দরিদ্রদের ন্যূনতম আয়ের যে ভাবনা রাহুলের, সে জন্য টাকা পাবেন কী ভাবে?
অনাদায়ী ঋণের টাকা সরকার পরিশোধ না করলেই এই অর্থের সংস্থান হতে পারে
- Total Shares
‘প্রত্যেক দরিদ্রকে ন্যূনতম রোজগারের নিশ্চয়তা’ দেওয়া হবে বলে অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, এ নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন -- তবে ভিক্টর হুগোর থেকে কথা ধার নিয়ে ১৯৯১ সালের বাজেটে উদারনীতির দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়ার সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, “বিষয়টি হল যখন যে সময় আসে।”
এই প্রেক্ষিতে বলা চলে, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির মোকাবিলা করার জন্য গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বেই একটা ধারা চালু হয়েছে – বিপুল ভাব আয়ের পুনর্বণ্টন করা – তা করা হচ্ছে ব্যাপক ভাবে বেড়ে চলা অসাম্য এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হওয়ার জন্য বেকারত্ব বেড়ে চলা।
- ভারতও এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে দেশের নীতি নির্ধারকদের যে সমস্যাটির সমাধান করতে হবে তা হল আয়ের অসাম্য বেড়ে চলা ও বেকারত্বের মতো দু’টি বড় সমস্যার, তবে ঘটনা হল, নীতি নির্ধারকরা এই দু’টি সমস্যার দিকে নজরই দিচ্ছেন না।
ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তার (এমআইজি) প্রাথমিক দিকটি হল, যাঁরা একেবারে প্রান্তিক তাঁদের পরিবারের জীবন সম্মানের সঙ্গে অতিবাহিত করা সুানিশ্চিত করা। রাহুল গান্ধীর পরিকল্পনাটি পুরোপুরি ভাবেই দরিদ্রদের জন্য – ধরে নেওয়া যেতে র যাঁরা দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছেন, এই প্রকল্প তাঁদের জন্য। যখন বিস্তারিত প্রকাশিত হবে তখনই প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে।
এনডিএ-র ইউবিআই বনাম রাহুল গান্ধীর এমআইজি
ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম (ইউবিআই)-এ একটি মোচড় দিয়েছেন রাহুল গান্ধী – যেটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬-১৭য় প্রথম আলোচিত হয়েছিল। অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি ছিল -- “এমন একটি ন্যূনতম আয় যেটা ধর্তব্যের মধ্যে আসবে যা দিয়ে তাঁরা সম্মানজনক ভাবে ন্যূনতম প্রয়োজনের জিনিসগুলি নাগালের মধ্যে পেতে পারেন।”
ইকোনমিক সার্ভে প্ল্যান অনুযায়ী বছরে বছরে ৭,৬২০ টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল – ২০১১-১২ সালের তেন্ডুলকর দারিদ্র্যরেখা ২০১৬-১৭ সালের মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ।
এর অর্থ হল, এটি মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের র ৪.৯ শতাংশ – এই খাত পূরণ করা যেতে পারে জিডিপির ৫.২ শতাংশ অর্থ দিয়ে, যে অঙ্ক বরাদ্দ করা হয়েছে ২০১৭-১৭ সালে ৯৫০টি কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে চলা উপ-প্রকল্পগুলিতে।
উল্টোদিকে রাহুল গান্ধীর পরিকল্পনা দেখে মনে হচ্ছে তাঁর লক্ষ্য শুধুমাত্র গরিবরাই (তবে তেন্ডুলকর যে জনসংখ্যার ২২ শতাংশকে বলছেন সেটিকে নাকি রঙ্গরাজন যে জনসংখ্যার ২৯.৫ শতাংশকে বলছেন তাকে, কোনটির কথা তিনি ভাবছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়) এবং ‘ন্যূনতম আয়’ বলতেই বা তিনি কী বুঝিয়েছেন, তাও স্পষ্ট নয়।
প্রতি বছর ১ কোটি ২৮ লক্ষ তরুণ কাজের সন্ধান শুরু করছেন, এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। (উৎস: রয়টার্স)
ইউবিআই এবং এমআইজির মধ্যে পার্থক্য হল – প্রাথমিক আয় বলতে সাধারণ ভাবে বোঝায় দারিদ্র্যসীমা (অর্থনৈতিক সমীক্ষায় যা বলা হয় বা অর্থনীতির দুনিয়ায় যে ব্যাখ্যা করা হয়), উল্টোদিকে ন্যূনতম আয় নির্ভর করে কোনও এক ব্যক্তির নিজস্ব ধারনার উপর; যা দারিদ্র্যসীমায় বসবাসকারীদের ব্যয়ের সমান, তার চেয়ে বেশি কিংবা কম হতে পারে।
অসাম্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধি
কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তথ্যপরিসংখ্যান প্রকাশ করা কেন্দ্রীয় সরকার বন্ধ করে দিলেও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) ২০১৮ ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক ট্রেন্ডস অনুযায়ী, বেকারত্বের হার প্রতি বছর ৩.৫ হারে বেড়ে ভারতের বেকারত্ব ২০১৮ সালের ১ কোটি ৮৩ লক্ষ থেকে বেড়ে ২০১৯ সালে হতে পারে ১ কোটি ৮৬ লক্ষ।
সমীক্ষার রিপোর্ট -- ২০১৬-১৭ সালের এমপ্লয়মেন্ট-আনএমপ্লয়মেন্ট সার্ভে রিপোর্ট -- যে রিপোর্টটি সরকার আটকে রেখেছে, সেই রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে ৩.৯ শতাংশ হারে লাফিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব – যা ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৩.৭ শতাংশ এবং ২০১৩-১৪ সালে ছিল ৩.৪ শতাংশ।
এর অর্থ আইএলও যে হার দেখাচ্ছে তার চেয়ে এই হার বেশি।
প্রতি বছর ১ কোটি ২৮ লক্ষ করে তরুণ নতুন করে কাজের সন্ধান শুরু করছেন, তবে শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ১ কোটি ১০ লক্ষ কাজ কমেছে – অন্তত সিএমআইই-র সমীক্ষা সেই কথাই বলছে।
২০১৭ সালে ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও লুকাস চ্যান্সেল তাঁদের গবেষণাপত্র ইন্ডিয়ান ইনকাম ইনইকুয়ালিটি, ১৯২২-২০১৫: ফ্রম ব্রিটিশ রাজ টু বিলিয়নেয়ার রাজ-এ দেখিয়েছিলেন যে, “ব্রিটিশ রাজের সময় এখনও পর্যন্ত যে কোনও সময়ের বিচারে ভারতে আয়ের বৈষম্য অনেক বেশি হয়েছে এবং সবেচেয়ে বেশি রোজগারের ১ শতাংশ মানুষ মোট আয়ের ২২ শতাংশের অধিকারী।”
অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ১৩.৬ কোটি ভারতীয় গত ১৫ বছর ধরে এক টানা দেনায় ডুবে আছেন, শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ভারতের ১১৯ জন বিলিয়নেয়ারের (১০০ কোটি ডলারের মালিক) সম্পদ দৈনিক গড়ে ২,২০০ কোটি টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অক্সফ্যামের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টরের মতে এটি “নৈতিক বিচারে ভয়াবহ” এবং তিনি চেতাবনি দিয়েছেন যে, “যদি প্রথম ১ শতাংশ ও দেশের বাকি মানুষের মধ্যে এই মারাত্মক বৈষম্য চলতে থাকে তা হলে এই পরিস্থিতি দেশের সামাজিক ও গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
গরিবমানুষ খুঁজে বার করা ও অর্থের সংস্থান করা
- যখন রাহুল গান্ধী এমআইজি নিয়ে তাঁর ঘোষণা করেছেন তখন এই দুটি প্রশ্নই অনেক বেশি করে সামনে চলে এসেছে – এক, কী ভাবে সুবিধাভোগীদের খুঁজে বার করা হবে এবং দুই, ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তা করা সম্ভব কিনা।
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর অতীব সহজ: যে ভাবে ‘আয়ুস্মান ভারত’ প্রকল্পের জন্য সুবিধাভোগী খুঁজে বার করা হচ্ছে – ২০১১ সালের সোশিয়ো-ইকোনমিক অ্যান্ড কাস্ট সেন্সাসের তালিকা থেকে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে রাহুল গান্ধী যতক্ষণ পর্যন্ত না ‘ন্যূনতম’ অঙ্কটি আমাদের জানাচ্ছেন।
যদি ধরে নেওয়া হয় যে তিনি তেন্ডুলকর-নীতি অনুসরণ করে দেশের ২২ শতাংশ মানুষকে গরিব বলে ধরে নেন এবং ইউবিআই-এর উপরে বছরে ৭,২৪০ টাকা দেন, তা হলে দেশের জিডিপির ১.৪৩ শতাংশ খরচ করতে হবে (অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী যেহেতু জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ রযেছেন ৪.৯ শতাংশ জিডিপির মধ্যে) অথবা ১,৯৯,৫১১ কোটি থেকে ১,৩৯,৫১,৮৪৯ কোটি টাকার মধ্যে (২০১৮-১৯ সালের অ্যাডভান্স এস্টিমেট অনুযায়ী জিডিপির অঙ্ক) তাকে ১.৪৩ শতাংশ দিয়ে গুণ করে।
এই টাকা কোথা থেকে আসবে?
ঠিক আছে, ধরুন প্রতি বছর যে পরিমাণ টাকা সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রতি বছর হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলে – সহজ কথায লোকে যাকে অনাদায়ী ঋণ বা এনপিএ বলে জানে – এবং কর্পোরেট করদাতাদের থেকে যে অঙ্কের অর্থ আদায় করা যায় না (বাজেটে যাকে রেভিনিউ ফরগন বলা হয়) সেই টাকা একটা উৎস হতে পারে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অপারেশনস অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স অফ কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কস অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে যথাক্রমে ১,০৮,৫০০ কোটি টাকা ও ১,৬২,৭০০ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ মুছে ফেলা হয়েছে।
একই ভাবে ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে যথাক্রমে ৮৬,১৪৫ কোটি টাকা ও ৮৫,০২৬ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে অনাদায়ী ঋণ এবং ধনী ভারতীয়দের কাছ থেকে আদায় না করতে পারার জন্য যথাক্রমে ১,৯৪,৬৪৫ কোটি টাকা ও ১,৪৭,৭২৬ কোটি টাকা হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলেছে সরকার – যে অঙ্কটা মোটামুটি গরিব ভারতীয়দের এমআইজির অঙ্কের মতোই।
এই অর্থ সংস্থানের অন্য উপায়ও রয়েছে। অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন পরামর্শ দিয়েছেন, সম্পদ, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও দীর্ঘমেয়াদী মূলধনী লাভের উপরে কর আরোপ করতে – অর্থাৎ যে সব সম্পত্তি এখনও করের আওতায় আসেনি বা যে সব সম্পত্তির জন্য এখনও কর আদায় করা হয় না সেগুলিকে করের আওতায় নিয়ে আসা। তা হলেই যথেষ্ট হবে।
শুধু একটা সাবধানবাণী – তা সে ইউবিআই হোক বা এমআইজি, ৯৫০টি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প থেকে যেন সেই অঙ্ক আদায় করবেন না। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে খাদ্যে ভর্তুকি, সারে ভর্তুকি, এমজিএনআরইজিএ, এসএসএ, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি, আবাস যোজনা, গ্রামসড়ক যোজনা, আইসিডিএস, স্বচ্ছ ভারত, মিড-ডে মিল প্রভৃতি।
অন্য ভাবে বলতে গেলে, এগুলো করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য (শিক্ষা, স্বাস্থ্য) এবং গ্রামীণ পরিকাঠামো (রাস্তা, আবাসন) – ইউবিআই বা এমআইজি এগুলির কোনওটিরই পরিপূরক নয়।
অন্তত তত দিন করা যাবে না যত দিন মাথাপিছু আয়ের নিরিখে একেবারে নীচের দিকে পড়ে থাকবে। ইউএনডিপি-র এইচডিআই ২০১৮ অনুযায়ী, ১৮৯টি দেশের মধ্যে এখন ভারতের ক্রমাঙ্ক ১৩০।
একবার যখন ভারত নিম্ন আয়ের বর্তমান ফাঁদ থেকে বার হয়ে আসবে তখন এই ধরনের প্রকল্পগুলির বদলে সরাসরি অর্থ প্রদান করে দেওয়া যাবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে