ভারতের ট্রাম্প কার্ড: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে সদর্থক পদক্ষেপ ভারতের
প্রথম দিকে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে উষ্ণ থাকলেও গত কয়েক মাস যাবৎ আবার তা বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে
- Total Shares
২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণ জানানোর খবর প্রকাশিত হতেই প্রতিক্রিয়াও আসতে শুরু করে দিল চেনা গতেই। সদাসন্দিগ্ধ লোকজন ও আশাবাদীরা এই আমন্ত্রণের ভালোমন্দ নিয়ে বিতর্ক শুরু করে দিলেন। লোকসভা নির্বাচনের একেবারে মুখে এই আমন্ত্রণ, তাই তা নিয়েও প্রশ্ন উঠল। আপাতত অবস্থা হল, হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সারা স্যান্ডার্স বলেছেন, “আমন্ত্রণ পেয়েছি” তবে এ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। স্যান্ডার্স জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যখন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব জেমস মাটিস ও প্রতিরক্ষা উপসচিব মাইক পম্পিও ভারত সফর করবেন, তখন বিষয়টি উত্থাপন করা হবে এবং এ নিয়ে আলোচনা হবে।
প্রথম দিকে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে উষ্ণ থাকলেও গত কয়েক মাস যাবৎ আবার তা বেশ ঝিমিয়ে পড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। ২০১৬ সালে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিসেন, তখন ভারতের অনেকেই বেশ উচ্চাশা পোষণ করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধী যে হাওয়ার জেরে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন, ডোলান্ড ট্রাম্পেসর নির্বাচিত হওয়াও ছিল তারই একটা ধরণ।
হিলারি ক্লিন্টন জয়ী হবেন বলে আশাবাদী ছিলেন কমবেশি ৯০ শতাংশই, আর তাঁদের মিথ্যা প্রমাণ করে জয়ী হলেন ট্রাম্প। খেটে খাওয়া লোকজন যাঁদের নেতৃত্ব দেখে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন, তাঁদের সেই মন্ত্রমুগ্ধতা দূর হতেই জয়ী হলেন ট্রাম্প। অভিজাত ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাষ্ট্রপতি ওবামার ‘সামাজিক’ রাজনীতি, বিশ্বায়নের দাপটে বেকারত্ব সব কিছু মিথ্যা করে দিলেন আমেরিকার ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা। একই ভাবে পোল্যান্ডেও সব মিথ্যা করে দক্ষিণপন্থী ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি নির্বাচনে জয়ী হয়। যুক্তরাজ্যের মানুষও ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দিয়েছেন, দেখে সারা দুনিয়ায় হতাশার ঢেউ খেলে গেছে।
ট্রাম্পের সম্ভাব্য সফর এখন আলোচনার কেন্দ্রে (অলঙ্করণ: পথিকৃৎ সান্যাল)
আমেরিকা প্রবাসী হোন ভারতবাসী, হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রবেশকে ভালো চোখেই দেখেছে ভারতীয়রা। যতই হোক ট্রাম্পই তো বলেছিলেন যে তিনি ‘হিন্দুদের’ ভালোবাসেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভারতীয় বংশোদ্ভুত মার্কিনিরা সাধারণ ভাবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীদেরই ভোট দিয়ে থাকেন। এই প্রথমবার ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিশেষ করে হিন্দুদের বেশ উল্লেখযোগ্য একটা অংশ শুধু ট্রাম্পকে সমর্থনই করেননি, তাঁকে ভোটও দিয়েছেন।
যাই হোক, ট্রাম্পের “আগে আমেরিকা” নীতির জন্য মূল্য দিতে হয়েছে ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে।
বাছাই করা মার্কিন পণ্যের উপরে কর বাড়ানোর জন্য ট্রাম্প প্রশাসন দোষারোপ করেছে ভারত সরকারকে। একই সঙ্গে আমেরিকাও ভারতীয় ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপরে কর চাপিয়েছে। জেরুজালেম নিয়ে ভারতের ভোট এবং দিল্লিতে উত্তর কোরিয়ার দূতাবাস বন্ধ করতে না চাওয়া হল ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উষ্ণতা হারানোর আরেকটি কারণ।
দীর্ঘ প্রতিক্ষিত অন-এগেন, অফ এগেন “২+২” আলোচনা আবার শুরু হতে চলেছে, মনে করা হচ্ছে এর ফলে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার আগের মতো হবে। এই আলোচনা শুরু হওয়ার ঠিক আগে গত বুধবার ভারতের বিদেশসচিব বিজয় গোখেল আমেরিকায় পৌঁছেছেন। আরেকটি ভালো ব্যাপার হল দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অথরাইজেশন (এসটিএ ১) স্টেটাস ভারতকে দেওয়া হয়েছে, এর ফলে নিরাপত্তা জনিত কারণে নিষিদ্ধের তালিকায় থাকা অনেক প্রযুক্তি আগের তুলনায় বেশি করে কিনতে পারবে ভারত।
এমন সব নানা টানাপোড়েনের মধ্যে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর ভাবনা খুব একটা মন্দ নয়।
জর্জ বুশ যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। নানা বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে সময়ের সঙ্গে সেই সম্পর্ক এখন অনেকটাই বলিষ্ঠ হয়েছে।
ভারতের অর্থিনৈতিক পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারত আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের সঙ্গে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে কথা বলছে। যে সব ভারতীয়রা আমেরিকায় বাস করেন তাঁরাও এখন নিজেদের রাজনৈতিক স্থানকে আগের চেয়ে আরও বেশি মজবুত বানিয়েছেন।
অন্যত্র যেসব দেশের মানুষ আমেরিকায় বাস করেন তাঁদের মধ্যে জাতিগত ভাবে ভারতীয়রা সব চেয়ে বেশি বিত্তশালী ও শিক্ষিত। পেশাগত ক্ষেত্রে তো বটেই ওখানকার ভারতীয়রা এখন মার্কিন রাজনীতিতেও সক্রিয় এবং একটা বড় ভূমিকা পালন করছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয়রা ওখানকার স্থানীয় রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতেও সমানভাবে সক্রিয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ওখানে বসবাসকারী ভারতীয়রা রাজনৈতিকভাবে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি শক্তিশালী জায়গা দখল করে রয়েছে। এর সুবাদে মার্কিন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা ভারতের সঙ্গে আগের চেয়ে অনেক বেশি সদ্ভাব বজায় রাখার ও সুসম্পর্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ছবি: রয়টার্স
ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেছে ট্রাম্প সরকার। যদিও বেশ কয়েকবছর ধরেই ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটেছে। দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময় বিভিন্ন প্রচারে ট্রাম্প আগেই পাকিস্তানের সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তান বিভিন্ন সময় সন্ত্রাস ধমনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই প্রতিশ্রুতি পালন না করা তবুও সেই পাকিস্তানকে অর্থ সাহায্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ট্রাম্প। 'এশিয়া-প্যাসিফিক'-কে 'ইন্দো-প্যাসিফিক'-কে রূপান্তরিত করার থেকে পরিষ্কার যে ট্রাম্প প্রশাসন এখন ভারতকে আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।
ভারতের পক্ষের এই ধরণের নানা ইতিবাচক নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও ট্রাম্প একজন ব্যক্তি ও মার্কিন মালিকের রাষ্ট্রপতি হিসেবে অনেক সময় বেশ কঠিন। তিনি যে ছক ভাঙা নিয়মে কাজ করেন তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করাটা অনেক সময় অন্যান্য রাজনীতিবিদ এবং আমলমন্ত্রীদের চলা বেশ দুঃসহ হয়ে উঠতে পারে। তিনি শুধু লড়াই করতেই ভালোবাসেন না লড়াইর শুরুতেই বলতে পাঠিয়ে দেন বিরোধী কোর্টে। ট্রাম্প কী করবেন তা আগে থেকে ঠিক করা যায় না।
আসন্ন লোক সভা নির্বাচনের সঙ্গে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ করার বিষয়টি গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ২০১৯এর সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে ট্রাম্পের এদেশে আসার কোনও যোগই নেই। নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাকিস্তান ইস্যুটি ছাড়া অন্যান্য কোনও ইস্যুই কখনও নির্বাচনের উপর কোনও প্রভাব ফেলেনি।
এটাই হল সত্যিকারের রাজনীতি।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন