দ্রুত বা কোনও রকমে পরিকল্পনা করে যুদ্ধ করলে পুলওয়ামার বদলা নেওয়া যাবে না
- Total Shares
যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই বলে যাঁরা হইচই করছেন, যুদ্ধের অনিবার্য ফল – মানুষের জীবনহানি এবং অর্থনৈতিক ভাবে ধাক্কা – সম্বন্ধে তাঁদের ধারণা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।
১৯১৪ সালে ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমানসো বলেছিলেন, “যুদ্ধ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেনাপ্রধানদের উপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত।”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি তাঁর দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন – সেই যুদ্ধের পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ও বিপুল সম্পত্তিহানি হয়েছিল।
তবে ভারতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে যুদ্ধ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে এ ব্যাপারে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, যুদ্ধের ব্যাপারে যাঁদের বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা নেই। একই সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার রয়েছে, নীতি নিরুপণের কোনও রীতি এ দেশে নেই, উপত্যকায় নিযমিত যা হচ্ছে – বা দেশের অন্য কোনও জায়গায় – সব কিছু নিয়ে সাদামাঠা রাজনীতি হচ্ছে।
ভারতের তিন শীর্ষ সেনাকর্তা – তাঁরা নীতি নির্ধারণ করুন বা যুদ্ধযাত্রা, কার ইচ্ছায় করবেন, রাজনীতিকদের নির্দেশে নাকি জনতার ইচ্ছায়? (ছবি: ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিসার্চ উইং)
বিশ্বে সম্ভবত আমরাই একমাত্র দেশ, যে দেশে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সেনাপ্রধানদের কোনও ভাবে যুক্ত করা হয় না – একবার ভেবে দেখুন, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছেন রাজনীতিকরা, আমলারা এবং পুলিশকর্মীরা। ১৯৯০ সাল থেকে আমরা বারে বারে আক্রান্ত হয়েছি যে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের মাটিতে বসে, বিশ্বের অন্য কোনও দেশের সঙ্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তারা কালবিলম্ব না করেই প্রত্যাঘাত করত – প্রতিশোধ বলুন বা প্রত্যাঘাত করা, তৎক্ষণাৎ কিছু করলে তবেই তার কার্যকারিতা থাকে।
আমরা এই ধরনের ঘটনা আমাদের আগে থেকে আন্দাজ করা উচিত – এবং এই ধরণের আকস্মিক ঘটনা মোকাবিলা করার মতো পরিকল্পনাও করে রাখা উচিত।
আমরা কি তা করি? আমি নিশ্চিত নই।
আমাদের প্রতিবেশী জানে যে সকলে মিলে বুক চাপড়াবে, চিৎকার করবে, সকলে বিহ্বল হয়ে পড়বে এবং কোনও কিছু করার আগে তথ্য বিকৃত করা হবে – আদৌ যদি কিছু করা হয়। এবং তার পরে, যখন এই ধরনের হামলা হবে তখন রাজনৈতিক দলগুলো প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে তারা অন্যদলের চেয়ে কতটা ভালো – যেমন বহুচর্চিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, প্রতিপক্ষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারা ছাড়া সবই হয়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হোক সত্যিকারের সমাধান, আচমকা হামলা করে রাজনৈতিক বাহ্যাড়ম্বর নয়। (উপস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত ছবি: রয়টার্স)
পুলওয়ামার ক্ষেত্রে পাকিস্তান হোক বা তাদের সেনার উপর হোক, আঘাত হানতে হলে নির্ভুল ভাবে হানতে হবে এবং উপযুক্ত পরিকল্পনা করে হানতে হবে একই সঙ্গে এর মাত্রা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সেই সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখতে হবে। আরও অনেক ব্যাপার রয়েছে – বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুতির ব্যাপারে আমরা একবারে নিম্নস্তরে ছিলাম, তাই কোনও রকম তাড়াহুড়ো করলে, বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেললে প্রতিকারের বদলে আরও বেশি মাত্রায় অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এর বাইরে চিনের কথাটাও বিবেচনা করতে হবে।
আমাদের একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে এই গতে বাঁধা প্রত্যাঘাতের পরে আমাদের হাতে প্রকৃতপক্ষে কী থাকবে – সুতরাং আঘাত হানা যদি অনিবার্যই হয় তা হলে সেটা আমরা কখন করতে কোথায় করতে চাই সেই মতো উপযুক্ত পরিকল্পনা করতে হবে। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, হিসাব কষে ভাবনাচিন্তা করতে সময় লাগে – আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা বা একদিনও যিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাটাননি সেই ধরনের ছদ্ম-দেশপ্রেমী সংবাদ সঞ্চালকের কথায় এ সব হয় না।
একথা ঠিক যে প্রতিটি ভারতবাসীই এখন ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং আবেগতাড়িত – আর সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। শ্রদ্ধেয় কুশলী ভন ক্লজউইৎজ বলেছিলেন, যুদ্ধঘোষণা করা বা যুদ্ধের দিকে এগনোর ভাবনার প্রধান কারণ হতে পারে দেশের মানুষ তা চাইছে। তবে গণমাধ্যমের চাপে পড়ে জনতা বা আরামকেদারায় বসে থাকা নীতিনির্ধারকদের কথায় তক্ষুণি পাল্টা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা একেবারেই নির্বোধের কাজ।
আমাদের নিজেদের কোথায় ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল সে কথাও আমাদের বেশ কঠোর ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে – গোয়েন্দা তথ্য ঠিকমতো না দেখা বা সেখানে গলদ থাকা, গতিবিধির ক্ষেত্রে শৈথিল্য এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন ও উপযুক্ত পদক্ষেপ না করা। আমাদের কঠোর-কঠিন ভাবে বিচার করে দেখতে হবে কী ভাবে আমরা (রাজনৈতিক প্রশাসন) দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি কার্যকলাপ বরদাস্ত করেছি এবং দেশের মধ্যে ‘পুরোমাত্রায় বিদ্রোহ’ করার ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে মদত পাওয়াকেও বরদাস্ত করে এসেছি। মানুষকে ওদের ছুড়ে ফেলতে হবে, কারণ ২০১৪ সাল থেকে জঙ্গিহামলায় আমরা বহু দক্ষ সৈনিককে হারিয়েছি।
কেন পুলওয়ামার ঘটনা ঘটল তা খতিয়ে দেখতে আমাদের নিজেদের দিকটাও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। (ছবি: রয়টার্স)
পচন ধরা, পাথর ছোড়া, বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই এমন জনতা – এই পরিস্থিতিটাই মাঝের সময়টাতে রাজনৈতিক তোষণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যদি কেউ ঠিক ভাবে ভাবনা-চিন্তা করেন, তিনি দেখবেন যে কী উদ্ভট একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যার জন্য আমরা বিজয়ের মুখ থেকে পরাজয় ছিনিয়ে আনতে পারছি।
ভারতের কাছে যদি আক্রমণ করাটাই অনিবার্য বলে মনে হয় তা হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের দ্বারাই সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে হবে – পাকিস্তানি সেনা এবং আইএসআই-এর প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্ত একেবারেই নেওয়া যাবে না।
এর জন্য দরকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক ভাবে সেনা অভিযানকে উদ্দীপ্ত করা, শুধুমাত্র ওই শেষেরটি দিয়ে পাকিস্তানকে বাগে আনা যাবে না। শুধুমাত্র পাক অধিকৃত কাশ্মীরের খানকয়েক জঙ্গিশিবির ভেঙে দিয়ে কাজেরকাজ কিছুই হবে না, কারণ আফগানিস্তানে বিপুল সংখ্যায় বিপথে চালিত হওয়া ধর্মান্ধ ও জেহাদের জন্য লালায়িত লোক পাকিসস্তানের হাতে রযেছে।
আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে ২০১৬ সালে তথাকথিত ভয়ানক সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। আমরা যদি কঠোর বার্তা পাঠাতে চাই তা হলে উপযুক্ত কাজটি হল বাহাওয়ালপপুরে জৈশ-ই-মহম্মদের সদর দফতরে ড্রোন এমনকি দরকারে নির্ভুল ভাবে লক্ষ্য আঘাত করতে সক্ষম এমন দক্ষ বিমান আক্রমণ করা। তবে এ ক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি থেকে যাবে, তা হল আমরা দ্বন্দ্বটাকে জম্মু-কাশ্মীর ছাড়িয়ে আরও ভিতরে নিয়ে চলে যাব এবং এ জন্য অন্তত সেনার বিচারে পাকিস্তান একটু ভালো অবস্থানে থেকে থাকতে পারে। চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থানুকূল্যে তারা তাদের সমরাস্ত্র ও সমরসজ্জা আরও উন্নত করছে।
আমাদের সেনাদের ‘শহিদ’ বলার আমি তীব্র বিরোধী। কারণ আমার মনে হয় শহিদ হলেন তাঁরাই যাঁরা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের সেনারা লড়াই করছেন দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষার জন্য, তাই হয় আমাদের হত্যা করা হয়, অথবা আহত করা হয় অথবা লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হয়। সেনাদের জন্য একটা শব্দবন্ধ ইতিমধ্যেই রয়েছে ইংরেজিতে – ব্যাটল ক্যাজুয়ালটি, ব্যাটল অ্যাক্সিডেন্ট, কেআইএ, এমআইএ।
আমাদের নিহত সেনানীকে শহিদ বলার ব্যাপারে পাকিস্তান আগ্রহী হতে পারে।
অপরিণত পরিকল্পনার জন্য আমরা আত্মবলিদান ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। (ছবি: রয়টার্স)
সব শেষে বলব, দ্রুত কিছু একটা করতে বলার পরে যা দেখা গেল, তাতে আমাদের সেনার শীর্ষকর্তাদের পরিস্থিতি বিচারে নৈপু্ণ্যের দিকটিই উঠে এসেছে। কোনও একটা জায়গায় যেতে, কোনও লক্ষ্য স্থির করতে পরিকল্পনা করতে এবং তা সম্পাদন করতে সেনাবাহিনীর সময় লাগে। সুতরাং এখন দেখতে হবে যে কী ঘটছে – কতটা কী ঘটছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে