পুলওয়ামায় জঙ্গিহামলা: কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের এক সুর, ভারতে বিভাজন কেন?
কাশ্মীর নিয়ে বিভ্রান্তির জেরে অলক্ষ্যে ব্যয় রাফাল-বিমুদ্রাকরণের ক্ষতির অভিযোগের চেয়ে বেশি
- Total Shares
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর সব ভারতীয়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু একই সঙ্গে লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে, এখন আমাদের প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার রাষ্ট্রের দশা, যারা দশকের পর দশক ধরে এমন বর্বরোচিত আক্রমণ সহ্য করে মানুষের জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়ে চলেছে।
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলায় বহু সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। (সূত্র: রয়টার্স)
পুরোমাত্রায় যুদ্ধ যে এখন সম্ভব নয় এ কথা সত্যি। পরমাণু হামলার ভয় আমাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছে। তবে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় এমন অনেক উপায় আছে যেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ না করেও শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যায়।
কেউ যদি মনে করেন যে ভারত নামক রাষ্ট্রটি হাত-পা গুটিয়ে বসে রয়েছে তবে সেটি হবে নিতান্তই শিশুসুলভ ভাবনা। তবে যা হচ্ছে সেটি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। মিনমিন করে কথা না বলে যা বলার তা খুব স্পষ্ট ভাবে বলতে হবে। মানে এ কথাও মানতে হচ্ছে যে এখনও পর্যন্ত আমরা যে সব পদক্ষেপ করেছি তা যথেষ্ট নয়।
একটা কথা আমাদের মেনে নিতেই হবে যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের যে প্রভাব উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে পড়েছে সেই একই ধরনের প্রভাব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পড়েনি এবং স্থানীয় জঙ্গিদের উপরেও পড়েনি। বিমুদ্রাকরণের যে প্রভাব বা ক্ষতি জঙ্গি কার্যকলাপের উপরে পড়েছিল খুব শীঘ্রই সীমান্তের ওপার থেকে নতুন মুদ্রা এনে তারা 'মুদ্রাকরণ' করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে ফেলে।
তবে 'শ্রীযুক্ত ৫৬ ইঞ্চি' বলে আমরা নরেন্দ্র মোদীর সরকারের নিন্দা করার আগে আমরা আগের সরকারগুলির কাছেও প্রশ্ন করব যে তারা গত তিন দশক ধরে কী করেছে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একঘরে করে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। (সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে)
নরেন্দ্র মোদী ও এনডিএ সরকার একটা ব্যাপারের জন্যই দায়ী, তা হল জনসাধারণের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া (তারা অন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা করেছে) এবং সেই নিজেদের সেই জায়গা ধরে রাখতে না পারা। মানে এটা সেই এক পা এগিয়ে দু-পা পিছিয়ে যাওয়া। গণমাধ্যমের কাশ্মীর বিশেষজ্ঞ, বিরোধীদের চরম বিরোধিতা ও অভ্যন্তরীণ সমালোচনায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিজেপি সরকারও অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিল। তার ফলেই কাশ্মীর নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব রয়ে গিয়েছে, এ জন্য যখন বড়সড় ঝাঁকুনি আসে তখন আত্মরক্ষামূলক একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
তবে একটি জাতি হিসাবে আমাদের সবচেয়ে বড় দোষ হল জাতীয় নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। ঠিক হোক বা ভুল, কাশ্মীর নীতির ক্ষেত্রে দেশ হিসাবে পাকিস্তানের নীতিতে যৎসামান্য মতভেদ দেখা যায়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা ভাঙা সংসারের মতো নানা জন নানা সুরে কথা বলছি।
কাশ্মীরের তথাকথিত মূল স্রোতের রাজনীতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে চিরকালই দ্বিমুখী অবস্থান দেখিয়ে এসেছে। তাদের স্বার্থ চরিতার্থ হবে কিনা সে ব্যাপারে তারা বিভিন্ন ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাজিয়ে নিয়েছে এবং নির্লজ্জ ভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দিল্লিতে যতবার সরকার বদল হয়েছে ততবার ভূখণ্ডের বাদবাকি দলগুলো কপোত ও শ্যেনের মধ্যে সুবিধাজনক একজনকে বেছে নিয়েছে।
নাগরিক সমাজের এখন এ কথা বলার সময় এসেছে যে – যথেষ্ট হয়েছে, কোনও দিন যে লড়াই শেষ হবে না সেই লড়াই লড়তে গিয়ে আমরা আমাদের সিংহহৃদয় সেনাদের হারাতে পারব না।
এই বছরের শেষে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে সেটা কোনও কথা নয়, “আমরা ভালোবাসা দিয়ে তাদের জয় করব” বা “কোনও শত্রুকে ছাড়া হবে না” গোছের ভাঙা রেকর্ড না বাজিয়ে কাশ্মীর-নীতি নিয়ে সকলকে একসুরে কথা বলতে হবে। কাশ্মীর নিয়ে জাতীয় স্তরে মতৈক্য গড়ে তোলা এবং যুক্তিপূর্ণ একটি উপসংহার টানার দায়িত্ব নিতে হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেই।
৭০ বছর ধরে কাশ্মীর নিয়ে দেশের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের যে বিভ্রান্তি রয়েছে তার জন্য অলক্ষ্যে যে ব্যয় হয়েছে, সেই অঙ্ক রাফালে যে বাড়তি খরচের অভিযোগ উঠেছে বা বিমুদ্রাকরণের জন্য যে ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে তার চেয়েও বেশি।
সব রাজনৈতিক দলকেই এ কথা বুঝতে হবে এবং কাশ্মীরপ্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শুনতে ভালো লাগে যে দেরিতে প্রতিশোধ নিলে সেটি আরও বেশি উপভোগ্য হয় (প্রতিশোধের খাবারটা ঠান্ডা খেতে ভালো লাগে)। কিন্তু যে শত্রু প্রাতঃরাশে গরম কাবার খেতে ভালোবাসে তার ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি নয়।
এখন সব ভারতীয়কেই সত্যিকারের জোশ দেখাতে হবে আর কাশ্মীর নিয়ে একেবারে রসকষহীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে সরকারকে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে