নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি, বিজেপি সরকার অস্বচ্ছ, সিদ্ধান্তগুলিও জনবিরোধী
আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে কোনগুলি প্রধান ইস্যু হতে চলেছে
- Total Shares
আমার আগের লেখার প্রসঙ্গ টেনেই শুরু করছি। মুখ্যমন্ত্রীর ‘উনিশে ফিনিশ’ স্লোগান। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রী স্লোগান দেবেন, এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তবে তিনি যে স্লোগান দিয়েছেন সেটি স্লোগান নয়, দেশের মানুষের মনের কথা। সরকারের দ্বিমুখী নীতি, ভুল পদক্ষেপ, পর্যালোচনা না করে সিদ্ধান্ত এবং ভুল স্বীকার না করার ফলেই এই সরকারকে ‘ব্যর্থ সরকার’ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
এই সরকার উন্নয়ন ও স্বচ্ছ প্রশাসনের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিল। বিগত পাঁচ বছর ধরে সরকার দেশের কতটা উন্নয়ন ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন ভোটের আগে নতুন করে রামমন্দির ও ধর্মকে ইস্যু করতে চায়। দেশ এগিয়েছে, দেশের মানুষ যখন রামমন্দিরে গুরুত্বই দিতে নারাজ তখন সরকার সংরক্ষণ বিল নিয়ে এল।
নরেন্দ্র মোদী: নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ (ফাইল ছবি: রয়টার্স)
কার জন্য এই বিল? এতে কার উপকার হবে? এই সব রাজনৈতিক প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায় যে সরকার এমন একটি বিল এনেছে যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় তো বটেই, দেশের সংবিধানেরও পরিপন্থী। সংবিধান সংশোধন করা যায়, কিন্তু সংবিধানের মূল ভাব তো সংশোধন করা যায় না। এই বিল আইন হয়েছে, যদিও তা প্রয়োগ করতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন করা সংখ্যাধিক্যের জেরে সম্ভব, তবে তাতে যেহেতু আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সকলে অন্তর্ভুক্ত হবেন না এবং আর্থিক মানদণ্ড পরিবর্তন করা সরকারের হাতে থেকে যাবে, তা হলে এই বিলে সংবিধানের মূল কথা রক্ষিত হবে কী ভাবে!
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী যেখানে আমাদের দেশের ২০ কোটির উপরে মানুষ মাসে ৪০০০ টাকার বেশি রোজগার করেন না সেখানে তাঁদের জন্য সংরক্ষণ দরকার নাকি যাঁর আয় বছরে আট লক্ষ টাকা, তাঁর জন্য সংরক্ষণ দরকার?
কেশবানন্দ ভারতী মামলা থেকে মিনার্ভা মিলের মামলা – বিভিন্ন মামলায় দেশের সর্বেচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে যে সংবিধান সংশোধনের অধিকার সংসদের রয়েছে কিন্তু সংবিধানের মূল কাঠামো সংশোধনের অধিকার সংসদের নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করা হলে সংবিধানের মূল কাঠামো – সমান অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।
এই সরকার নিজেদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তো রক্ষা করতে পারেইনি, উপরন্তু সংবিধানকেও গ্রাহ্য করছে না। কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, পাঁচ বছরে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। প্রবীণ নাগরিকদের ব্যাঙ্কের আমানতে সুদের হার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল, সেই প্রতিশ্রুতিও পালিত হয়নি। এতদিন ব্যাঙ্কে আমানতের উপরে সুদের হার কমলেও এখন অবশ্য সামান্য বাড়িয়েছে।
কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষিত হয়নি। (ফাইল ছবি: রয়টার্স)
এই সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বলতে গেলে সিবিআই, ইডি, এসএফআইও, আয়কর – এদের ব্যবহার করছে। তাদের হাতে প্রভূত ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। অর্থবিলের মাধ্যমে ২২টি আইন সংশোধন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে এবং আয়করের মতো সংস্থার হাতে প্রভূত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই ক্ষমতাবলে তারা যাকে যখন খুশি গ্রেফতার করতে পারে কোনও কারণ না দর্শিয়ে। আগে ট্রাইবুনালে কারণ দর্শাতে হত। এখন তার বদলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে হবে। সেখানে গিয়ে আয়কর তাদের বক্তব্য জানাবে।
সরকার এই সব পদক্ষেপই করেছে কর্পোরেটদের কথা মাথায় রেখে, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে নয়। ইনসলভেন্সি বোর্ডও তৈরি হয়েছে তাঁদের কথা ভেবেই।
সাধারণ কোনও ব্যক্তি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে। তাও সেটি বন্ধকীঋণ। তারপরে কোনও কারণে যদি তিনি সেই ঋণ পরি শোধ করতে না পারেন, তা হলে তাঁর ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হবে। যদি ছোট ব্যবসায়ী সেই ঋণ নেন এবং সেখানে নির্দেশেক হিসাবে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের নাম থাকে তাঁদেরও ছবি প্রকাশিত হবে, নাম-ঠিকানা-সহ। সম্পত্তি নিলাম হচ্ছে বলে ঘোষণা হবে। কিন্তু বিজয় মালিয়ারা পালিয়ে গেলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার পরে মেহুল চোক্সি পালিয়ে গেলেন, তারপরে লোকে জানতে পারলেন, অভিনব পদ্ধতিতে ১৫,০০০ কোটি টাকা জালিয়াতির কথা। বিজয় মালিয়া বলেছিলেন অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন – যদিও পরে চাপের মুখে সেই বয়ান বদল করেন।
পেট্রোল-ডিজেলের দাম যখন আন্তর্জাতিক বাজারে কম ছিল, তখন দেশের বাজারে দাম কম করা হয়নি। এখন তার দাম আকাশ-ছোঁয়া। শুধু যাঁরা দামি গাড়ি চড়েন তাঁরাই তেল কেনেন, তা নয়। পণ্যপরিবহণের জন্যও জ্বালানি তেল প্রয়োজন হয়, তাই জ্বালানির দাম বাড়ায় সমস্ত পণ্যের, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে।
রঘুরাম রাজনের কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি, পদত্যাগ করেছেন তাঁর উত্তরসূরী উর্জিত প্যাটেলও। (ফাইল ছবি: রয়টার্স)
কালোটাকা উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রী নোটবন্দি করেছিলেন। নোটবন্দির মাধ্যমে সরকার কত কালোটাকা উদ্ধার করেছে, আজ পর্যন্ত তা নিয়ে সরকার কোনও তথ্য দিতে পারেনি। উল্টে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তা ছাড়া যে ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের কার্যকালের মেয়াদ বাড়ানো হল না এবং তাঁর পরিবর্তে সরকার যাঁকে নিয়োগ করল, সেই উর্জিত প্যাটেল কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করলেন, তা থেকে স্পষ্ট, দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাও সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সরাসরি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজকর্মেও হস্তক্ষেপ করছে। বর্তমানে সরকার নিয়োগ করেছে শক্তিকান্ত দাস নামে প্রাক্তন আমলাকে যাঁর অর্থনীতিতে কোনও ডিগ্রি নেই। নোটবন্দির সময়ে সরকার বলেছিল কালোটাকা উদ্ধার করা হবে, প্রায় সব টাকাই সরকারের ঘরে জমা পড়েছে, তা হলে কি ধরে নেওয়া যায় যে কালো টাকা এই পদ্ধতিতে সাদা করা হয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমাকে ৫০ দিন সময় দিন। যদি তার মধ্যে এর সুফল আপনারা দেখতে না পান তা হলে যে চৌরাস্তায় আমাকে দাঁড়াতে বলবেন, সেই চৌরাস্তায় আমি দাঁড়াব। যে শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেব। ৫০ দিন তো কবেই পার হয়ে গেছে। কিন্তু সে জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাননি প্রধানমন্ত্রী।
জিএসটি যে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত তা বারে বারে জিএসটি-র হার পরিবর্তন করা হার হার কমানো থেকেই স্পষ্ট।
রাফালের পাশাপাশি নির্বাচনে এগুলোই হবে বিরোধীদের প্রধান ইস্যু।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য একটা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন। নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, “না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা।” ডাল ও খাদ্যপণ্যের দাম যা হয়েছে তাতে প্রধানমন্ত্রী কী করছেন বলতে পারব না, তবে দেশের মানুষ খেতে পারছেন না।