্তিবিশেষ বা একটি বিশেষ পরিবার এখন আর দেশকে শাসন করতে পারবে না।
বন্ধ দরজা খুলে দিতে মোদী ও বিজেপি অনেকটাই সফল হয়েছে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সুতরাং, দিল্লি এখন আর খবর বাছাই করতে পারে না।
নিজের পয়েন্ট বাড়ানোর সুযোগ ছাড়েননি মোদী [ছবি: ইন্ডিয়া টুডে]
সবরীমালা নিয়ে দেশজুড়ে হইচই চলছে। এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ হওয়া নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা শুধুমাত্র হিন্দি বলয়েই সীমাবদ্ধ নেই। গোটা বিশ্বজুড়েই আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবসে পতাকা উত্তোলন নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করা যেতেই পারে। আপনি পছন্দ করুন বা না করুন বিকল্প বাস্তুতন্ত্র তৈরি হতে বাধ্য। তা সে মোদী আর বিজেপি থাকুক বা না থাকুক।
বিএসপির মতো দলগুলো নিজেদের আদর্শস্থানীয় ব্যক্তি তৈরি করে ফেলেছে। বাকি দলগুলোরও নিজস্ব ভাবধারা বা রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু কারোরই কোনও মহাপুরুষের উপরে একচেটিয়া অধিকার নেই।
অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেস আর একা ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না। একমাত্র মহাজোটের মাধ্যমেই কংগ্রেস সরকার গঠন করতে পারবে। এবং তা রাহুল গান্ধীর জন্য হবে না। তা রাহুল গান্ধী থাকলেও হতে পারে, না থাকলেও হতে পারে।
কংগ্রেসের উচিত বর্তমান পরিস্থিতিটাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে মেনে নেওয়া। তাদের রাজকীয় চালচলন ভুলে কংগ্রেসের উচিত সব দলকে সমান মর্যাদা প্রদান করা।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে