এই রাজ্যের বিদ্বজ্জনদের এখন অবস্থান ঠিক কেমন?

বিদ্বজ্জনের সমালোচনা এখন সরকারের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে

 |  3-minute read |   28-04-2018
  • Total Shares

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যে সব বিদ্বজ্জন পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন এখন তাঁরা নতুন করে বদলের ডাক দেওয়ার কথা বাবছেন, যাকে তাঁরা বলছেন পরিবর্তনের পরিবর্তন। বাম আমলে যে সব বিদ্বজ্জন পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন, সম্প্রতি একটি সাংবাদিক বৈঠকে তাঁদেরই অনেককেই এই পরিবর্তন নিয়ে খেদোক্তি করতে দেখা যায়।

পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে যে ব্যাপক সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে এবং যে ভাবে রক্ত ঝরেছে, তা নাড়া দিয়েছে বিদ্বজ্জনের একাংশকে, তাঁরা মনে করছেন, রাজ্যের এই অরাজক অবস্থা নিয়ে এখনই মুখ খোলা দরকার। নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী মনে করেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের টুঁটি টিপে ধরা হয়েছে। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, যাঁর গাওয়া “আমি বাংলার গান গাই/ আমি বাংলায় গান গাই” প্রায়ই সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়, তিনিও বলেন, এবার এই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হওয়ার সময় এসেছে। তৃণমূলের আমলে যিনি পদ ছেড়েছিলেন, সেই প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, বামফ্রন্ট সরকার ঠিক যে ভাবে সন্ত্রাস কায়েম করেছিল, এই সরকারও ঠিক সে ভাবেই সন্ত্রাস কায়েম করেছে।

যাতে সব বিদ্বজ্জনই তাদের ছত্রছায়ায় থাকে সে জন্য পুরস্কার দেওয়া থেকে শুরু করে কোনও কিছুই বাদ রাখেনি এই সরকার, তাই এই সব বিদ্বজ্জনের সমালোচনা এখন সরকারের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিড়ম্বনার আরও বড় কারণ হল, যখন পরিবর্তনের ডাক দেওয়া হয়েছিল, তখন এই সব বিদ্বজ্জনেরাই ছিলেন একেবারে প্রথম সারিতে।

thappar_body_042818051925.jpg২৬ এপ্রিল ডজন খানেকের বেশি বিদ্বজনকে রাজভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাজ্যপাল যাঁদের মধ্যে ছিলেন লেখক, গায়ক, উপাচার্য, চলচ্চিত্র ও নাট্য ব্যক্তিত্বরা

এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেতারা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য হল, বিদ্বজ্জনেরা ভুল খবর পেয়েছেন। বিদ্বজ্জনদের ভুল বার্তা দেওয়ার জন্য তিনি দুষেছেন এসইউসি-কে। গেরুয়া শিবির, অর্থাৎ বিজেপি এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগত বিদ্বজ্জনদের নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করলেও তাতে সফল হতে পারেনি। বিজেপি যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে দলে টেনেছে তাঁরা তেমন বিখ্যাত নন, জনমানসে তাঁদের মতামতের তেমন গুরুত্বও নেই।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের ভোটের কথা ভেবে বিজেপিও নতুন উদ্যমে মমতার অনুগত বলে পরিচিত বিদ্বজ্জনেদের অন্তত কয়্কজনকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছে। তবে বিজেপি সরাসরি তাঁদের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে না, এ বার তারা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দিয়েছে, তিনিই চা-কফি-কাজু নিয়ে বসে বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে কথা বলছেন।

২৬ এপ্রিল ডজন খানেকের বেশি বিদ্বজনকে রাজভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাজ্যপাল যাঁদের মধ্যে ছিলেন লেখক, গায়ক, উপাচার্য, চলচ্চিত্র ও নাট্য ব্যক্তিত্বরা। কেন তাঁদের আমন্ত্রণ জানান হচ্ছে সে কথা নিমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল না, আর বিদ্বজ্জনেরাও সহজেই অনুমান করতে পারছিলেন এই চায়ে পে চর্চার নেপথ্যে কী থাকতে পারে। ওই সময় তাঁদের অন্য কাজ আছে বলে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষরা ওই আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেলেও অনেকেই এই চা-চক্র নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন।

অনেকে তো আবার একধাপ এগিয়ে উত্তর দেন যে রাজ্যপাল যদি চায়ের কাপে তুফান তোলেন তা হলে সেটা তাঁদের বেশ পছন্দই হবে।

এক ঔপন্যাসিক বলেন, “যতই হোক, এখন দেশ ও রাজ্যে অবস্থা বেশ তুফানি, তাই আমাদেরও মনের কথা বলা দরকার। যখন রাজ্যপাল নিজেই আমাদের মত প্রকাশ করার সুযোগ দিচ্ছেন, আমার মনে হয়, সেই সুযোগ আমাদের নেওয়া উচিৎ, আমাদের যাওয়া উচিৎ।” অনেকের মনে অবশ্য এই ভয়ও আছে যে, রাজ্যপালের চা-চক্রে যাওয়া মানেই শাসকদলের কাছে স্পষ্ট ভাবে বার্তা যাবে যে তাঁরা শাসকশিবির ত্যাগ করছেন।

অতিথিদের তালিকায় কারা আছেন, সে ব্যাপারে চরম গোপনীয়তা অবলম্বন করা হচ্ছে, আর অতিথিরাও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন কারণ, যাঁরা আমন্ত্রণ পেয়েছেন, তাঁরা যে এখন উল্টো শিবিরের কাছাকাছি, বেশ অসন্তুষ্ট, বিরক্ত এবং শাসক শিবির ছাড়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন সেই বার্তা যাবে শাসকদলের কাছে।

যাই হোক, খুব অল্প সংখ্যক লোকই গিয়েছিলেন রাজ্যপালের দেওয়া সেই চা-চক্রে যোগ দিতে। রাজ্যপালের সঙ্গে মুষ্টিমেয় যে ক’জন সেদিন চা পান করেছেন, সেই তালিকায় রয়েছেন কবি জয় গোস্বামী, লেখক মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, বাণী বসু, শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী ও পবিত্র সরকার। সাধারণ ভাবে রাজ্যের ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা হয়েছে। চা-চক্র থেকে বেরিয়ে সব অতিথিই এক সুরে বলেছেন, “এই বৈঠকের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না।”

অন্তত একটা বার্তা তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিতে পেরেছেন, তা হল, এই আলোচনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না। সৌজন্য রক্ষা করার তাগিদেই তাঁরা রাজভবনে গিয়েছিলেন।

১৭ জনকে ডাকার পরে মাত্র সাত জন এই চা-চক্রে উপস্থিত হওয়া বিজেপিকে খুব একটা উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। যে সব বিদ্বজ্জনের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ রয়েছে, তাঁরা সকলেই এই চা-চক্র এড়িয়ে গিয়েছেন আর যাঁরা ওই চা-চক্রে যোগ দিয়েছেন তাঁরা পুরোপুরি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলেই পরিচিত, রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের কোনও সংস্রব নেই, তা সে রাজ্যের হোক বা কেন্দ্রের।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

ROMILA THAPAR ROMILA THAPAR

Romila Thapar is Emerita Professor of History at JNU and a fellow of the British Academy.

Comment