রাজনীতি কখনোই সৌজন্যমূলক ছিল না, কিন্তু এখন তো সব সীমাই অতিক্রান্ত হয়েছে!
বুঝতে হবে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাই
- Total Shares
রাজনীতিতে সর্বদাই কাদা ছোড়াছুড়ির প্রবণতা ছিল। নির্বাচন জিততে গেলে আপনি কতটা ভালো তা কাজে দেয় না, বরঞ্চ প্রতিপক্ষকে কতটা খারাপ প্রতিপন্ন করতে পারলেন তার উপরই নির্ভর করবে আপনার নির্বাচন জয়ের ভাগ্য।
খুব সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে, নির্বাচন জিততে গেলে কাজ নয়, আপনাকে সবচেয়ে সহজ ও সরল উপায়টির উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক দলের হিলারি ক্লিনটনকে 'ক্রুকেড' বলে সম্বোধন করে বাজিমাত করেছিলেন। ক্লিনটন পাল্টা দিতে চাননি। আর এর মাসুল তাঁকে দিতে হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং একটা সময়ে একটা চিরকুট বের করে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বরের কথা শোনাতেন। তাঁর দাবি ছিল, এটা সেই অ্যাকাউন্ট নম্বর যেখানে 'বফর্স কেলেঙ্কারি'র টাকা জমা পড়ত। এই দাবি মিথ্যা বৈ আর কিছুই নেই। অথচ এই দাবির জোরেই মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ৪১৪ থেকে ১৯৭ তে এসে ঠেকেছিল।
রাজনৈতিক সৌজন্যের ধার ধারেন না ডোনাল্ড ট্রাম্প [ছবি: এএফপি]
আসল যে কোনও খবরই দ্রুত ছড়ায়, বিশেষ করে সেই খবর যদি মশলাদার হয়। আর দেশের সংবাদমাধ্যম যদি চটকদার খবর প্রচারের ব্যাপারে সব সময়ই আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে তা হলে তো আর কোনও কথাই নেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই বিষয়গুলো একেবারেই নিম্ন রুচিতে এসে ঠেকেছে। রাজনৈতিক শত্রুতা এখন যে ধারায় বইছে তাতে যে কোনও কিছুই সম্ভব।
টিভি চ্যানেল খুলে দেখুন। দেখবেন রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থকরা সর্বদাই নিজেদের মধ্যে লড়াই করে চলেছেন। যেন কোনও কুস্তি প্রতিযোগিতা চলছে। তারই প্রভাব পড়ছে পথে ঘাটে। সন্ত্রাস এখন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে উঠেছে।
ভিপি সিং কথায় কথায় একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কথা বলতেন [ছবি: পিটিআই]
এই দৃশ্য শুধুমাত্র একটি টিভি দৃশ্যের নয়, এই দৃশ্য এখন কাউকে কাউকে আঘাতও করতে পারে। একটি জাতীয় হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রতি একটি উদাহরণ পাওয়া গিয়েছিল। যেই অনুষ্ঠানে কয়েকজন সাধারণ দর্শকও উপস্থিত ছিলেন।
বিজেপির মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র সেই টিভির অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন। সম্বিৎ পাত্রর এখন একমাত্র লক্ষ্য নিজেকে সোশ্যাল সেলিব্রিটি করে তোলা। তা করতে গেলে তাঁর কণ্ঠস্বরই যথেষ্ট। কিন্তু সেই কণ্ঠে তিনি যে কথাগুলো বলছেন তাতে কতটা সত্যতা রয়েছে তা নিয়ে তিনি বিশেষ মাথা ঘামান না, যা মনে আসে তাই বলে যান।
জওহরলালকে ঠগ অফ হিন্দুস্তান বলেছেন সম্বিত পাত্র [সৌজন্যে: নেহরু ওয়েবসাইট]
এই অনুষ্ঠানে যেমন তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দুম করে 'ঠগ অফ হিন্দুস্তান' বলে বসলেন, দেশের আরও দুই শহিদ হওয়া প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে তিনি 'ডাকাত' বলে সম্বোধন করলেন। স্বভাবতই, সম্বিৎ পাত্রর হাত (মুখ) থেকে নিস্তার পাননি সোনিয়া গান্ধী আর রাহুল গান্ধীও।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাত্রের কংগ্রেস প্রতিদ্বন্দ্বী রাজীব ত্যাগী এহেন মন্তব্যে বিস্মিত হয়ে পাল্টা দিলেন - 'চৌকিদারই চোর'। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকরা পিলপিল করে স্টেজে উঠতে শুরু করে দিয়েছেন।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কী করবেন তা আর বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সম্বিৎ পাত্রের হাসি মুখ দেখে মনে হল তিনি যেন এমনটাই চাইছিলেন। ইতিমধ্যেই দর্শকরা চেয়ার ভাঙতে শুরু করে দিয়েছেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা যদি কারও হাড়ও ভেঙে থাকে তাহলে আমি অন্তত অবাক হব না।
এটা সত্যি যে বহু যুগ ধরেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মধ্যে ভুলভাল অভিযোগ কিংবা মানহানিকর মন্তব্য করার ধারা চলে আসছে।
কিন্তু ২০১৪ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে যা শুরু হয়েছে তা অভাবনীয়। যে ভাবে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করে চলেছেন তা সব সীমাই অতিক্রম করে ফেলেছে।
একটা কথা বলতে হবে, যে কোনও রাজনৈতিক সংস্কৃতি আসলে রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারাই তৈরি হয়। আমাদের ভাষা যদি খারাপ হয়ে গিয়ে থাকে তার জন্য রাজনৈতিক নেতারাই দায়ী।
যদি শাসক দলের নেতা নেত্রীরাই দেশের চরিত্র ঠিক করে দেন তাহলে প্রতিটি নির্বাচনেই বদলা নেওয়ার সুযোগ আসবে। আমরা কি তার আগে আমাদের পুরোনো দিনের রাজনৈতিক শালীন ব্যবহারকে ফিরিয়ে আনতে পারি না? যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনও শালীনতার মাত্রা ছাড়াবে না।
২০১৯ সালে সেই পরীক্ষায় বসতে হবে ভারতকে। বছর খানেক বাদে আমেরিকাকেও। তখন পুরো দুনিয়া আমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে