কাশ্মীর নিয়ে ‘নো-বল’ করলেন ‘বুম-বুম’ আফ্রিদি
তিনি বলেছিলেন কাশ্মীর ভুলে যাক পাকিস্তান, পরক্ষণেই ভুললেন নিজের কথাটিই
- Total Shares
কখনও তিনি দুর্দান্ত আবার কখনও তিনি একেবারেই নির্রযোগ্য নন -- ক্রিকেটার হিসাবে এটাই ছিল পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক শাহিদ আফ্রিদির পরিচয়। এবার তিনি যা করলেন তাকে ক্রিকেটের ভাষায় লুজ নো-বল বলা যেতে পারে – জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে তাঁর মন্তব্য এবং তা নিয়ে হইচই হতেই তার উপরে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা।
বুদ্ধিমত্তার জন্য যিনি কোনও দিনই সুপরিচিত ছিলেন না, জটিল রাজনৈতিক বিষয়ে যাঁর জ্ঞান এবং ধ্যানধারণা যা তা নিয়ে বড় জোর রোয়াকের আড্ডায় আলোচনা চলতে পারে, সেই শাহিদ আফ্রিদি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথোপকথনের সময়ে জম্মু-কাশ্মীর প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করলেন তা এতদিন এ নিয়ে যাবতীয় যা কথা হয়েছে সে সবেরই ঊর্ধ্বে।
উনি ক্রিকেটীয় দক্ষতার জন্য পরিচিত, তবে বুদ্ধিমত্তার জন্য নন (ছবি: রয়টার্স/ফাইল)
প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকদের উদ্দেশে আফ্রিদি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের কাশ্মীর চাই না। ভারতকেও কাশ্মীর দিতে হবে না। কাশ্মীরকে স্বাধীন করে দেওয়া হোক। তাতে অন্তত মানবতা রক্ষা পাবে। আর যেন মানুষ না মরে... পাকিস্তান কাশ্মীর চায় না... তারা তো নিজের চারটি রাজ্যকেই সামলাতে পারছে না... মানবতাই (ইনসানিয়াত) সবচেয়ে বড় ব্যাপার। ওখানে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এটা খুবই বেদনাদায়ক ব্যাপার। তা সে যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, যে কোনও মৃত্যুই বেদনাদায়ক।”
এই মন্তব্য নিয়ে যে হইচই শুরু হয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
ভারত দেখল যে র্যাডক্লিফ লাইন নিয়ে ভারতের যা অবস্থান আফ্রিদি মোটামুটি তাকেই মান্যতা দিয়েছেন, স্বাভাবিক ভাবেই আফ্রিদির মন্তব্য শুনে ভারত যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিল।
এই ঘটনার পরেও আফ্রিদি যথারীতি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন যে তাঁর পুরো কথা বলা হয়নি, একটি মাত্র অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। টুইট করে তিনি পাকিস্তানেই লাইনেই বলেছেন, “কাশ্মীর হল অমীমাংসিত বিতর্কিত স্থান যা নির্দয় ভাবে দখল করে রেখেছে ভারত। রাষ্ট্রপুঞ্জের মাধ্যমে এর সমাধান হওয়া দরকার। অন্য পাকিস্তানিদের মতো আমিও আজাদ কাশ্মীরের দাবিকে সমর্থন করি। কাশ্মীর পাকিস্তানের অঙ্গ।” তিনি বলেছেন, “কাশ্মীরীদের লড়াইকে আমি সমর্থন করি।” তিনি মনে করেন যে “তাঁদেরও অধিকার বুঝে পাওয়া উচিত।”
My clip is incomplete & out of context as what I said before that is missing.Kashmir is unresolved dispute & under brutal Indian occupation. It must be resolved as per UN resolution. Myself along with every Pakistani support Kashmiri freedom struggle. Kashmir belongs to Pakistan.
— Shahid Afridi (@SAfridiOfficial) November 14, 2018
My comments are being misconstrued by Indian media! I'm passionate about my country and greatly value the struggles of Kashmiris. Humanity must prevail and they should get their rights.
— Shahid Afridi (@SAfridiOfficial) November 14, 2018
যদি এই পুরো ঘটনা নিয়ে আসল সত্যিটা বলা যায় তা হল চায়ের কাপে তুফান তোলার বেশি কিছুই হবে না।
আদর্শগত ভাবে গণমাধ্যম এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল দুই দেশের সাধারণ মানুষের বোঝা উচিত যে আফ্রিদি কী বললেন কী বললেন না সেটি তাঁর মতোই এক গুরুত্বহীন বিষয়। সহজ-সরল ঘটনা হল একজন সেলিব্রিটি হিসাবে তাঁর নিজের মত জানিয়েছেন আফ্রিদি, তিনি কোনও কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন না, কোনও প্রতিপত্তি নেই, এ বিষয়ে মত দেওয়ার জন্য কেউ তাঁকে ডাকবেও না, বাস্তবে কোনও কিছু বদল করার ক্ষমতাও নেই তাঁর। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে বিনোদ কাম্বলির মতো কেউ, বা রাজ বব্বরের মতো কেউ এমনকি আজহারউদ্দিনের মতো মতো কোনও ব্যক্তিও যদি জাতীয় নীতি বা জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কিছু বলেন – কে তাঁর মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে?
খুবই প্রতিভাবান খেলোয়াড় – তবে দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত্র ব্যাপারে বিনোদ কাম্বলিকে কেউই গুরুত্ব দেবে না (ছবি: টুইটার)
তবে তাঁরা যদি বেফাঁস বা হাস্যকর কোনও মন্তব্য করেন তা হলে তা নিয়ে বাজার গরম হবেই। তবে বাস্তবিক হল যে তাঁরা যাই বলুন না কেন কারও কাছেই সে সব কথার কোনও গুরুত্ব নেই।
যদি এমন হয় যে, আফ্রিদির কথা নতুন ভাবে বলা হয়েছে, তাকে মোটামুটি ভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম অংশটি ভারতীয়দের খুব পছন্দ হয়েছে, এটা হল একটি ঘটনা – পাকিস্তান তার নিজের দেশের চারটি রাজ্যকেই সামলাতে পারছে না। পাকিস্তানের ভাবমূর্তি এখানে ‘পতনশীল রাষ্ট্রের’ মতো – যদি আপনার মনে হয় যে পাকিস্তান পারমানবিক শক্তিধর একটি দেশ, ভীষণ ভাবে ইসলামপন্থী এবং প্রশাসনিক দুরবস্থা এখানকার স্থায়ী সমস্যা তা হলেই আফ্রিদির কথার একটা অর্থ হয়।
যদিও পাকিস্তান তার নিদের দেশের রাজ্যগুলোকেই ঠিকঠাক ভাবে সামলাতে পারছে না, তা সত্ত্বেও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন অনেক পাকিস্তানিই কাশ্মীর চান। ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর লাহোর সফরের সময় এই লেখকের সঙ্গে একটি আলাপচারিতায় এক পাকিস্তানি কূটনীতিককে যখন জিজ্ঞাসা করে যে কোনও দিন যদি পাকিস্তান কাশ্মীর পেয়ে যায় তা হলে তারা কী ভাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করবে – তখন তিনি অবাকই হয়েছিলেন।
আফ্রিদির বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশটিকে অনেকটা ‘তৃতীয় উপায়’-এর মতো শুনতে লাগছে – ভারতকেও নয়, পাকিস্তানকেও নয়, কাশ্মীরকে স্বাধীন করে দেওয়া হোক। এর মধ্যে নতুনত্ব বা মহত্ব – কিছুই নেই। অনেক সময়ই দেখা গেছে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অচলাবস্থা রয়েছে তার সমাধানে বহু পাকিস্তানিই এই তৃতীয় উপায়টির হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন।
একটা পর্যায়ে গিয়ে বলা যায় যে এই তৃতীয় উপায়টি হল পাকিস্তানের পিছু হঠার সামিল।
পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা যদি কাশ্মীর না পায় তা হলে বারতও যেন না পায়। অন্য ভাবে বলতে গেলে, কাশ্মীর না পেলে তাদের কোনও মরণবাঁচন সমস্যা হবে না, কিন্তু ভারত পেয়ে যাবে, এটা তারা কোনও ভাবেই সমর্থন করতে পারবে না। তৃতীয় উপায় মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটি অশুভ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। তারা মনে করছে যে কাশ্মীর যদি স্বাধীন হয়ে যায় তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তারা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকবে। সে ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানকে যে নানা সুযোগ-সুবিধা দেবে তাই-ই নয়, এক সময় পুরো কাশ্মীর দখল করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আর কোনও বাধা থাকবে না।
আরেকটি হল আফ্রিদি যে কথা বলেছেন তার দ্বিতীয় অংশটি – ইনসানিয়াত বা মানবতা, মানুষ মারা যাচ্ছে প্রভৃতি – এটিও আবার সেই পাকিস্তানেরই কথা, যখন অন্য কোনও কথায় চিঁড়ে ভেজে না তখন তারা এই কথা বলে, তাতেও লাভ কিছু হয় না। মানবিকতার কথা বলে তারা আসলে রাজনৈতিক ভাবে ওই জায়গার দখল নিতে চায়। আফ্রিদি যদি সত্যিই মানবিকতার কথাই ভাবতেন তা হলে তিনি কাশ্মীরের জন্য গলা না ফাটিয়ে বালোচে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সেনা যে জঘন্য অভিযান করে চলেছে আদিবাসী এলাকাগুলোতে, রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান যে কাজ করছে তার বিরুদ্ধে তিনি বলতে পারতেন।
নিদারুণ খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছে বালুচিস্তান। তাঁদের মানবতা নিয়ে কেন উদ্বিগ্ন নন আফ্রিদি? (ছবি: রয়টার্স/ফাইল)
তাঁর দেশবাসীদের মতোই আফ্রিদিও সেই মানবাধিকারের কথা বলেছেন এবং রাজনৈতিক বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছেন তবে আমরা যে মানবাধিকারের কথা বলে থাকি সেই মানবাধিকারের কথা বলেননি।
অবশ্য পাকিস্তানিরা কাশ্মীরের উপরে তাদের অন্যায্য দাবিকে ন্যায্য প্রমাণ করতে এক যুক্তি থেকে অন্য যুক্তি সাজিয়ে থাকে। কখনও কাশ্মীরের উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে, কখনও আবার বলে যে ঐতিহ্যগত ভাবে তারা অনেক বেশি করে পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত (অর্থাৎ যে ভূখণ্ড যেটা এখন পাকিস্তান নামে পরিচিত) তাদের দক্ষিণ অংশের চেয়ে (অর্থাৎ ভারতের চেয়ে)। আবার কোনও সময় তারা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় যোগ দিয়ে তাদের দাবিকে সাজানোর চেষ্টা করে। এর উপরে আবারক তাদের যুক্তি হল, দেশভাগের সময় তারা চেয়েছিল কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হোক।
তাদের সব যুক্তিই ছেঁদো এবং কেউই তাদের কথা মানতে রাজি নয়, এই অবস্থায় তারা মানবাধিকারের বিষয়টি খাড়া করতে চাইছে।
তাই আফ্রিদির কথায় কারও আপ্লুত হওয়ার কোনও মানে হয় না আর ওই মানবিকতার কথাও এই প্রথম এমনও নয়।
তবে তিনি শেষ যে কথাটি বলেছেন তাতেই মুশকিলে পড়েছেন এবং তার জন্যই তার পুরো মন্তব্যটাই আলটপকা হয়ে গেছে। তাঁর ‘রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমাধানসূত্র’, ‘কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ’, ‘অমীমাংসিত ও বিতর্কিত’, ‘ভারতের জঘন্যভাবে অধিকৃত’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ প্রভৃতি পুরোপুরিই আইএসআই এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের বুলি ছাড়া অন্য কিছু নয় যে বুলি তিনিও তোতাপাখির মতোই আউড়ে গেছেন। এ সব কথা সর্বত্র অগণিত বার শোনা গিয়েছে।
পাকিস্তান কি এবার চাবুক মেরে বুম বুম আফ্রিদি রব বন্ধ করে দেবে? (ছবি: রয়টার্স/ফাইল)
এই কথায় তাদের রাষ্ট্রের নীতি ও পাকিস্তানের বৃহত্তর সমাজের নীতি – আফ্রিদি লন্ডনে কী বলেছেন সেটা কোনও কথা নয়। তাই ওই মিনিট পনেরোর কথা শুনে যদি ভারতীয়রা মনে মনে খুব তৃপ্তি পেয়ে থাকেন তবে বলব, আফ্রিদি যা বলেছেন সেটি আম পাকিস্তানির মনের কথা নয়, পাকিস্তানের যা নীতি এটা তার কিছুই নয়। তাদের নীতি বদলও হবে না তা সে ভারত নিয়েই হোক বা আলাদা করে কাশ্মীর নিয়ে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে