শবরীমালা: কংগ্রেস বিজেপি দুই দলই মনে করছে আইনের ঊর্ধ্বে ধর্মীয় বিশ্বাস
রাজনৈতিক নেতারা যাই বলুক না কেন শবরীমালা মামলা এখন আর শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় নয়
- Total Shares
শুধু মাত্র সংখ্যার বিচারে নয়, ভোটের বিচারেও দেশের সর্ববৃহৎ দলটির নাম বিজেপি। দলটির জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ দলের অন্দরে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু এহেন সভাপতিকে নিয়ে আশঙ্কারও অন্ত নেই। বিশেষ করে যখন তিনি সুপ্রিম কোর্টকে পরামর্শ দেন যে দেশের শীর্ষ আদালত যেন এমন কোনও রায়দান না করে যা কার্যকর করা অসম্ভব কিংবা যখন তিনি হুমকি দেন যে কোনও সরকার আদালতের রায় কার্যকর করলে সেই সরকার তিনি ফেলে দেবেন -- তখন তো আতঙ্কিত হওয়ারই কথা।
এরপর যখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল মনে করে যে আইন রক্ষার ধর্মের চেয়েও ধর্ম রক্ষার আইন বেশি প্রয়োজনীয় তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
রাজনৈতিক নেতারা যাই বলুক না কেন, শবরীমালা বিষয়টি এখন আর শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় হিসাবে সীমাবদ্ধ নয়।
শবরীমালা নিয়ে সুর চড়ালেন অমিত শাহ [ছবি: পিটিআই]
মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কি দেশের আইনের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে - শবরীমালা বিতর্কে এই প্রশ্নটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিতর্কে শেষ হাসিটা কে হাসবে - সংবিধান স্বীকৃত দেশের শীর্ষ আদালত নাকি একটি ধর্মের অনুভূতি যার দ্বারি কিনা একটি রাজনৈতিক দল অনুপ্রাণিত।
আযোধ্যা মামলার শুনানি এখনও বাকি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আদালতের বিরুদ্ধে ধর্মভীরুদের ক্ষেপিয়ে দিতে চাইছে। উল্টোদিকে, এই ধারাকে প্রতিরোধ করার কোনও লক্ষণই বিরোধীদের মধ্যে চোখে পড়ছে না।
বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিপজ্জনক
সুপ্রিম কোর্টের রায় বিজেপির পছন্দসই না হতেই পারে। এর জন্য বিজেপি রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাতেই পারে। শাসক দল হিসেবে এই রায়ের প্রেক্ষিতে অর্ডিন্যান্স জারির জন্য সরকারকে ভাবাতেই পারে বিজেপি। এর আগে তফসিলি জাতি ও উপজাতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স জারি করে ছিল বিজেপি সরকার।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিজেপি তো আইনের পথে হাঁটার কোনও চেষ্টাই করছে না।
তা না করে দলীয় কর্মীরা বেশ কয়েকটি দক্ষিণপন্থী সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে মন্দির অবরোধ করে চলেছেন। দলের প্রধান নেতা এই কর্মীদের বাহবা দিচ্ছেন আর প্রকাশ্যে হিংসা ছড়াবার হুমকি দিয়ে চলেছেন।
অমিত শাহের হুমকি, "আমি পিনারাই বিজয়নকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনি যদি এই অত্যাচার বন্ধ না করেন তা হলে বিজেপি কর্মীরা আপনাকে উচিত জবাব দেবে। আপনার সরকারও বেশি দিন স্থায়ী হবে না।"
জনগণের ভোটে সরকার গঠিত হয়। বিরোধীরা সরকার ফেলতে পারে না। তাহলে বিজেপি প্রধান একটি নির্বাচিত সরকারকে কী শিক্ষা দিতে চাইছেন?
শাহ জানাচ্ছেন, "আমি সরকারকে ও আদালতে যাঁরা রায়দান করেন তাদের একটা কথাই বলতে চাই - এমন আইন প্রণয়ন করুন যা কার্যকর করা সম্ভব, যা মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করে না।"
এখানে উল্লেখ্য, অমিত শাহের কথায় একটা জিনিস পরিষ্কার। তিনি শুধু শবরীমালা মামলার কথা বলেছেন না। তিনি আসলে একটি বিশেষ ধরণের মামলার কথা উল্লেখ করছেন।
একটি রায় কোন কোন যোগ্যতার উপর নির্ভর করবে?
সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুভূতি?
আইন কার্যকরের ক্ষেত্রে সরকার সদ্দিচ্ছা?
শবরীমালা মামলাটিকে যে বিজেপি হাতিয়ার করবে তা বলাই বাহুল্য। হাজার হোক একটি কমিউনিস্ট শাসিত রাজ্যে হিন্দুদের বিশ্বাসকে আঘাত করা হচ্ছে। সরকার যদি এবার আন্দোলনকারীদের উপর বল প্রয়োগ করে তা হলে এই আন্দোলনের ক্ষীর পুরোটাই বিজেপি খাবে।
গেরুয়া শিবির একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে - নির্বাচন যুদ্ধ জিততে আইন, গণতন্ত্র কিংবা বিশ্বাস -- এগুলি এক একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশেরও বিরোধিতা করছে বিজেপি [ছবি: পিটিআই]
বিরোধীরা কী ভূমিকা পালন করছে?
কংগ্রেস কী করছে?
কংগ্রেসের ভাবমূর্তি খুব পরিষ্কার - 'জাতীয় স্তরে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বল, কিন্তু স্থনীয় স্তরে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠ'। আর, এই ভাবমূর্তি নিয়েই কংগ্রেস শবরীমালার ভক্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
২৯ অক্টোবর কেরলের বিধায়ক ভিটি বলরাম এলডিএফ সরকারকে সমর্থন করে জানিয়েছেন যে তাঁর দল "হিন্দুদের সমর্থন করে, আন্দোলনকারীদের নয়"।
কিন্তু এই পরিস্থিতি ভক্ত আর আন্দোলনকারীদের আলাদা করে দেখা যাবে না। যাঁরা যারা নির্দিষ্ট একটি বয়সের মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশের বিরোধিতা করছে তারা প্রত্যেকেই সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কার্যকর করতে বাধা দিচ্ছে।
কংগ্রেস যদি সত্যি সত্যি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চায় তাহলে তাদের অনতিবিলম্বে আদালতের রায় কার্যকর হওয়ার পক্ষ নিতে হবে। কংগ্রেসও চাইলে, ভক্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আইনের পথে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
কিন্তু কংগ্রেসও এই বিষয়টির থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে নায়ার হিন্দুরা। এবং নায়ার হিন্দুদের ভোট যদি বামপন্থীদের ঝুলিতে না পড়ে তাহলে তা কংগ্রেসের ঝুলিতেই পড়বে। কারণ কেরলে বিজেপির চাইতে কংগ্রেসের অস্তিত্ব ঢের বেশি।
মুদ্রার উল্টোপিঠও রয়েছে।
কংগ্রেস আসলে বিজেপির মাটি ক্রমশ শক্ত করে দিচ্ছে। কংগ্রেস যদি প্রথম দিন থেকে দেশের আইনের পক্ষে থাকত তা হলে পরিস্থিতি এতটা জটিল হত না।
দুই, নিজের ক্ষেত্রেও সুবিচার করতে পারছে না কংগ্রেস। শবরীমালা মামলায় কংগ্রেস যে পথে হাটছে তাতে কোনও মতেই তাদের আদর্শ যে বিজেপির আদর্শের উপরে তা দাবি করতে পারবে না কংগ্রেস।
অন্ধকার দিনগুলোর শুরু হল বলে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে