আবার ক্ষমতার শীর্ষে সেই এরদোয়ান-ই, কতটা সুর চড়াতে পারবে বিরোধীরা?
টানা দেড় দশক পরে আরও পাঁচ বছরের জন্য শাসন নিশ্চিত করলেন
- Total Shares
দেড় দশক পর তুরস্কের বিরোধীরা স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু যার সাফল্য নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল শেষ পর্যন্ত তিনি তা মিথ্যা প্রমাণ করলেন। শুরুতে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিরোধী দল কিছুটা সংশয় প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা পরাজয় মেনে নিয়েছে। ৫২.৫ শতাংশ ভোট নিয়ে তুরস্কে প্রথম নির্বাহী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ১৬ বছর শাসনক্ষমতায় থাকা রজব তায়িব এরদোয়ান। তার জোটের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া তুর্কি জনগণের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, ৪৭.৫ শতাংশ। এই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে তিনি আরও পাঁচ বছর তুরস্ক শাসন করার সুযোগ পেলেন । তুরস্কের নতুন সংবিধান অনুযায়ী তিনি ২০২৩ সালের পর ফের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাবেন, তখন যদি জয়ী হন তবে ২০২৮ পর্যন্ত তিনিই হবেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। তাহলে কতখানি শক্তিশালী শাসক হলেন এরদোয়ান?
তখনও দেশের প্রধানমন্ত্রী। সংসদে বক্তৃতা করছেন এরদোয়ান (এএফপি)
এই নির্বাচনের আগে তুরস্কের ভাবি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার বিষয়ে একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী পদটি বাদ যাবে এবং নির্বাহী ক্ষমতা পুরোপুরি চলে যাবে প্রেসিডেন্টের হাতে। অর্থাৎ প্রেসিডেন্টই হবেন ‘হেড অব দ্য স্টেট’ এবং ‘হেড অব দ্য গভর্নমেন্ট’। প্রেসিডেন্ট সরাসরি নিজের পছন্দমতো মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, বিচারক ও আমলা নিয়োগ করতে পারবেন। কোনো নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট আসবেন না। এর আগে জাতীয় বাজেট পার্লামেন্টের মাধ্যমে পাস হত। এখন এর খসড়া তৈরি করবেন প্রেসিডেন্ট নিজেই। যদি পার্লামেন্ট নতুনটা গ্রহণ না করে, তবে আগের বাজেটের বাস্তবায়ন হবে। পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টকে অভিযুক্ত করতে পারবে তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে সাংবিধানিক আদালত, যার বেশির ভাগ সদস্যই নির্বাচন করবেন প্রেসিডেন্ট।
গত দেড় দশক ধরে তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। ২০১৪-র আগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রেসিডেন্ট পদে এবার তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে দেশ চালাবেন। বছর দুই আগে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করার পর থেকে কার্যত তিনি ছিলেন একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা । এই নির্বাচনের ফলাফলে তাঁর অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হল। ২০১৬ তে তিনি সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের হাতে যেসব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, তাতে করে তাঁর ক্ষমতা প্রায় ওসমানীয় যুগের সুলতানদের মতোই। এত দিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে সামান্য কিছু ক্ষমতা ছিল, সেটাও প্রেসিডেন্টের কাছে ফিরে আসছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী পদটাই বিলুপ্ত হবে। তিনি মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন এবং তাঁরা তাঁর কাছেই জবাবদিহি করবেন। বিচারক নিয়োগ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিয়োগ এবং যুদ্ধ ঘোষণা—সবই এখন তাঁর হাতে। প্রেসিডেন্ট পদে ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি এক দশকের বেশি সময় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁরই দল একেপির নেতা আবদুল্লাহ গুল। কিন্তু এরদোয়ান নির্বাহী ক্ষমতার সিংহভাগই ভোগ করতেন । এখন ক্ষমতায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ, কারও সঙ্গে তা ভাগাভাগির কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন দল একেপির প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। তার মানে বেশির ভাগ ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে একজন ব্যক্তির হাতেই । নতুন সংবিধান অনুযায়ী আমেরিকা বা ফ্রান্সের মতো গণতন্ত্রের ধারা থাকছে না। তবে আমেরিকা বা ফ্রান্সের সঙ্গে যে তুলনাটা আসছে, তা সঠিক নয় বলছেন অনেকে। কারণ আমেরিকার ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্বাহী, আইনি এবং বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা পুরোপুরি আলাদা। কংগ্রেস যদি বাজেট প্রত্যাখ্যান করে, তবে নতুন করে আবার সংশোধন না করা পর্যন্ত ফেডারেল সরকার তার বাস্তবায়ন স্থগিত রাখে। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনীত করেন ঠিকই তবে কংগ্রেসের অনুমোদন দরকার হয়। আর ফ্রান্সের সরকার-এর প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট একই দলের হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। প্রায়ই আলাদা দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ন’জন বিচারকের মধ্যে তিনজন নিয়োগ করেন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তুরস্কে ১৫ জনের মধ্যে ১২ জন বিচারক নিয়োগ করবেন প্রেসিডেন্ট। কেবল তাই নয় দেশে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতাও এবার পুরোপুরি তাঁর হাতে।
এখন কার্যত সব ক্ষমতাই এরদোয়ানের হাতে
এখন প্রশ্ন, তুরস্কের নতুন সুলতান রজব তায়িব এরদোয়ানের এই বিপুল ক্ষমতা কতখানি প্রভাবিত করবে ইউরোপ-আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে? তুরস্কের রাজনীতিতে এরদোয়ান যে এক শক্তিমান নেতা এবং আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের পর তুরস্কের রাজনীতিতে আর কোনো নেতা এতটা ক্ষমতার অধিকারী হন নি। এরদোয়ানের ক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলেও বিশ্বের শাসকদের কাছে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি কিন্তু পুরোপুরি ধোঁয়াশাময়। পেন্টাগন নিজেও জানে না সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্ক আসলে কার পক্ষে। দুনিয়াজুড়ে মার্কিন স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিলেও নিজের স্বার্থেই আমেরিকা কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করেছে তুরস্ক। যদিও আমেরিকার কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার কথা বললেলেও এখন তুরস্ক ঝুঁকছে রাশিয়ার দিকে। এরদোয়ান মার্কিন সমর্থিত জোট ন্যাটোর সদস্য হয়েও চিন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট ইউরেশিয়াতে যোগ দেওয়ার কথাও ভাবছেন । কাগজে কলমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়েও প্রায়ই ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন এই তুর্কি প্রেসিডেন্ট। তবে সিরীয় শরণার্থী ঢলের আশঙ্কার কথা ভেবে চুপ থাকেন ইউরোপীয় নেতারাও।
১৯৯৯ সালে আমেরিকার কাছ থেকে ১০০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করে তুরস্ক। কেবল এফ-৩৫ নয় টেক্সাস থেকে আঙ্কারার দু’টি লাইটেনিং টু নামে বিশ্বের সর্বোত্তম জঙ্গিবিমানও নেওয়ার কথা। তবে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিকে মার্কিন আইনপ্রণেতারা সহজভাবে নিচ্ছেন না, এমনকি তুরস্ককে জঙ্গিবিমান বিক্রির ব্যাপারেও তারা সেনেটে আপত্তি তুলেছেন। অন্যদিকে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র এবং আমেরিকা এফ-৩৫ বিমান না দিলে রুশ সুখোই-৫৭ জঙ্গিবিমান কেনার কথা জানিয়ে দিয়েছে। এতে আমেরিকার উদ্বেগ হচ্ছে এফ-৩৫ নিয়ে। কারণ এটি সর্বাধুনিক ন্যাটো যুদ্ধবিমান। তুরস্ক এটা পেয়ে যদি রাশিয়াকে তথ্য সংগ্রহ করতে দেয়। তাহলে রাশিয়া এটা তৈরি করতে জেনে যাবে। তুরস্কের মত, এই জঙ্গিবিমান পেলে বিশ্বে স্তিতিশীলতা তৈরি হবে। ন্যাটোকে শক্তিশালী করবে।
এই বিমান কেনা নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করেছিল তুরস্ক
ন্যাটোর প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলেও তুরস্কের অবস্থান কিন্তু মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধেই। তুর্কি সেনাবাহিনী মার্কিন স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে বহুবার। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শাসনেই তুরস্ক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উপেক্ষা করেছে। আর স্পষ্টভাবেই রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মার্কিন-তুর্কি সম্পর্ক। রুশ মিসাইল সরিয়ে রাখলেও সিরিয়া নিয়ে এরদোয়ানের অবস্থান খুব অস্পষ্ট। কুর্দিসেনাদের সহায়তায় আইএসকে দমন করা মার্কিন সেনাদেরও হুমকি দিয়েছেন তিনি। পেন্টাগনও বুঝতে পারে না তুরস্ক আসলে কার পক্ষে। কুর্দি সেনাদের দমন করতে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যায়। সিরিয়ায় তুর্কি বাহিনীর লক্ষ্য মার্কিন সমর্থিত কুর্দি ওয়াইপিজি যোদ্ধাদের উৎখাত করা। কারণ তুরস্ক ওয়াইপিজি যোদ্ধাদের কুর্দি বিদ্রোহীদের মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।
ট্রাম্প এরদোয়ানকে অভিযান বন্ধের অনুরোধ জানানোর পরও তুরস্ক সিরিয়ার আফরিন ও মানবিজে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বের ব্যাপারেও আমেরিকা ও তার মিত্ররা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। কিন্তু এরপরও আমেরিকা অনেক ব্যাপারেই তুরস্কের সাহায্য চায়। তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইনকিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা। এতে ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হয়। তারা এটাও জানে, তুরস্কের সাহায্য ছাড়া সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়। তাছাড়া কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চল, বলকান ও ককাশাসে রুশ প্রভাব কমাতে তুরস্ক আমেরিকাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ইনকিরলিক বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা (ইউএস এয়ারফোর্স)
ইউরোপীয় দেশগুলিরও তুরস্কের প্রতি একই মনোভাব। তারা তুরস্ককে ধর্মর্নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করে। যা একেবারেই অবাস্তব। কাগজে-কলমে তুরস্ক এখনও ইইউ-এর ভবিষ্যৎ সদস্য। তবে এরদোয়ানের ইউরোপ বিরোধী বক্তব্যের কারণে ইইউ সদস্যরাষ্ট্রগুলি যথেষ্ট হতাশ। কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলে না। কারণ আইএস দমনে ও ইউরোপে সিরীয় শরণার্থীর ঢল ঠেকাতে এরদোয়ানের সাহায্য তাদের খুবই প্রয়োজন।
নির্বাচনের পর প্রথম বক্তৃতায় এরদোয়ান সদর্পে ঘোষণা করেন, তুরস্ক বিশ্বে গণতন্ত্রের নতুন নজির তৈরি করেছে। গণতন্ত্রের সেই নয়া নজিরটি কী? তা কি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকায়, ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ায় কিংবা ভারতে নরেন্দ্র মোদি উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যে নতুন মাত্রা দিয়েছেন তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু?
বেশ কয়েক ধাপ পিছিয়ে যেতে হয়। দেড়শো বছর আগেও ইউরোপের দক্ষিণের বলকান অঞ্চল থেকে আধুনিক সৌদি আরবও ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। শতাব্দিপ্রাচীন ওই অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনের অবসান ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে। জার্মানির পক্ষে লড়াই করেছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক-সহ তুরস্কের সামরিক প্রধানরা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের থ্রেইস থেকে মেসোপটমিয়া পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত করতে পেরেছিল। সেই ধারাবাহিকতা থেকেই ১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র সৃষ্টি হয়।
মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা
অটোম্যান আমলের সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি মধ্যপ্রাচ্যে আরেকবার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে এরদোয়ান শাসনাধীন তুরস্ক। বিশেষ করে সিরিয়া এবং ইরাকে; পাশাপাশি বলকান উপদ্বীপ এবং আফ্রিকায়। মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক ছিলেন তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট। মৃত্যুর আগে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। দেশকে আধুনিক করার পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও করেন তিনি। দেশটিতে প্রথম বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়১৯৪৬ সালে। আতাতুর্কের উত্তরসূরি ইসমেত ইনোনুর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। ১৯৫২ সালে পশ্চিমী সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয় তুরস্ক।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা জোরালো করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি তুরস্ককে পশ্চিমমুখী অবস্থান থেকে সরিয়ে এনেছেন। যদিও এরদোয়ান ন্যাটোর কাছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পর এরদোয়ান রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ঠেকাতে সামরিক বাহিনীর লাগাম টানেন। দেশটিতে এর আগে বহুবার সামরিক শাসন বলবত হয়েছে। আর সেই কারণেই ২০১৬-র জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের চেষ্টা তিনি গোড়াতেই নস্যাৎ করেন।
এরদোয়ানের মতে আমেরিকায় নির্বাসিত তার একসময়ের মিত্র ফেতুল্লাহ গুলেনই ওই বিদ্রোহের ইন্ধনদাতা। তবে গুলেন এরদোয়ানের ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। বিদ্রোহের পরই এরদোয়ান দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ওই সময়ে দেশে নজিরবিহীন অভিযান চালিয়ে ৫৫ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও নির্বাচনের পর জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হবে এমনটাই বলেছিলেন তিনি এবং তার বিরোধীরা। সিরিয়া গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরোধিতা করে সেখানে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে ৮ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ তুরস্ক।
সংঘাতের অবসান ঘটাতে সিরিয়ায় মিত্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করছে আঙ্কারা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রায় ৩৫ লাখ শরণার্থী তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। এই শরণার্থীদের বেশিরভাগই তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং ইস্তাম্বুলে বসবাস করছে। ইরাক এবং আফগানিস্তানের কিছু সংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয় হয়েছে তুরস্কে। ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল সীমিত করতে ২০১৬ তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছায় তুরস্ক। আগের বছর তুরস্ক হয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছোয় প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী। তখন মনে হয়েছিল তুরস্ক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে তাই এই চুক্তি স্বাক্ষর। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা এখনো পরিষ্কার নয়।
তুরস্ক সিরিয়ার কয়েক হাজার শরণার্থীকে পাসপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু সমালোচকরা বলেছেন, শরণার্থীদের দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতির ব্যাপারে তুরস্কের কৌশলের ঘাটতি রয়েছে। একসময় দেশটির অমুসলিম সংখ্যালঘুরা আধুনিক তুরস্ক ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। এখন সেখানে খুব অল্পসংখ্যক সংখ্যালঘুই রয়েছেন। অন্যদিকে আর্মেনীয়রা তাদের পূর্বপুরুষদের ওপর চালানো হত্যা ও নৃশংসতাকে তুরস্কের গণহত্যা বলে দাবি করেন। যদি তুরস্ক তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। ১৯২৩ সালে জনসংখ্যা বিনিময়ের শর্তে অধিকাংশ গ্রিক তুরস্ক ছেড়ে চলে যায়।
তুরস্কে শরণার্থী শিবির (রয়টার্স)
বর্তমান তুরস্কের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হল কুর্দরা। জনসংখ্যায় পঞ্চম অবস্থানে থাকলেও দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে তারা অধিকারবঞ্চিত বলে অভিযোগ। ১৯৮৪ সালে এক রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের সময় কুর্দিদের দল কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি--পিকেকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। রক্তক্ষয়ী সেই সশস্ত্র সংঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। এরদোয়ান ক্ষমতায় এসে প্রথম বছরই কুর্দিদের অধিকারের ব্যাপারে পদক্ষেপ করেছিলেন। এমনকি পিকেকের সঙ্গে আলোচনায়ও বসেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৫ সালে কুর্দিদের সঙ্গে তুরস্কের অস্ত্রবিরতি চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর থেকে দেশটিতে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। তবুও কিন্তু পিকেকের সঙ্গে কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি।
ধারাবাহিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যুক্তি দেখিয়ে মাত্র কয়েকজনই রাজনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে তা দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টায় সফল হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই মুহূর্তে অন্যতম। তাঁর লৌহমানবসুলভ ভাবমূর্তি গণতন্ত্রের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতন্ত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হয়, জবাবদিহি থাকতে হয়, ভিন্নমতের একটা আলাদা গুরুত্ব থাকে। তুরস্কে এসব কিছুর কোনও অস্তিস্ত নেই। দেশটিতে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। দু’ বছর ধরে সেখানে জারি আছে জরুরি অবস্থা, সেটাও প্রেসিডেন্টের ডিক্রির জোরে।
মন্দের ভালো—সংবিধান সংশোধনীতে দু’ মেয়াদের পর প্রেসিডেন্টের বিদায় নেওয়ার কথা। কিন্তু স্বৈরশাসক যে শেষ পর্যন্ত ওই সংশোধনীটিও বদলাবেন না, তা কি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে। ২০১৬-র জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের চেষ্টায় জড়িত থাকার সন্দেহে তাঁর সরকার শুধু সামরিক বাহিনীতে শুদ্ধি অভিযান চালায়নি; বিচার বিভাগ, পুলিশ, সরকারি দপ্তর এমনকি শিক্ষকরাও সেই অভিযান থেকে রেহাই পাননি। চাকরি হারিয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার মানুষ, যাঁদের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ৩৩ হাজার স্কুলশিক্ষক। ভিন্ন মতাবলম্বীদের স্বেচ্ছানির্বাসনে আমেরিকায় থাকা ইসলামপন্থী রাজনীতিক ফেতুল্লা গুলেনের অনুসারী হিসেবে অভিহিত করা, কোনও কিছুই বাদ রাখেননি। এই মুহূর্তে তুরস্ক সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি রাষ্ট্র। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ চামহুরিয়াতের সম্পাদক-সহ শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের অনেককেই একাধিক মামলায় হয় আটক, নয়তো দেশান্তরী হয়েছেন।
ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন ও কর্তৃত্ববাদিতার জন্য মানবাধিকারকর্মীদের কাছে চূড়ান্ত নিন্দিত হয়েও কিন্তু এরদোয়ান দেশের ভেতরে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারার পুনরুজ্জীবনে যে সফল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কার্যত, দেশটির ভেতরে ও বাইরে অনেকেই এখন এরদোয়ানকে ইসলামি মতাদর্শের বিশ্ব নেতা বলে মনে করে। যদিও তুরস্কের উদারপন্থী নেতা হিসেবে কামাল আতাতুর্কের যে ভাবমূর্তি, এরদোয়ান তার ঠিক উলটো। ফিলিস্তিনি সংকটে, বিশেষ করে গাজার অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর সমর্থনে ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর অবস্থান তাঁর এই ভাবমূর্তিকে জোরদার করেছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একই ধরনের ভূমিকা নিয়েছিলেন।
জয় ঘোষণার পরে এরদোয়ান
আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সৌদি সরকারের নমনীয় অবস্থানের বিপরীতে তাঁর এই অবস্থানে ইসলামপন্থীরা অনেকটাই উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। সিরিয়া সংকটেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। প্রথমত স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনাকে গোড়াতেই ধ্বংস করে দেওয়া। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হিসেবে আসাদবিরোধী সামরিক তৎপরতায় আমেরিকাকে সহযোগিতা করেও কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রশ্নে কাউকেই বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়া।
এর পরের বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, কেবলমাত্র এরদোগানের সমর্থকরা নয়, রক্ষণশীল, ধর্মভীরু তুর্কিদের কাছে এরদোগানই একমাত্র ভরসা। কারণ একসময়কার ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে এঁরা কথা বলতে পারতেন না। তাদের কাছে, টুইটার বন্ধ করে দেওয়া বা সাংবাদিককে জেলে পোরার মতো ঘটনা তেমন গুরুত্ব পায় না। তার থেকে বরং গত ১৫ বছরে তৈরি হওয়া রাস্তা-ঘাট, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল অনেকের জীবন বদলে দিয়েছে। যে কারণে প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত।
এরদোয়ান বিরোধীরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন যে ক্রমাগত গ্রেপ্তার, হয়রানি স্বত্বেও কুর্দি-সমর্থক, ইউরোপ-সমর্থক বামঘেঁষা দল এইচডিপি ১০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে সংসদে ঢোকার অধিকার অর্জন করেছে। তারা ৬০টিও বেশি আসন জিতেছে। ফলে গণতন্ত্র এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পক্ষে সংসদে কথা বলার সুযোগ তারা অর্জন করল। যেখানে দেশের ৯০ শতাংশ মিডিয়া সরকার সমর্থক, বিরোধীদের বক্তব্য খুব কমই প্রচার পেয়েছে, জরুরী অবস্থার সূত্রে সরকারের সমালোচনা করতেন এমন সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের হয় জেলে পোরা হয়েছে, না-হয় দেশ ছাড়া করা হয়েছে, সেই অবস্থাতেও প্রেসিডেন্ট এরদোগান দেশের অর্ধেক মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছেন। অতএব কী ভাবে তাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, সেই কৌশল ঠিক করা ছাড়া বিরোধীদের সামনে আর তেমন কোনো বিকল্প নেই।