পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পরে নতুন ভারতের জন্ম হয়েছে, এই ভারত সাহসী ও ধর্মবিশ্বাসী
ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে কুম্ভকর্ণ -- সংযম নয়, প্রত্যাঘাত চায় এই ভারত
- Total Shares
সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর পুলওয়ামাতে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জৈশ-ই-মহম্মদ জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার পর ভারত যে ভাবে প্রত্যাঘাত করল সেই প্রসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষাবিদ ক্রিস্টিন ফেয়ার সম্প্রতি একটি মন্তব্য করেছেন, "মনে হচ্ছে একটি ঘুমন্ত দৈত্য জেগে উঠেছে"।
যে ভাবে আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে এই ভয়ানক ও কাপুরুষোচিত হামলার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে 'ভারতের' কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে। নয়াদিল্লি এখন পাকিস্তান প্রসঙ্গে বহু বছর ধরে চলতে থাকা 'সংযম' নীতির বাইরে ভাবতে শুরু করেছে।
বিনা যুদ্ধে যে ভাবে চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে হত্যা করা হল তা দেখে অনেকেই মনে করছে যে এই হামলা ভারতের 'শিশুপাল তত্ত্বকে' ভঙ্গ করেছে। মহাভারতের কাহিনি অনুযায়ী, শিশুপালের ভাগ্যে লেখা ছিল যে তাঁর মৃত্যু একমাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হাতেই হবে। শিশুপালের মায়ের অনুরোধে শ্রীকৃষ্ণ অবশ্য কথা দিয়েছিলেন যে শিশুপাল যতদিন না ১০০টি পাপ করছেন ততদিন তিনি তাঁকে হত্যা করবেন না।
শাস্তি পাচ্ছেন শিশুপাল [সৌজন্য: উইকিম্যাপিয়া কমন্স]
এই বর লাভ করে, শ্রীকৃষ্ণের 'দুর্বলতার' সুযোগ নিয়ে শিশুপাল যেখানে সেখানে শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করতে শুরু করে দেন। কিন্তু, যে মুহূর্তে শিশুপাল তাঁর ১০১ নম্বর পাপ কাজটি করে ফেললেন শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র প্রয়োগ করে শিশুপালকে হত্যা করলেন।
ভারতের অবস্থা কতকটা তাই। পাকিস্তানের বহু পাপ করা সত্ত্বেও ভারত এতদিন ধরে পাকিস্তানের প্রতি সংযম দেখিয়ে এসেছিল। ২৬/১১ মুম্বাই হামলার সময়ে দেখা গেল যে পাকিস্তান থেকে ১০জন জিহাদি এদেশে প্রবেশ করে ১৬০জনকে হত্যা করল। আরও বহু লোক এই ঘটনায় আহতও হয়েছিলেন। মুম্বাইয়ের রেল বিস্ফোরণ, অক্ষরধাম মন্দিরের হত্যাকাণ্ড, দেশের সংসদ ভবনে হামলা - সীমান্তের ওপার থেকে সংগঠিত আক্রমণের তালিকাটা বেশ বড়।
কিন্তু এই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে পুলওয়ামা হামলার পর ভারতীয়দের পিঠ যেন দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। ভারত যেন শেষ পর্যন্ত তার 'মানবিকতার' খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভারত যেন বুঝতে পেরেছে একমাত্র প্রত্যাঘাত করেই নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব। পুলওয়ামা আক্রমণের ১২ দিনের মাথায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরের আলো ফোটার আগে, সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের আকাশে ১২টি মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমান পাঠালো ভারত। বায়ুসেনার বিমানগুলো নির্দিষ্ট লক্ষে বোমাবর্ষণ করে নিরাপদেই নিজেদের 'বেস'-এ ফিরে এল।
পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পর ভারত ও ভারতের বাইরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সিআরপিএফ জওয়ানদের দেহগুলো যখন দেশের ছোট ছোট শহর বা প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছালো তখন যে পরিমাণ আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল তা আগে কখনও দেখা যায়নি। নায়কদের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিল দেশবাসী।
পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার পর অভুতপুর্ব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ভারত [ছবি: রয়টার্স]
এই হামলার ফলে বুদ্ধিজীবী মহলেও বেশ সাড়া পড়েছে। এই সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক সভারও আয়োজন করে হয়েছে। খুব সম্ভবত এই প্ৰথমবার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাটি নিয়ে আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে।
মহাভারতের শান্তি পর্বে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে আলাচারিতার উদাহরণ টেনে এই ঘটনাটির একটি চমৎকার আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণ করেছিলেন গৌতম চিকেরমানে। পুলওয়ামা জঙ্গিহামালার পরেই হঠাৎ একটি যুদ্ধের আশঙ্কা দানা বেঁধেছিল। এই যুদ্ধকে 'ধর্মযুদ্ধ' আখ্যা দিয়ে চিকেরমানে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন: ভারত কি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হবে? এটা কী ধরণের যুদ্ধ হবে? সেরা জয় কোনটা হবে? যুদ্ধ শেষে কী ভাবে সম্মান জানানো হবে?
একই ভাবে, সুমেধা ভর্মা ওঝা এই ঘটনাটির বিশ্লেষণ কৌটিল্যের দর্শন অনুযায়ী করেছেন। অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সপ্তাঙ্গ মানে সাতটি অঙ্গের কথা বলেছিলেন: স্বামী, মহারাজ; অমাত্য, মন্ত্রী; জনপদ, দেশ ও জনগণ; দুর্গা, দুর্গ; কোষ, কোষাগার; দণ্ড, সেনাবাহিনী; ও মিত্র,শরিক।
পারিপার্শ্বিক দেশগুলোর সঙ্গে আচরণের জন্য ছ'টি বিধি ঠিক করে দিয়েছিলেন তিনি - সন্ধি (শান্তি), বিগ্রহ (আন্দোলন), আসন (মৌন থাকা), জন (সামরিক অভিযান), সংশর্য (আশ্রয় নেওয়া) ও দ্বৈধিভব (শান্তি ও আন্দোলনের সংমিশ্রণ)। তাঁর বিশ্লেষণে ভর্মা জানিয়েছেন, "এই মুহূর্তে গান্ধী নয়, কৌটিল্যকে অনুসরণ করা উচিত। আর এই সময়ে সরকার ও সেনাবাহিনীর উপর আস্থা রাখতে হবে; স্বামী, অমাত্য ও দণ্ড"।
কিন্তু যখন খুব দ্রুত আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিলাম, বামপন্থীরা তাদের স্বভাবসিদ্ধ ঢঙেই 'সংযম' থাকার জন্য গোলমাল শুরু করে দিলেন। মিগ-২১ চেপে পাকিস্তানের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ার পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। এর পরেই বামপন্থীদের এই দাবি আরও জোরদার হয়। অনেকেই আবার শুধুমাত্র অভিনন্দনকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে 'শান্তি দূত' হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
এর থেকে আমার যক্ষের কথা মনে পড়ছে। নিরুক্ত বলে অসাধারণ একটি কাজ রয়েছে তাঁর। এই নয়ের দশকের ভাষাবিদ (কপিল কাপূরের মতে) মনে করতেন যে বিশেষ্যগুলোর উৎস ক্রিয়াপদগুলি। তবে এই বিশ্লেষণ বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল না। অন্য ভাষাবিদরা (যেমন গর্গ) মনে করতেন যে যদি সব বিশেষ্যই ক্রিয়াপদের উৎস হয়ে থাকে তাহলে একই কাজে লিপ্ত প্রতিটি ব্যক্তির একই নাম হওয়ার কথা। গর্গের বিশ্লেষণের বহু বিরোধী তত্ত্ব পেশ করেছিলেন যক্ষ। যেমন যক্ষ বলেছিলেন, যারা কাঠের কাজ করে তাদের সকলকেই সূত্রধর বলা হয়। আবার, একজন সূত্রধর কাঠের কাজ ছাড়াও আরও নানান কাজ করে থাকেন।
এই মুহূর্তে ভারতের উচিত কৌটিল্যর নীতি অনুসরণ করা [সৌজন্য: উইকিম্যাপিয়া কমন্স]
অর্থাৎ, শুধুমাত্র হঠাৎ একটি শান্তি বার্তা পাঠানো মানেই কেউই শান্তির দূত হয়ে যায় না। শান্তির দূত হতে গেলে একজনকে তার কার্যপ্রণালী ধারাবাহিক ভাবে দেখিয়ে যেতে হয়।
এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তান যে বরাবরই হিন্দুদের ঘৃণার চোখে দেখে তা পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পরে প্রকাশ্যে এসেছে। পুলওয়ামার আত্মঘাতী জঙ্গি একজন কাশ্মীরি, যাকে সীমান্তের ওপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে তাকে একটি ভিডিয়োতে হিন্দু, গরু ও বিভিন্ন বিষয়ে বেশ অপমানজনক মন্তব্য করতে দেখা গিয়েছে। এর পরে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে পাকিস্তানের মন্ত্রীদেরও হিন্দুদের সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য করতে দেখা গিয়েছে। যুদ্ধবন্দি অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এমএস গ্রেওয়ালও একটি টিভি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যে বন্দিদশায় হিন্দু বলে তাঁকে পাকিস্তানে কী ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
'হিন্দু কাফির'দের প্রতি এই ঘৃণা নতুন ব্যাপার নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত এবং হাডসন ইন্সিটিউটের অধিকর্তা (দক্ষিণ ও মধ্যে এশিয়া) জানিয়েছিলেন, "চরমপন্থী মুসলমানরা হাদিথ (পয়গম্বর মহম্মদের মুখনিঃসৃত বাণী) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে ভারতে একটি বড় মাপের যুদ্ধ আয়োজন করতে চায়। হাদিথে উল্লেখিত ঘাজওয়া-ই-হিন্দ (ভারতের যুদ্ধ) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামিক খলিফা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষিণ এশিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে বলে মনে করে। যে সাম্রাজ্য পয়গম্বর মহম্মদের সময়ে বিরাজ করত।"
এই শতাব্দীপ্রাচীন ঘৃণার মধ্যেই পুলওয়ামা জঙ্গি হামলার পর এক নতুন ভারতের জন্ম হয়েছে।
এই ভারত প্রতি ক্ষেত্রেই জাগ্রত। এই ভারত নিজের সম্পর্কে সজাগ, আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের ধর্ম সম্পর্কে সচেতন। এই ভারত একটি ন্যায়নিষ্ঠ যুদ্ধ লড়তে প্ৰস্তুত।
মহাভারত বলছে, ধর্ম রক্ষতি রক্ষিত - যারা ধর্মের পুজো করে তাদের ধর্মই রক্ষা করে। ভারত আবার নতুন করে সেই শিক্ষা নিচ্ছে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে