ভারতের কেন সর্দার প্যাটেলের মূর্তির প্রয়োজন নেই?

যাঁরা দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন তাঁরা অপরাধী, আমরা কেন তাঁদের সম্মান জানাব

 |  3-minute read |   01-11-2018
  • Total Shares

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার সর্দার প্যাটেলের ৬০০ ফুট উঁচু একটি মূর্তি (ঐক্যের প্রতিমূর্তি) উন্মোচন করলেন। এই মূর্তি নাকি বিশ্বের সর্বোচ্চ - স্ট্যাচু অফ লিবার্টির থেকেও লম্বায় চার গুণ বড়। এই মূর্তি তৈরি করতে প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

দেশের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী প্যাটেলকে 'লৌহমানব' ও 'একতার প্রতীক' হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে কারণ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দেশের সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রশাসক হিসাবেও অসাধারণ ছিলেন প্যাটেল। তাঁর ১৪৩ তম জন্মদিনে এই মূর্তিটি উন্মোচন করা হল।

কিন্তু আমি তাঁকে অন্য চোখে দেখি।

আমার মতে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ - যার ফলে ৫০০,০০০ লোক মারা গিয়েছিল ও লক্ষ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে - দেশের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধ।

এটি ব্রিটিশদের একটি কারসাজি। একটি ফালতু দ্বিজাতি তত্ত্বের দ্বারা বিভাজনের রাজনীতি কায়েম করা। যার ফল আমরা আজও ভোগ করে চলেছি।

body_110118051332.jpg৩০০০ কোটি টাকা খরচ করে ঐক্যের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করা হয়েছে [সৌজন্য: ফেসবুক]

তাই, জিন্না, নেহেরু বা প্যাটেলের মতো যে সকল ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা এই সেই সময় এই মর্মে সায় দিয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই আমার চোখে অপরাধী। এদের সম্মানে মূর্তি নির্মাণ কি একান্তই প্রয়োজনীয়?

ভারত ও পাকিস্তান সত্যি সত্যিই এক রাষ্ট্র। মোগল আমল থেকেই আমরা এক ছিলাম (আফগানিস্তানও মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল)। দুই দেশের সংস্কৃতি এক, দুই দেশের নাগরিকদের দেখতে এক রকম এমনকি দুই দেশের নাগরিকরা একই ভাষায় কথা বলেন - হিন্দুস্তানী (ভারতে যাকে হিন্দি বলা হয়, পাকিস্তানে উর্দু)। আমার সঙ্গে যখনই কোনও পাকিস্তানীর দেখা হয়েছে আমি তাঁর মধ্যে কোনও তফাৎ লক্ষ্য করিনি। ভারত ও পাকিস্তান এই দু'দেশের নাগরিকদের যখন বিদেশের মাটিতে দেখা হয় তাঁরা একে অপরের সঙ্গে যে ভাবে মেলামেশা করেন তাতে মনে হয় বুঝি দেশভাগ কোনওদিনও হয়নি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে শুধুমাত্র বহু মানুষকে হত্যা বা উদ্বাস্তু করা হয়নি। এর কিছু সুদূরপ্রসারী প্রভাবও রয়ে গিয়েছে। এর ফলে এই উপমহাদেশের নাগরিকরা আজও দরিদ্র এবং কর্মসংস্থানের অভাব ও অপুষ্টিতে আক্রন্ত সহ নানান সমস্যায় জর্জরিত। দেশভাগের ফলে কৃষকরা আজও চরম দুর্দশায় দিনযাপন করেন এবং এর ফলে আজ অবধি ভারতের প্রায় তিন লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দেশভাগের ফলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব রয়ে গিয়েছে এবং সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন বেড়েছে।

body1_110118051448.jpgদেশভাগ যাঁরা সমর্থন করেছিলেন তাঁদের মূর্তি আমরা স্থাপন করব কেন [সৌজন্যে: ফেসবুক]

বিষয়টি একটু খোলসা করা যাক।

আমরা যদি একটি ধর্মনিরপেক্ষ, শক্তিশালী ও আধুনিক মনস্ক সরকারের অধীনে থাকতাম তাহলে আজ আমরা চিনের মতো বিশ্বের অন্যতম সেরা শিল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারতাম। দেশের হাজার হাজার কৃতী ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানীদের আর সিলিকন ভ্যালি পাড়ি দিতে হত না এবং অঙ্ক, বিজ্ঞান না ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপকরা পশ্চিমি দেশগুলোতে চাকরির খোঁজ করতেন না। সর্বপরি আমাদের নিজেদের হাতে বিশাল পরিমান প্রাকৃতিক সম্পদও থাকত।

উল্টে, আমরা ধর্ম ও জাত পাত নিয়ে লড়াইয়ে মেতে রইলাম। রামমন্দির নির্মাণ, ঘর ওয়াপসি আর গোরক্ষার মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেল ভারতে। অন্যদিকে, পাকিস্তানে আহমদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আতঙ্কে দিন গুজরান করতে লাগল।

শিল্পের দিক থেকে আমরা এতটাই পিছিয়ে রয়েছি যে প্যাটেলের মূর্তি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত কাঁসা আমাদের চিন থেকে ক্রয় করতে হল কারণ এদেশের ঢালাই কারখানাগুলো এই ধরণের কাঁসা বানাতে পারে না।

ভারত পাকিস্তান দু'দেশের খারাপ সম্পর্কের কথা বিচার করে আমরা প্রতি বছর বিদেশ থেকে অস্ত্র কিনতে কোটি কোটি ডলার খরচ করি আর এই বিশাল ব্যয় কিন্তু আমাদের মতো গরিব দেশের সম্বলগুলো ক্রমে ক্রমে নিঃশেষ করে দিচ্ছে (যদিও অস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো এর ফলে প্রভূত লাভবান হচ্ছে)। দেশের জনগণের কল্যাণের ক্ষেত্রে এই অর্থের অনেকটাই বরাদ্দ করা যেত।

ভারত বরাবরই প্রায় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল। এবং, এখনও তাই রয়েছে। ধর্ম যেহেতু খুব শক্তিশালী অস্ত্র তাই আমাদের সমাজও ধর্মীয় ভেদাভেদে বিশ্বাসী। শিল্পায়ন হলে এই ধর্মীয় সমুস্যাগুলো অনেকটাই মেটানো যেত কিংবা পুরোপুরি ধ্বংস করা যেত। এবং তা একমাত্র সম্ভব ছিল যদি আমরা ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক মনষ্ক সরকারের অধীনে থাকতাম। এমন একটি সরকার যা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে প্রশ্রয় দিত কিন্তু মৌলবাদ কিংবা ধর্মান্ধতাকে কঠোর হাতে দমন করত।

কিন্তু দেশভাগ ধর্মীয় ভেদাভেদকে উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিল। এর ফলে সার্বিক উন্নয়ন বাধা পেল কারণ দেশের হিন্দু ও মুসলমানেরা নিজেদের শত্রু বলে ভাবতে শুরু করে দিল। দারিদ্র, কর্মসংস্থান, অপুষ্টি, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবের মতো গুরত্বপূর্ন বিষয়গুলো ভুলে আমরা ধর্ম নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দিলাম।

তাই আমার মতে প্যাটেল মতো যে সব নেতারা দেশভাগের পক্ষে ছিলেন তাঁরা দেশের কোনও মঙ্গল করেননি। তাহলে তাঁদের সম্মানে আমরা কেন খামোকা মূর্তি উন্মোচন করতে যাব?

লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

MARKANDEY KATJU MARKANDEY KATJU @mkatju

Former Judge, Supreme Court of India and former Chairman, Press Council of India

Comment