নির্বাচন যতই এগোচ্ছে তত উদ্ভট প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে রাজনৈতিক দলেগুলোর নেতৃত্ব
রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নৈতিকতা বা বাস্তবতা কিংবা আইনের ধার ধারে না
- Total Shares
পাওলো কোয়েলহো একবার বলেছিলেন, "কিছু লোক মনে করেন যে তারা যা খুশি তাই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন। আবার, এমন কিছু মানুষও রয়েছেন যারা নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব প্রতিশ্রুতিকেই সত্যি হিসেবে মেনে নেন।" তিনি নিশ্চয়ই ভারতের নির্বাচনের কথা ভেবে এই কথাগুলো বলেননি। আবার, হয়ত, তিনি ভারতের নির্বাচনের কথা ভেবেই এই কতগুলো বলে থাকতে পারেন।
যতই নির্বাচন নিয়ে বাজার গরম হচ্ছে ততই রাজনৈতিক দলগুলো উদ্ভট উদ্ভট প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করা কতটা বাস্তব, কতটা নৈতিক বা কতটা আইনসম্মত হবে তা নিয়ে অবশ্য কেউই মাথা ঘামাচ্ছেন না।
মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস যেমন নির্বাচনে জয় পেলে গোমূত্র উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে, পাঞ্জাবের শিরোমনি আকালি দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে তারা ভোটারদের জন্য কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জমির ব্যবস্থা করে দেবে।
এই ধরণের প্রতিশ্রুতগুলোকে উদ্ভট মনে হতেই পারে, কিন্তু সময় বিশেষে এই প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে একেবারেই হাসি ঠাট্টা করা যায় না।
রাজস্থানের বিজেপি নেতৃত্ব জানিয়েছেন বাল্য বিবাহে প্রশাসন নজরদারি করবে না [ছবি: রয়টার্স]
এই প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক সময়তেই নির্বাচনী লড়াইয়ের মূল বিষয় বা ইস্যুগুলোর - যেমন দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো কিংবা পরিষেবা - থেকে আমাদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেয়। সবচেয়ে বিপজ্জনক, নির্বাচন জেতার স্বল্পকালীন লক্ষ পূরণের জন্য করা এই প্রতিশ্রুতিগুলো অনেক সময়তেই দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে আমাদের সামাজিক উত্থান পিছিয়ে দেয়।
একবার দেখে নেওয়া যাক এই নির্বাচন মরশুমে কোন কোন রাজনৈতিক দল তাদের ভোটারদের কাছে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার কোনটা উদ্ভট আবার কোনটা বেআইনি।
বিজেপি নেতৃত্ব বাল্য বিবাহ সমর্থন করেছে
রাজস্থানের সোজাত বিধানসভা আসনের বিজেপি প্রার্থী সম্প্রতি ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে স্থানীয় গ্রামবাসীরা বাল্য বিবাহ দিতে চাইলে পুলিশ সে বিষয়ে মাথা গলাবে না। একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে যেখানে এই বিজেপি নেত্রীকে বলতে শোনা যাচ্ছে, "ক্ষমতা ও সংগঠন (রাজ্য সরকার) আমাদের হাতেই রয়েছে। আমরা পুলিশকে বাল্য বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে মাথা গলাতে দেব না।"
মাত্র কয়েকটি ভোটের জন্য একটি ছোট মেয়েকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তার জীবন নরকীয় করে তুলতে রাজি আছেন এই বিজেপি নেত্রী। তিনি এমন একটি প্রথাকে জনপ্রিয় করতে চাইছেন আইনের চোখে যা বেআইনি।
বুঝতে সুবিধা হওয়ার জন্য কয়েকটি তথ্য দেওয়া যাক: বাল্য স্ত্রীর সংখ্যা ভারতে সবচাইতে বেশি। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী এ দেশের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মেয়ে সাবালক হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ে। জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন জানাচ্ছে, রাজস্থানের বাল্য বিবাহের হার গোটা দেশের গড় হারের থেকেও বেশি। রাজ্যের শহরাঞ্চলের বাল্য বিবাহের গড় যেখানে ১০.৬ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলের বাল্য বিবাহের হার নয় নয় করে ৮৯.৪ শতাংশ।
সুতারং চৌহান একটি বস্তাপচা প্রথাকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের দলের তৈরি করা কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিরও বিরোধিতা করছেন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কিন্তু বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে। বর্তমানে আইনে নাবালক নিজের ইচ্ছেতে বিবাহ করতে চাইলে বাধা দেওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনটিকে তুলে ফেলে বাল্য বিবাহকে সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ করতে চাইছে।
স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্র শিক্ষাগত যোগ্যতা অপ্রয়োজনীয়
রাজস্থানের নির্বাচনের আর এক মুখ্য খেলোয়াড় কংগ্রেসও নিজেদের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছে। তা যতই উন্নয়নের বিরোধিতা করুক না কেন।
দলের নির্বাচনী মুখপত্রে লেখা হয়েছে যে কংগ্রেস সরকারে এলে স্থানীয় পুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের জন্য নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও শর্ত থাকবে না।
শিক্ষার প্রসার না ঘটিয়ে, অশিক্ষতদের প্রার্থী করতে চায় কংগ্রেস [ছবি: পিটিআই]
২০১৫ সালে বসুন্ধরা রাজের সরকার নিয়ম করেছিল, পুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের দশম শ্রেণী উত্তীর্ন হওয়া ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের অষ্টম শ্রেণী (উপজাতি সংরক্ষিত এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেণী) উত্তীর্ন হওয়া বাধ্যতামূলক।
এই সিধান্তে বিতর্ক ছড়িয়ে ছিল কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য অনেকেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছিলেন না। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা দাবিতে বলা হয়েছিল, যে এই ধরণের নিয়ম প্রণয়ন না করে সরকারের উচিত শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
মধ্যে প্রদেশে গোশালা
মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে বলা হয়েছে যে প্রতিটি পঞ্চায়েতে একটি করে গোশালা স্থাপন করা হবে। সরকার গরুদের রক্ষনাবেক্ষন করতেই পারে। কিন্তু ইস্তেহারে রক্ষনাবেক্ষনের যে নমুনা তুলে ধরা হয়েছে তা কিছুটা উদ্ভট ঠেকছে। বলা হচ্ছে, যে বড় রাস্তার ধারে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে দেওয়া হবে যেখানে গরুর চিকিৎসা ছাড়াও মৃত্য গরুদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস নেতারা একমত: গরুদের জন্য কিছু করতেই হবে [ছবি: পিটিআই]
আমাদের মত দেশে যেখানে এক প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েতে স্কুল বা হাসপাতাল নেই কিংবা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্য লোকেদের মাইলের পর মাইল হাটতে হয় সেখানে কংগ্রেসের এই প্রতিশ্রুতি উদ্ভট ভিন্ন আর কিছুই নয়।
বিজেপির হিন্দুত্ব যুদ্ধে নিজেদের জয়ী করতে কংগ্রেস বোধহয় ভুলে গিয়েছে যে কেন্দ্রের গরুরা নয়, মানুষরা তাদের ভোটার।
তেলাঙ্গনাতে বিনামূল্যে গরু বিতরণ
যে কোনও নির্বাচনী প্রচারে গরু সংক্রান্ত প্রচারের কপিরাইট কিন্তু বিজেপির একচেটিয়া। তেলেঙ্গনাতে বিজেপি সে কথা একবারের জন্যেও ভোলেননি। তেলেঙ্গনায় বিজেপির ইস্তেহারে বলা হয়েছে যে প্রতি বছর উৎসবের মরশুমে সরকারের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ গরু বিতরণ করা হবে। তবে ঠিক কাদের কাদের বিতরণ করা হবে তা পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি।
আরও একটি বিষয় এখনও পরিষ্কার নয় - বছরভর এত গরুর ব্যবস্থা কী ভাবে হবে। ভালো প্রজাতির গরুর দাম তিরিশ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা অবধি। এই পয়সাই বা কে যোগাবে?
তেলাঙ্গনার এক লক্ষ গরু কোথায় যাবে? [ছবি: পিটিআই]
তেলাঙ্গনার বাসিন্দাদের কাছে কি রাস্তাঘাট, স্কুল কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে গরু বেশি প্রয়োজনীয়?
তেলাঙ্গনায় গোহত্যা নিষিদ্ধ। রাজ্যের গোরক্ষকরাও বেশ সক্রিয়। সে ক্ষেত্রে, বিজেপির বিতরণ করা এই লক্ষ লক্ষ গরু বৃদ্ধ হলে তাদের পরিণতি কী হবে? তাদেরকে কি মধ্যপ্রদেশের গোশালাগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
একটা কথা মনে করিয়ে দিয়ে যাক। গত বছর তামিলনাড়ুতে নিজেদের 'গো প্রীতির' নীতির উল্টো পথে হেঁটে বিজেপি সেই রাজ্যে জল্লিকট্টু চালু করতে উদ্যত হয়েছিল। এই মোষের লড়াই কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।
কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি যখন নৈতিকতা বা আইনের ধার ধারে না তখন নিজেদের প্রতিশ্রুতিই রাজ্য বিশেষে বা নির্বাচন বিশেষে উল্টো হতে বাধা কোথায়।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে