শরণার্থী নয়, মোটা টাকার বিনিময় বাংলাদেশের ভোটার হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা
সামনে নির্বাচন, তাই জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের ভোটার কার্ড দিতে তৎপর
- Total Shares
মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কি বাংলাদেশের হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা এমনই প্রশ্ন আর উদ্বেগ জাগিয়েছে জনমনে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, কক্সবাজারের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২৫ ভাগই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা। বর্তমানে ১১ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের এ সব সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড জানান দিচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কয়েক দশক ধরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানালেও, তাতে সাড়া দেয়নি মিয়ানমার। গত বছর হঠাৎ বাংলাদেশে এক সঙ্গে প্রবেশ করে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিজেদের নাগরিক বলেও অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশ সরকার তাদের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি ‘মানবিক কারণে’ তাদের নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে সরানোর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিল সরকার। তবে এখন পযন্ত এ উদ্যোগে সফলতা আসেনি।
কক্সবাজারের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২৫ ভাগই রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা
আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এখন বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যেই তার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের দ্বারা বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তারা বিভিন্ন প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা,সামাজিক ভারসাম্য, শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কথিত সন্ত্রাস দমনের নামে দেশটির সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১লাখ ছাড়িয়েছে। তবে সীমান্ত অতিক্রম করে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে রোহিঙ্গাদের আগমন এখনও অব্যাহত থাকায় দিনে দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়ছে।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ
২০১৬ সালের ১১ মে রাতে টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে আনসার ক্যাম্পে একদল রোহিঙ্গা দুবৃত্ত হামলা করে। তাদের বাধা দিতে গিয়ে নিহত হন আনসার কমান্ডার টাঙ্গাইলের সখীপুরের আলী হোসেন। পরে অস্ত্র লুটের ঘটনার অন্যতম হোতা খাইরুল আমিন (বড়) ও মাস্টার আবুল কালাম আজাদ নামের দুই রোহিঙ্গাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র্যাব-৭। ৫টি অস্ত্র, দেশীয় ৫টি অস্ত্র, ১৮৯ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি ও ২৬টি দেশীয় তৈরি গুলি উদ্ধার করা হয়। বান্দরবানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। গতবছর ১০ আগস্ট কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারিঘাট এলাকা থেকে অস্ত্র ও কোটি টাকার ইয়াবাসহ আবদুল্লাহ নামে মিয়ানমারের এক রোহিঙ্গাকে আটক করে ডিবি পুলিশ।
বান্দরবানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয়েছিল
এ ছাড়াও অহরহ তাদের দিয়ে সকল অনৈতিক ও অপরাধমূলত কার্যক্রম করানোর অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়তিই অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়াচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে অস্থিরতা। কক্সবাজার উখিয়ার বাসিন্দা আবদুল হাই বলেছেন, "যে হারে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আছে তাতে আমাদের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা যে কোনও অনৈতিক কাজ করতে পারে।"
জঙ্গি কার্যক্রমে রোহিঙ্গা
কক্সবাজার-বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে মধ্যপ্রাচ্যের অনুদানপ্রাপ্ত রাবেতা আল ইসলাম হাসপাতালে পল্লী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের নামে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। প্রত্যেক হাসপাতালের পাশে রাবেতার নামে আসা অনুদানে মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলী গড়ে তুলেছিলেন কওমি মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা যুবকদের পাশাপাশি শিবিরের তরুণ সদস্যরাও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত।
রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা
সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী-২ ময়নারঘোণা আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা আরিফ উল্লাহকে (৪৫) গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। সোমবার রাত ১০টার দিকে আশ্রয়শিবিরের অভ্যন্তরে সি ওয়ান ব্লকসংলগ্ন এলাকায় তাঁকে হত্যা করা হয়। অন্তর্দ্বন্দ্বের জের ধরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতেই তিনি খুন হয়েছেন বলে দাবি বাংলাদেশ পুলিশের। পুলিশের ভাষ্য, গত ১৯ জানুয়ারি রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে বালুখালীর তাজনিমারঘোনা আশ্রয়শিবিরের মাঝি (নেতা) মহম্মদ ইউসুফকে। ওই দিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসবাদীরা ময়নাঘোনা আশ্রয়শিবিরে গিয়ে আরিফ উল্লাহর ওপর হামলা করেছিল। আরিফ উল্লাহ ওই দিন প্রাণে রক্ষা পেলেও সন্ত্রাসবাদী হামলায় গুরুতর আহত হন তাঁর ছোট ভাই মৌলভি মুহিব উল্লাহ।
রোহিঙ্গাদের বক্তব্য, আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নাগরিকদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সরব ছিলেন আরিফ উল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব-সহ নানা অধিকারের আন্দোলনে শামিল হন এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। তিনি ওই আশ্রয়শিবিরের সি ব্লকের প্রধান মাঝি (দল নেতা) ছিলেন। তাঁর বাবার নাম এখলাছ মিয়াঁ। এই শিবিরের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আলম বলেন, "আরিফ উল্লাহ উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। রোহিঙ্গাদের সপক্ষে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে কথা বলে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।" রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আলম ও তৈয়ুব উল্লাহ বলেন, "স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু রোহিঙ্গা জঙ্গিরা তাঁর এই উত্থানকে সহ্য করতে পারছিল না। এ জন্য তাঁকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।" উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, "রোহিঙ্গাদের হাতেই রোহিঙ্গা নেতা আরিফ উল্লাহ খুন হয়েছেন। এর আগেও তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।"
রোহিঙ্গাদের হাতে দেশি মোবাইল ও সিম
রোহিঙ্গাদের হাতে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি সিম তুলে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনও ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর নিবন্ধন না থাকায় এ সব সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ। রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য দালালদের দ্বারস্থ হয়। এ দালালরাই তাদের বন-জঙ্গল, পাহাড় ও নদী পার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত সিম ও মোবাইলের ব্যবস্থাও তারা টাকার বিনিময়ে করে দেন। তাই কখনও কখনও বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই এ দেশের সিম পেয়ে যায় তারা।
মোটা অঙ্কের টাকায় ভোটার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা
মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে তাদের এ দেশীয় আত্মীয়রা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হয়ে উঠতে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সহায়তা বন্ধে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এখন থেকে কেউ রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে সহায়তা করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। ইসি সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে সবসময়ই তৎপর থাকে কমিশন। বিগত দিনের ভোটার হালানাগাদ তালিকা অনুযায়ী এ বারও বিশেষ সর্তকতা ও নানামুখী পদক্ষেপ করে মাঠে নেমেছেন তাঁরা।
নিবন্ধনে আগ্রহ নেই রোহিঙ্গাদের
গত ১১ আগস্ট রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হলেও কুতুপালংয়ে মাত্র ৮০০ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছেন। লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধন করতে কতদিন লাগবে, তা নির্দিষ্ট করে এখনই বলতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন। এদিকে মানবিক বিষয়টি মাথায় রেখেই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পদক্ষেপ করা উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবিক বিষয়টি মাথায় রেখেই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা জানিয়েছেন, জীবনযাত্রার নূন্যতম মান ঠিক রেখে রোহিঙ্গাদের দেশে রাখতে হলে বছরে সরকারের খরচ বাড়বে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের বাজেটে সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তায় দেওয়া বরাদ্দের সমান। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের থাকা, নিরাপত্তা ও খাবার নিশ্চিত করেছেন। অথচ দেশ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রোহিঙ্গাদের চাপ বহন করা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে রোহিঙ্গারা যাতে কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ায় সে ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ যাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে এবং ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিরা যাতে চাঙ্গা না হয়ে উঠে এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও তৎপরতা রয়েছে।