রাহুল গান্ধী ও তাঁর দলকে ধর্ম নিয়ে এবার কেন অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে
বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গান্ধীবার ও নেহরুবাদের মাঝামিঝে অবস্থানে কংগ্রেস
- Total Shares
মহাত্মা গান্ধীর জন্মের সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে ২ অক্টোবর ওয়ার্ধায় যে কংগ্রেসের বৈঠক হতে চলেছে সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হবে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভাবে ধর্মীয় অবস্থান কী হবে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে তাদের অবস্থান কী, সে কথা স্পষ্ট করতে হবে কংগ্রেসকে (ছবি: টুইটার)
এক বছর ধরে লোকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যে প্রচার অভিযানের পরিকল্পনা করেছে কংগ্রেস নেতৃত্ব, সেই লোক সম্পর্ক অভিযান উপলক্ষ্যে কংগ্রেস কার্যনির্বাহী কমিটি গান্ধী জয়ন্তী উপলক্ষে বৈঠক করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেবাগ্রামে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে শান্তি মিছিল ও উপাসনা হবে।
মহাত্মা গান্ধীর জীবনের বড় অংশ জুড়ে আছে ওয়ার্ধা। ১৯৩৬ সালে একানে সেবাগ্রাম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখানেই গৃহীত হয়েছিল। ১৯৪২ সালে কংগ্রেস কর্মসমিতির বৈঠক এখানেই হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই ওয়ার্ধাতেই।
কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা অশোক গেহলট বলেন যে ওয়ার্ধাকে নতুন করে আবিষ্কার করা উচিত এবং এখান থেকেই আমাদের দল ঘরে ঘরে গিয়ে ‘ভয়, ঘৃণা ও সন্ত্রাসে’র বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করবে।
সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে প্রচার করতে হলে কংগ্রেসকেও স্পষ্ট সুসংবদ্ধ আদর্শ স্থির করে এগোতে হবে।
ঐতিহাসিক ভাবে এ নিয়ে কংগ্রেসের দু’ধরনের মতবাদ আছে।
গান্ধী ছিলেন পরম্পরায় বিশ্বাসী, তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও জীবনযাত্রা ছিল কঠোর বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে, তা হল হিন্দুত্ব। উল্টোদিকে জওহরলাল নেহরু ছিলেন বাস্তববাদী, তিনি ছিলেন খোলামনের পাশ্চাত্যধারা পরম্পরায় বিশ্বাসী। তিনি কোনও ব্যাপারে পদক্ষেপ করার জন্য তার উৎস বুঝে নিতে চাইতেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলার বিরোধী ছিলেন। গান্ধী তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনেই সহজাত প্রবৃত্তি, অনুভূতি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করে উপসংহারে পৌঁছতেন।
২০০৫ সালে কেদারনাথে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী (ছবি:পিটিআই)
সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ১৯৩২ সালে যখন গান্ধী আমৃত্যু অনশনের কথা ঘোষণা করলেন, সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে নেহরু তাঁর আত্মজীবনী অ্যান অটোবায়োগ্রাফিতে (পৃষ্ঠা ৩৭০) লিখেছেন, “এই ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে বারংবার ঈশ্বরের প্রসঙ্গের অবতারণা করায় আমি তাঁর উপর ক্রুদ্ধ হতাম। এমনকী তিনি এই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যে কবে থেকে অনশন শুরু করবেন সেই দিনটিও নাকি ঈশ্বর নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কী ভয়ানক ব্যাপার!”
আরও আছে।
১৯৩৩ সালে যখন তিনি ইয়ারাওয়াড়া জেলে ২১ দিনের অনশন শুরু করেন সেই সময় প্রসঙ্গে নেহরুর বক্তব্য, “আমার কাছে অনশন হল দুর্বোধ্য বিষয়... এটা রাজনীতির ক্ষেত্রে উপযুক্ত কিনা তা ক্রমে ক্রমে আমার বোধের অগম্য হয়ে উঠতে লাগল। বোধ করি কোনও ভাবনার ও প্রসঙ্গ জাগরিত করার এ এক সরল পথ কেউই যার বিরোধিতা করে তাকে ধূমায়িত করতে পারবে না।” (অ্যান অটোবায়োগ্রাফি পৃষ্ঠা ৩৭২-৭৩)।
গান্ধীবাদী চিন্তাধারা অনুযায়ী কোনও মানুষই ধর্ম ছাড়া জীবনধারণ করতে পারেন না। গান্ধী তাঁর গ্রন্থ অ্যান অটোবায়োগ্রাফি – দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্ট উইদ ট্রুথ-এ (পৃষ্ঠা ৬৯) লিখছেন, অনেকেই তাঁদের ইগোর বশীভূত হয়ে ঘোষণা করছেন যে ধর্মের সঙ্গে তাঁদের কোনও লেনাদেনা নেই... আমার সত্যাগ্রহই আমাকে রাজনীতির দিকে চালিত করেছে... “এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বলছেন যে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই তাঁদের ধারনাই নেই যে ধর্ম কাকে বলে।”
উল্টোদিকে নেহরু তাঁর যুক্তি সাজিয়ে যাচ্ছেন, “ইতিহাসে আমরা প্রায়শই দেখে থাকি যে ধর্ম, প্রকৃতপক্ষে যেটির আমাদের উত্থান, নিজেকে উন্নত ও মহত্তর করতে সহায়তা করার কথা সেটি আমাদের পশুতে পরিণত করছে। মানুষকে আলোকিত করার বদলে তাদের অন্ধকারাচ্ছন্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, হৃদয়কে প্রসারিত করার বদলে নিয়মিত ভাবে সংকীর্ণ হৃদয়ের সৃষ্টি করছে এবং অন্যদের প্রতি অসহিষ্ণু করে তুলছে।” (পৃষ্ঠা ৩৭, সিলেক্টেড রাইটিংস অফ জওহরলাল নেহরু, ১৯১৬-১৯৫০, সংস্করণ জেএস ব্রাইট, ইন্ডিয়ান প্রিন্টিং ওয়ার্কস, নিউ দিল্লি)
সম্প্রতি শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূটের কামতানাথ মন্দিরে পুজো দিয়েছেন রাহুল গান্ধী (ছবি:টুইটার)
গান্ধী যে রামরাজ্যের উপরে জোর দিয়েছিলেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন নেহরু এবং এই বিষয়টিকে তাঁর মত হল, “অতীতে তা কখনও ভালো ব্যাপার ছিল না এবং আমি চাই না যে তা আবার ফিরে আসুক।”
তিনি অবশ্য ভারতে আসা ফরাসি সাংবাদিক তিবোর মেন্দের সঙ্গে কথোপকথনে গান্ধীর প্রতি তাঁর হৃদয়ে নিহিত থাকা শ্রদ্ধাই ফুটে উঠেছিল, “উনি চিরকালই রামরাজ্যের কথা বলে এসেছেন। আমার মতো একজন ব্যক্তির কাছে এ হল প্রাচীন যুগে ফিরে যাওয়ার মতো ভাবনা, তবে এটা এমন একটি শব্দবন্ধ যার অর্থ দেশের প্রতিটি গ্রামবসীই অনুধাবন করতে পারবেন... ঘটনা হল গান্ধী সদাসর্দা দেশের জনমানসের কথা ভেবেছেন এবং সব সময় ভারতের কথা ভেবেছেন এবং দেশকে সর্বদাই সঠিক পথে পরিচালিত করার কথা ভেবে গিয়েছেন।” (পৃষ্ঠা ৩৬, কনভার্সেশন উইদ মিস্টার নেহরু, সেকের অ্যান্ড ওয়ারবার্গ, ১৯৫৬)
বর্তমান কংগ্রেস নেতাদের একাংশ চাইছেন রাহুল গান্ধীও গান্ধীবাদ ও নেহরুবাদের মধ্যে যে কোনও একটি পথই বেছে নিন, একবার এঁর পথে আবার উল্টো দিকে গিয়ে আরেক জনের পথ বেছে নেওয়া, ঈই ভাবে বারে বারে পাল্টি খেলে বিষয়টি না ঘরকা না ঘাটকা হয়েই থাকবে। তবে গোপনে একটা কথা বলে রাখি, রাহুল যদি গান্ধীজির পথে চলে এ কথা বলেন যে ধর্ম হল অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার এবং তা জনসমক্ষে সাড়নম্বড়ে পালন করতে হবে তা হলে কংগ্রেসের সেই সব নেতারা অবাকই হবেন।
তাঁর দিক থেকে রাহুল খুব ভেবেচিন্তেই এগোচ্ছেন। সম্প্রতি কৈলাস ও মানসসরোবরে তাঁর ‘ধর্মীয় যাত্রা’ তাঁকে ‘শিবভক্ত’ বলে পরিচিতি দিয়েছে এবং মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনের আগে তাঁর সংকল্প যাত্রা তাঁকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে।
সম্প্রতি রাহুল ছিলেন পূর্ব মধ্যপ্রদেশে এবং রামের নামের সঙ্গে জড়িত চিত্রকূটের বিখ্যাত কামতা নাথ মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছেন।
মধ্যপ্রদেশের সাতনায় একটি মন্দিরে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ও কমল নাথ (কংগ্রেস/টুইটার)
১৯৮০ সালের ৫ এপ্রিল এই মন্দির দর্শন করেছিললেন ইন্দিরা গান্ধী, সেখান থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ফিরে পেয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যজনক হল যে দিন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল যে ইসলামে মসজিদ আবশ্যিক নয়, সে দিন টেলিভিশন বিতর্ক এড়িয়ে গেলেন কংগ্রেস নেতারা।
তাদের নেতৃত্ব কোন তত্ত্বে বিশ্বাস করে এবার সাহস করে সে কথা বলার সময় এসেছে এই দলটির।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে