বাংলার পাহাড়ে নতুন শরণার্থী, এরা কি রোহিঙ্গা?
বিমল গুরুঙের চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে: পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছে
- Total Shares
গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড় জুড়ে ১০৪ দিন আন্দোলনের এক বছর কেটে গেছে। পাহাড়বাসী দিশাহারা জীবনযাপন থেকে পুরনো ছন্দে ফিরে যাচ্ছে। এমন সময় পাহাড় জুড়ে ফের অস্তিত্বসঙ্কটের শঙ্কায় গোর্খা জনজাতি। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গত এপ্রিল মাসে এক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঘিরে। ওই ফরওয়ার্ডেড মেসেজ ক্লিপিংয়ে দেখা গেছে, শতাধিক মানুষ (স্কাল ক্যাপ পরিহিত) একাধিক বাস থেকে কালিম্পং শহরে নামছে। এরা সবাই রোহিঙ্গা শরণার্থী বলে মেসেজটি ভাইরাল হয়।
কালিম্পংয়ে যারা ক্যাম্প করেছে তাদের পরিচয় নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
পরিস্থিতি নজরে ছিল জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারেরও। স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাসুদ সুলতান সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেন, "এরা কেউ রোহিঙ্গা শরণার্থী নয়, ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনার জন্য সবাই দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা থেকে পাহাড়ে এসেছে।" আরও বলেন যদি কালিম্পং ও পাশ্ববর্তী এলাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের যাতায়াত বেড়ে যায় ধরে নিতে হবে তাঁরা সবাই কাজের খোঁজে এখানে এসেছে। আনজুমান ইসলামিয়া মসজিদের ইমামের কথার সূত্র ধরে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান বিনয় তামাংও পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীর অস্তিত্বের অভিযোগ খারিজ করেন।
ঘটনা অন্য মাত্রা পায় চলতি বছরের ২৭শে এপ্রিলের একটা চিঠিকে নিয়ে। চিঠিটা লেখা হয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে। লেখক গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সুপ্রিমো বিমল গুরুঙ্গ। গত বছর থেকে বিমল ও তার পরিবার পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে পাহাড় ছেড়েছে। চিঠিতে বিমল সরাসরি অভিযোগ করেন পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছে এবং পিছনে রয়েছে দার্জিলিং ও পার্শ্ববর্তী জেলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করার গভীর ষড়যন্ত্র। বিমলের চিঠি প্রকাশ পাওয়ার ক’দিন পর দার্জিলিং এর বিজেপি সাংসদ এস এস আলুয়ালিয়া প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন। বিষয়বস্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ। আলুওয়ালিয়া দার্জিলিংয়ের ভৌগোলিক অবস্থান, আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং চিকেন নেকের প্রসঙ্গ টেনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ দেশের পক্ষে কতটা শঙ্কার তা প্রধানমন্ত্রীকে জানান। আলুওয়ালিয়া চিঠিতে কালিম্পং এর ডেলো, লাভা, মেল্লি ও রংপো গ্ৰামে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অস্তিত্বের অভিযোগ করেন।
দেখলেই বোঝা যায় যে ছাউনিগুলি খুব একটা পুরোনো নয়
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে গ্ৰাউন্ড জিরো পৌঁছে গেলাম। কালিম্পং শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাংলা সিকিম সীমান্তে তিস্তার পারে মেল্লি ছোট একটি গ্ৰাম মেল্লি বাংলা সিকিম দুই রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত। তিস্তার ওপরে সেতু রয়েছে, যা সিকিমে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। এই সেতুটির নিচে বেশ কয়েকটি টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর চোখে পড়ল। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোতে যারা রয়েছে তাদের আদব কায়দা, পোশাক দেখে বুঝলাম ওরা মুসলিম। প্রায় তিরিশ পরিবার বসবাস করছেন। কথাবার্তায় বুঝলাম এক দুই বছরের মধ্যে এখানে এসেছে। কেউই মুখ খুলতে চাইছে না। বরং কে, কী, কেন এ ধরনের প্রশ্ন আমায় করা হল।
একটা চায়ের দোকানে বসে আলাপ হল স্থানীয় ছেলের সঙ্গে, নিজেকে নেপালি মুসলিম বলে পরিচয় দিল। সে ওই টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোতে থাকে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, "আমরা ৩০-৪০ ঘর মুসলমান পরিবার কাজের জন্য এখানে বাস করছি। আমরা এখানকার আদি বাসিন্দা। আমাদের কয়েকজন আত্মীয় নতুন এসেছে কাজের জন্য, বাইরের কেউ নেই।" কাজ বলতে এরা বেশিরভাগ দিনমজুর, কুড়ানির কাজ করে-- মূলত প্লাস্টিকের বোতল, গাড়ির টায়ার, পুরোনো লোহার সরঞ্জাম। কেউ কেউ আবার রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে।
ঘরগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছে বেশি পুরোনো নয়। বস্তির মতো বাঁ হাত ডান হাতে পরপর ছোট ছোট ঘর। তিস্তার পারেই সকলের ব্যবহারের জন্য পাবলিক টয়লেট রয়েছে। কনস্ট্রাকশন দেখে মনে হচ্ছে মাস কয়েক আগে তৈরি করা হয়েছে। টয়লেট থেকে সরাসরি ডান হাতে বানানো হয়েছে মসজিদ। বার্নিশ করা কাঠের চকচকে দরজা। সবকিছু তৈরি হয়েছে ব্রিজের নীচে সরকারি জমিতে। এক মহিলা কথায় কথায় বলল "তিস্তার জল বেড়ে কি দুর্দশা হয়েছে। কয়েক মাস আগে দুটো বাচ্চা নাকি নদীতে ভেসে আসা কাঠ কুড়ানোর সময় নিখোঁজ হয়েছে।" বাচ্চাদের পরিবার কোথায় থাকে জানতে চাইলাম। উত্তর এল-- "ছোটা পাকিস্তান"। চমকে উঠলাম। মহিলা বলল, পঞ্চাশের বেশি পরিবার আরেকটু দূরে এরকমই টিনের ছাউনি দেওয়া ক্যাম্পে থাকে ওটাকেই ওরা "ছোটা পাকিস্তান" বলে। আর আমি যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা কী? মহিলা হেসে বলল "পাকিস্তান, কাউকে বাইরে বলবেন না"। মহিলা নিষেধ করলেও সবার কাছে ঐ জায়গায়টা "ছোটা পাকিস্তান" বলে পরিচিত। গাড়ি নিয়ে পরের গন্তব্য "ছোটা পাকিস্তান"। একই রকম টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর, তাতে কারও ডিস টিভি লাগানো। আমার উপস্থিতি কারোর পছন্দ হয়নি, কবে থেকে এখানে এসেছে, গত বছর তিস্তার জল কতটা উঠেছিল, এসব প্রশ্নের জবাব পেলাম না। সবাই হিন্দি নেপালী মিশিয়ে কথা বলছে। বাংলা জানে না। অনেকের দাবি তারা এখানে বহু বছর ধরে রয়েছে। কিন্তু আমার ফিক্সার রাজ তামাং কথোপকথন শুনে নিশ্চিত ওঁরা যে নেপালি বলছেন সেটা সদ্য শেখা। কিন্তু ক্যাম্পের বাচ্চারা? স্পষ্ট শুনতে পেলাম বাংলা বলছে, শুনতে চলতি না হলেও বাংলা ভাষা। অনেকটা রোহিঙ্গাদের বাংলার মতো। তাহলে ওরা কারা? সত্যিই কি রোহিঙ্গা শরণার্থী? অনেকের দাবি তাদের আধার কার্ড আছে। দেখতে চাইলে কেউ বলছে বানাতে দিয়েছি, কেউ আবার মারমুখি।
কালিম্পং শহরে অচেনা মানুষজনের যাতায়াত বেড়ে গেছে সে কথা প্রায় সকলেই বলেছেন। ক্লক টাওয়ার সংলগ্ন বাজারের এক দোকানদার বলল, "কাজ করতে অচেনা লোকজন আসছে অনেকদিন ধরে কেউ কেউ আর ফিরে যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা শরণার্থী কি না জানি না তবে দিনমজুরের কাজ করতে যারা আসছে বেশিরভাগ মুসলিম।" এ রকমই কালিম্পং শহরে কাজ করতে আসা দিন মজুরদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বাধা পেলাম। থানার উল্টো দিকে ফুটপাতে বসে থাকা দিনমজুরদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু হতে সর্দার গোছের একজন ধমকে চুপ করাল। নিমেষে সবাই এলাকা ছেড়ে চলে গেল। তাহলে ওরা কারা?
কালিম্পং মেন রোডের এক হোটেল মালিক বললেন, "বহুবছর ধরে কালিম্পং শহরে ঠাকুরবাড়ি এলাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। শতাংশের হিসাবে সামান্য। তাঁরা প্রত্যেকেই তিন চার পুরুষ ধরে বাস করছে। ওদের আদব কায়দা, পোশাক সবকিছুই আমাদের মতো। এমনকি ওরা আমাদের ধর্মীয় উৎসবে যোগ দেন, কেউ কেউ এখানে নেপালী হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মে বিয়ে করেছে। কিন্তু বর্তমানে কালিম্পংয়ে কিছু মুসলিম পরিবার এসেছে যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো নয়। মূলত মেল্লি রোডে ওরা থাকে। গত বিশ বছর ধরে মেল্লি রোডে একটি পর্ক শপ ছিল, বারবার ওরা প্রতিবাদ করতে প্রশাসনের উদ্যোগে দোকানটা বন্ধ করা হয়।"
দার্জিলিং এর বিমল শিবিরের এক গোর্খা নেতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি রাজ্য সরকার মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির নিন্দা জানিয়ে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী এবং তার দল পাহাড়ের শান্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দিচ্ছেন। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকে পঙ্গু করে পাহাড়বাসিকে দ্বিধা বিভক্ত করে সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন।"
পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কি লাভ? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল দার্জিলিং আসনটি দখল করতে চায়। বর্তমানে সেটি বিজেপির দখলে। ইতিমধ্যে জিটিএ তৃণমূল ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অঙ্গুলি হেলনে কাজ করছে। অন্যদিকে বিমল গুরুঙ্গ, রোশন গিরিদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। দেশে ফিরলেও ওরা গ্ৰেপ্তার হবে। যদিও দার্জিলিং এর মানুষ মনে করেন বিমল গুরুঙ্গ অন্তর্ধানে থেকে লোকসভা নির্বাচনে লড়বে। যা বাস্তবে পরিণত হওয়া কঠিন, আর সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চেষ্টা করছে তৃণমূল। এই অবস্থায় পাহাড়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে নাগরিকত্ব দিতে পারলে কিছু শতাংশ ভোট নিশ্চিত করা সম্ভব। একই সঙ্গে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকে কিছুটা আয়ত্তে আনা যাবে। অন্যদিকে সীমান্তের দায়িত্বে থাকা বিএসএফ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ তা সত্বেও কী ভাবে অনুপ্রবেশ হচ্ছে সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, "শাসকদল তৃণমূল শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের এখানে আশ্রয় দিচ্ছেন। এরা ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।"
তিস্তা ব্রিজের নীচে গজিয়ে উঠেছে এই সব ক্যাম্প
শুধু মাত্র মেল্লি নয়, কালিম্পং এর বিভিন্ন জায়গায় এধরনের ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। গ্ৰাহামস হোম সংলগ্ন এলাকায় টিনের ছাউনি দেওয়া ক্যাম্পের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এক বন দপ্তরের কর্মী।
প্রসঙ্গত এরাজ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী অনুপ্রবেশ নতুন নয়। গত আটমাস ধরে দক্ষিণ ২৪ পরগণার হাড়দহে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ক্যাম্প করে বসবাস করছে। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, কোনও রোহিঙ্গা শরণার্থী অনুপ্রবেশ করলে ভারত সরকার তাকে আশ্রয় দেবে না। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ১০,৫০০ যা ২০১৭ সালের শেষে হয়েছে ৪০,০০০। বাংলায় অনুপ্রবেশ সমস্যা নতুন নয়। উপরন্তু ক্ষেত্রে ভারতের কোনও রিফিউজি পলিসি নেই। শুধু মাত্র ভোট ব্যাংক রাজনীতির জন্য রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না নিয়ে সঠিক উপায়ে চিহ্নিত করা উচিত নাহলে আগামী দিনে এ রাজ্যে ও আসামের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।