গুজবের শিকার রোহিঙ্গারা, তাই জম্মুতেও তাদের দিন কাটছে আতঙ্কে
জঙ্গি হামলার জন্যে দায়ী শরণার্থীরা, অভিযোগ স্বয়ং রাজ্যের বিধানসভার অধ্যক্ষের
- Total Shares
আতঙ্কে রয়েছেন জম্মুতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে তাকে শারীরিক বা চারিত্রিক দিক দিয়ে খুব একটা তফাৎ নেই। তাঁরাও মানুষ। কিন্তু কোথাও একটা যেন তাঁরা শহরের অন্যান্য বাসিন্দার চেয়ে আলাদা।
হবে নাই বা কেন? এখন ভারতে শরণার্থী নিয়ে আলোচনা শুনতে পাওয়া মানেই তাঁদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথাই শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু যেন তাঁদের দুঃখ দুর্দশার কথা বুঝতেই চায় না।
আপনার নিকট আত্মীয়দের অবলীলায় হত্যা করা হচ্ছে, আর প্রাণের ভয় নিজের ভিটে মাটি থেকে পালিয়ে এসে কয়েকহাজার দূরে অবস্থিত অন্য একটি দেশে আপনি আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন - বিষয়টি একবার ভেবে দেখুন তো। তাঁদেরকে 'অন্য দেশের নাগরিক' হিসেবে গণ্য করা যেতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁদের দুঃখ দুর্দশা আমরা উপলব্ধি করতে পারব না।
রোহিঙ্গাদের প্রধান চিন্তা; দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোগাড় করা
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের শুরুতে প্রায় ৬,০০০ রোহিঙ্গা ছিল জম্মু ও কাশ্মীরে। নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ক্রমাগত নিপীড়িত হয়ে এই শরণার্থীরা গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়েছে। ভারত সরকার বরাবরই শরণার্থীদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই মনোভাবের কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে। এ বছর ১৬ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফ থেকে সুপ্রিম কোর্টকে জানানো হয়েছিল যে জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে শুধুমাত্র যাদের বৈধ কাগজপত্র রয়েছে তাদেরকেই যেন দেশে প্রবেশ করবার অনুমতি দেওয়া হয়।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই এর পর থেকে জম্মুতে বসবাসকারী শরণার্থীদের জীবনে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
স্থানীয়দের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র তীব্র অসন্তোষ লক্ষ করা গিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন এই অসন্তোষ আদতে রাজনীতিরই অঙ্গ। অনেক রাজনৈতিক নেতাই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন জারি করে জানানো হয়েছে যে অঞ্চলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে এই রোহিঙ্গ্যারা আর তাই তাদের অবিলম্বে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হোক।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কাঠুয়ার আইনজীবীরা
মাত্র কয়েকহাজার শরণার্থী কী ভাবে একটি অঞ্চলের জনতত্ত্ব বদলে ফেলতে পারে তা নিয়ে অহেতুক স্থানীয়দের আতঙ্কিত করে তোলা হল। যদিও রোহিঙ্গারা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে যে এত কম সংখ্যক লোক দেশের ডেমোগ্রাফিতে এতটা প্রভাব কী ভাবে বিস্তার করতে পারবে? তাদের অনেকেই এই প্রশ্নও তুলেছে যে এই আশঙ্কা কেন শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই করা হচ্ছে? দেশভাগের সময় কয়েক লক্ষ শরণার্থী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে জম্মুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কই তাদের ক্ষেত্রে তো এ ধরণের আশঙ্কা করা হচ্ছে না। নীরবে প্রশ্ন করে চলেছে জম্মুর রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও কিছুই প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রতি স্থানীয়দের ঘৃণা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর প্রধান কারণ রাজনীতি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থানীয়দের খামোকা আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে। অনেকেই এই বলে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করছেন যে রোহিঙ্গারা এদেশে থেকে যাওয়া মানে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। অনেকেই বলছেন যে রোহিঙ্গাদের এ দেশে ঢুকতে দেওয়া মানে জোর করে ধর্মান্তরের চেষ্টা চলবে। কিছু ক্ষেত্রে তো আরও প্রাসঙ্গিক অভিযোগ আনা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে।
জঙ্গি আক্রমণের জন্যেও দায়ী করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের [ছবি; পিটিআই]
আর এই অভিযোগ করেছেন স্বয়ং জম্মুকাশ্মীর বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ। ফেব্রুয়ারী মাসের ১০ তারিখে সুনজ্বন মিলিটারি স্টেশনে একটি জঙ্গি হানা হয়েছিল। রাজ্যের বিধানসভার অধ্যক্ষ সরাসরি বলে দিলেন যে ওই এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আছে আর তাই জন্যেই খুব সম্ভবত এই জঙ্গি আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে। এর পরেই রাজ্যের অনেকেই এই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু, এখনও অবধি, তদন্তকারীরা এ বিষয় কিছুই প্রমান করতে পারেনি।
তৃণমূলের স্তরে সত্যটা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম।
বাস্তবে, এই শরণার্থীরা নিগৃহীত হয়ে এদেশে এসেছেন। তারাও মানুষ যাদের সর্বদাই দুর্ভাগ্য তাড়া করে বেড়ায়। তারা সামান্য একটু সাহায্যের আশায় মরণপণ লড়াই করে চলেছে। তাদের অধিকাংশেরই একটাই চিন্তা - কী ভাবে পরিবারের জন্যে দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোগাড় করা যায়?