আরএসএসের নিরামিষাশী বাহিনী কি পাকিস্তান ও চিনের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে
এখন কোন সেনাবাহিনী ভারতের সীমান্ত রক্ষা করছে - ভারতীয় সেনাবাহিনী নাকি আরএসএসের সেনাবাহিনী
- Total Shares
দেখে শুনে মনে হচ্ছে ভারতের দু'দুটি সেনাবাহিনী রয়েছে। একটি ভারতীয় সেনাবাহিনী যারা বছরভর দেশের সীমান্ত পাহারা দেয় এবং প্রয়োজন পড়লে বিপর্যয় মোকাবিলায় যোগ দেয়। অন্যটি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ও বিজেপি (বিজেপি)।
রাষ্ট্রের অধীনে যে সেনাবাহিনী কাজ করে তারা কিন্তু বহু জাতি প্রথায় বিশ্বাসী। নিজেদের শারীরিকভাবে প্রস্তুত রাখতে তারা বিশ্বমানের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। তারা গোটা দেশেরই রক্ষাকর্তা, নির্দিষ্ট কোনও অঞ্চলের নয়।
তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস আনাজপাতি সবই রয়েছে। আবহাওয়া, পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে তারা তাদের প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকা ঠিক করে।
বিভিন্ন কঠিন অঞ্চলে - পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা যে অঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বদা হিমাঙ্কের নিচে থাকে - চিন কিংবা পাকিস্তানের মোকাবিলা করার জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ায় হয়। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে ভারতকে রক্ষা করতে গিয়ে শ'য়ে শ'য়ে সেনাবাহিনীর জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে।
এখন কোন সেনাবাহিনী ভারতের সীমান্ত রক্ষা করবে? [ছবি: রয়টার্স / ইন্ডিয়া টুডে]
যাদের রক্ষা করছে তাদের জাত, ধর্ম, খাদ্যাভাস কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে সেনাবাহিনীর কোনও মাথাব্যথা নেই। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
করা ক্ষমতায় রয়েছে সে বিষয়েও কোনও মাথাব্যথা নেই সেনাবাহিনীর, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি বা সেই দল আমজনতার ভোটে জিতে ক্ষমতা দখল করেছে।
দেশের 'অন্য' সেনাবাহিনীর জওয়ানদের অবশ্য 'স্বরসঙ্ঘচালক' (আরএসএস প্রধান) নিযুক্ত করেন। আরএসএস এই জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখায় নিয়োগ করা হয়। এই সেনাবাহিনী হিন্দুত্ব তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং হিন্দুধর্মের বর্ন প্রথার রক্ষাকর্তা - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, চণ্ডাল ও বনবাস।
এই জওয়ানদের খুব কঠোর শর্তে নিয়োগ করা হয়ে থাকে - সঙ্ঘে যোগ দেওয়ার পর তারা শুধুমাত্র নিরামিষ খাবে এবং গোমাতার পুজো করবে, স্থানীয় সংস্কৃতি তা মানুক বা না মানুক। যারা এই সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে তাদেরকে প্রত্যেক গোমাংস ভক্ষণকারীদের অ-ভারতীয় হিসেবে মান্যতা দিতে হবে।
কোনও মুসলমান বা কোনও খ্রিস্টান (যদি না ধর্ম পরিবর্তন করে থাকে) এই সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে না। জৈন ও বৌদ্ধদের যোগ দেওয়ার অধিকার রয়েছে যদি তারা হিন্দুত্ব তত্ত্ব মেনে চলতে রাজি হয়।
অমিত শাহ এই সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, যিনি বর্তমানে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা বিজেপির প্রধান নেতা। গোমাংস ভক্ষণকারীদের যারা পাকিস্তান পাঠাতে চেয়েছে তাদেরকে তিনি মাঝে মধ্যেই সমর্থন করেন বলে শোনা যায়।
এই আরএসএস সেনাবাহিনীর প্রধান মোহন ভগবৎ একবার বলেছিলেন, "একটি সেনাবাহিনী তৈরি করতে ছয়ে থেকে সাত মাস সময় লাগে। কিন্তু আমরা (আরএসএস ক্যাডাররা) মাত্র দু'তিন দিনের মধ্যেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই....... আমাদের অনুশাসন ও কর্মদক্ষতা এতটাই।"
এখন যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তখন কোন সেনাবাহিনী ভারতের সীমান্তে টহল দেবে? আরএসএসের নিরামিষাশী বাহিনী, নাকি সব ধরণের খাদ্যাভাসে বিশ্বাসী ভারতীয় সেনাবাহিনী?
আরএসএস বাহিনী যে এখনও সীমান্তে পৌঁছায়নি তা গোটা দেশই জানে।
আরএসএস প্রধান মোহন ভগবৎ জানিয়েছিলেন যে সেনাবাহিনীর থেকে আরএসএস ক্যাডাররা দ্রুত প্রশিক্ষণলাভ করে [ছবি: রয়টার্স]
কিন্তু, কেন?
একজন দক্ষিণ ভারতীয় হিসেবে আমি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একমত, জঙ্গিদের ভারতের মাটিতে হামলার মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত। চিনও যাতে ভারতের এক ইঞ্চিও জমি দখল করতে না পারে সে দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
এই নিরামিষাশী সেনাবাহিনী কি পাকিস্তান ও চিন সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে পারবে?
বিশ্বে আর কি কোনও দেশ রয়েছে যেখানে শাসক দল নিজের দেশের লোকের খাদ্যাভাসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে? তাদের এহেন আচরণের জন্য তারা একটি যুক্তিও দিয়ে থাকে - মুসলমান দেশগুলোতে শুয়োরের মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই আমরা এদেশে গোমাংসের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করব। মানছি, মুসলমান দেশগুলোতে এমন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সেই হরপ্পা সভ্যতা থেকেই তো ভারতবর্ষ অন্যদের খাদ্যাভাসকে সম্মান জানিয়ে এসেছে।
গো-হত্যার বিরোধিতা করে, গোমাংস ভক্ষণকারীদের উপর আক্রমণ করে আরএসএস সেনাবাহিনী নিঃসন্দেহে এই দেশকে দুর্বল করে তুলেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নোটিস পাঠিয়ে জানানো হয়েছে যে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেন নিরামিষ খাওয়ারই সরবারহ করা হয়। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং তো মিডডে মিল থেকে ডিমও বাতিল করে দিয়েছে।
সরকারি বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াও বিমানের খাদ্যতালিকা থেকে আমিষ খাবার সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরএসএস কী ভাবছে, হরপ্পা সভ্যতা থেকেই কি ভারতবর্ষ শুধুমাত্র নিরামিষাশী ছিল? বৈদিক যুগে কি আনাজের ফলন হত? দুগ্ধজাত্য পণ্য অবশ্য ভারতে বহুবছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমাদের খাদ্য অর্থনীতির নামই ছিল "মাংস ও দুধের অর্থনীতি"। তার আর এখন আর পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।
আরএসএসের খাদ্যতালিকা মেনে চলাটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে [ছবি: রয়টার্স]
আরএসএস আরও বলেছে যে মানুষের কল্যানে তাদের ক্যাডাররা ভারতের গ্রামেগঞ্জে ও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে কাজ করে। তারা কি জানে যে আদিবাসীরা মাছ মাংস ও গোমাংস ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না?
তারা কি শূদ্র, দলিত কিংবা আদিবাসীদের দেখতে পায়না? এরা তো কঠোর পরিশ্রম করে এই দেশকে গঠন করেছে। মাংস না খেলে তারা কি এতটা কঠোর পরিশ্রম করতে পারত?
জোর করে নিরামিষাশী করে তুলতে চাইলে দেশের উৎপাদন শিল্পের কী অবস্থা হবে যেখানে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে?
ভারতে যখন যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে তখনও তারা সাধু সন্ন্যাসীদের প্রাধান্য দিয়ে চলেছে। আসলে এই সাধু সন্ন্যাসীরা যে তাদের এই নিরামিষাশী জাতীয়তাবোধকে সমর্থন করবে এবং কেন গোমাংস বা অন্যান্য মাংসের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন তাও ব্যাখ্যা করে দেবে।
গরু নিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সেই ষাটের দশক থেকেই শুরু করেছে আরএসএস। বেশ কয়েকটি উত্তর ভারতের রাজ্যকে এই জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করতে সফল হয়েছে তারা।
তাদের কাছে, মাংস ও গোমাংস 'মুসলমানদের খাবার' - তা কখনই মানবজাতির খাদ্য নয়। আর, তাই তারা শিশুদের অপুষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে নিয়ে ভাবতেও চায় না।
আরএসএসের দ্বিতীয় লক্ষ হল দেশকে যোগাভ্যাসে উজ্জীবিত করে তোলা। এর মধ্যে অবশ্য দৌড় কিংবা অন্যান্য অ্যাথেলিটিক্স পড়ে না। উইং কমান্ডার অভিনন্দন যদি ইজেক্ট না করে ককপিটে যোগব্যায়াম করতেন তাহলে কি বেঁচে ফিরতে পারতেন?
দুর্ভাগ্যবশত, এখন কংগ্রেস আবার এই গরু ও নিরামিষাশী রাজনীতি নিয়ে বিরোধিতা শুরু করেছে। যা আরও বিপজ্জনক।
খাদ্যাভাস নিয়ে এই ফ্যাসিবাদী আচরণ বন্ধ করার সময়ে এসেছে, যাতে আমরা শত্রুর মোকাবিলার জন্য শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারি।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে