পুলওয়ামায় হামলা: ক্রোধ ও হৃদয়ের বেদনা
রাতারাতি এমন জঙ্গিহামলা করা যায় না। কিছুটা বোঝা গেছে, বাকিটা বুঝতে হবে।
- Total Shares
তীব্র ক্রোধ ও হৃদয়ের যন্ত্রণা নিয়ে এ কথা লিখতে বসেছি।
৭০টি ট্রাকের কনভয়ে থাকা একটি ট্রাকে আচমকা আত্মঘাতী হামলা হল এবং তাতে অন্তত ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু হল। কাশ্মীরেরই বাসিন্দা এক জঙ্গি বিস্ফোরক-বোঝাই একটি গাড়ি নিয়ে প্রবল বেগে ধাক্কা মারল। কয়েকজনের অবস্থা এতটাই আশঙ্কাজনক যে আরও অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
কাপুরুষোচিত হামলায বহু সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে, অনেকে গুরুতর অসুস্থ। (ছবি: রয়টার্স)
উরির থেকেও এই হামলা অনেক বড় ধরনের এবং জম্মু-কাশ্মীরের ব্যাপারে বর্তমানে পাকিস্তানের প্রিয় জঈশ-ই-মহম্মদ দ্রুত এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
তবে প্রশ্ন হল এতজনের মৃত্যু কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত হামলার আরও একটি পরিসংখ্যান হয়েই থেকে যাবে?
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আমজাদ শোয়েব, যিনি কিছুদিনের জন্য পাকিস্তান সেনার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর ছিলেন তিনি মাস তিনেক আগে পাকিস্তানের এক পরিচিত টেলিভিশন ভাষ্যকার হামিদ মিরের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওই লেফটেন্যান্ট জেনারেল তখনই আন্দাজ করেছিলেন যে কাশ্মীরে আত্মঘাতী বোমা পবিস্ফোরণই হতে চলেছে সন্ত্রাসের পরবর্তী ধাপ। তাঁর যুক্তি ছিল, যখন কাশ্মীরের তরুণরা মনে অনুভব করতে শুরু করবে যে মারা এবং মরাই হল একমাত্র পথ তখন তারা সেই পথই অবলম্বন করবে।
কর্তারপুর হল প্রহেলিকা, সমুদ্রের ছোট্ট একটা মাছের মতো। আর এটা হল পাকিস্তানের সেই চেনা ছক – এক পা এগিয়ে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে যাওয়া।
চোরাগোপ্তায় বিশ্বাসী সেই দেশ প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ করল, বিশেষ করে যখন যখন বললেন যে পাকিস্তানের সেনা সেই একই অবস্থানে রয়েছে এবং যখন শান্তি বিরাজ করছে তখন আমরা যারপরনাই আনন্দিত। অর্থাৎ কর্তারপুরের পাল্টা হল পুলওয়ামা। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে এই ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী লাহোর বাসযাত্রা শুরু করলেন – তারপরেই ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে আইসি ৮১৪ অপহরণ করাল পাকিস্তান। ২০১৫ সালের ৫ জুলাই রাশিয়ার উফাতে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দেখা করলেন নরেন্দ্র মোদী এবং সেখানে কাশ্মীর নিয়ে কোনও কথাই বললেন না নওয়াজ শরিফ। সেই ব্যাপারটাকে 'ঠিকঠাক' করে দেওয়া হল এবং গুরদাসপুরে জঙ্গি হামলা হল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নওয়াজ শরিফের মেয়ের বিয়েতে হঠাৎ হাজির হয়ে চমক দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চোরাগোপ্তায় বিশ্বাসী দেশটি তা বাঁকা চোখেই দেখল এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে পাঠানকোটে হামলা করল।
কী ভাবে ভারতের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে পাকিস্তান (ছবি: টুইটার/ রয়টার্স)
তারপর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উরিতে হামলা, দশদিনের মধ্যে শাস্তিমূলক প্রত্যাঘাত করল করল ভারত – আর তারই উত্তরে ওই বছরের নভেম্বর মাসেই নাগরাকোটায় জঙ্গি হামলা করল পাকিস্তান।
কাশ্মীরের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সবচেয়ে পছন্দের জঙ্গি সংগঠন হল জঈশ-ই-মোহম্মদ, তারা যে উপত্যকায় শক্তিশালী হচ্ছে এটা তারই একটা লক্ষণ।
বর্তমানে অন্য কোনও জায়গায় মোতায়েন রয়েছে লস্কর-ই-তৈবা – হতে পারে তারা এখন আফগানিস্তানে তালিবানকে সাহায্য করছে। আমরা যেন কখনও এ কথা ভুলে না যাই যে লস্কর-ই-তৈবার নেতা মাসুদ আজহারকে আমরা যতদিন না মুক্তি দিয়েছি, ততদিন সে আমাদের হাতেই ছিল, ১৯৯৯ সালে আইসি ৮১৪ বিমান অপহরণের পরে মুক্তিপণ হিসাবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতের জেল থেকে বেরিয়ে যাতে পাকিস্তানে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে মৌলানা মাসুদ আজহার, সেই জন্যই আইসি ৮১৪ অপরহণ করছিল জঙ্গিরা। (ছবি: রয়টার্স)
এই ধরনের আরও অনেক হামলা হতে পারে।
এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা রাতারাতি ঘটানো সম্ভব নয়। এই পরিকল্পনা ও তা রূপায়ণের জন্য তারা যথেষ্ট সময় নিয়েছে।
সুতরাং কী ভাবে এবং কেনই হামলা হল তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। প্রধান সড়কের উপরে হামলা, প্রকাশ্যে দিনের বেলায়, এই বহরের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই তাদের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল, নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তাদের কাছে নির্দিষ্ট তথ্য ছিল এবং ওই সেনাবাহিনী অবস্থান সম্পর্কে জঙ্গিদের কাছে প্রতি মিনিটে মিনিটে তথ্য পৌঁছেছে। হামলাকারী নিশ্চয়ই সুস্পষ্টভাবে জানত যে হামলা করার জন্য কোন জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে এবং কোন জায়গায় লক্ষে আঘাত হানতে হবে। অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট লক্ষে আঘার হানার মতো সক্ষমতা বা দক্ষতা তদের ছিল। সে একাই ওই পরিকল্পনা করেনি এবং ব্যাপারটি জানার অল্প সময়ের মধ্যে একাই সবকিছু করে ফেলেনি। ও একাই পুরো পরিকল্পনা করেনি এবং কেউ এ জন্য বিস্ফোরক জোগাড় করে দিয়েছিল। ওই এলাকার ব্যাপারে সম্যক ধারনা ছিল জঙ্গিটির এবং কী জন্য সে যাত্রা শুরু করছে সেই ব্যাপারেও তার সম্যক ধারনা ছিল। এর পরেও কেউ জিজ্ঞাসা করতেই পারে যে – এতগুলো গাড়ি কেন একসঙ্গে যাচ্ছে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত এই সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা কী ছিল।
পুলওয়ামায় আত্মঘাতী ওই কাপুরুষোচিত বিস্ফোরণের কলঙ্ক এই ভিডিয়োয় দাবি করছে জঈশ-ই-মহম্মদ। (ছবি: টুইটার)
এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী হামলা রাতারাতি ঘটানো সম্ভব নয়। পুরো ব্যাপারটা হিসাব কষে পরিকল্পনা করতে যথেষ্ট সময় লাগে। বুহান ওয়ানি সংঘর্ষের পরে লস্কর-ই-তৈবা ও হিজবুল মুজাহিদিন একটি চুক্তি করেছে এবং তার ফলে একে অপরের পরিকাঠামো ব্যবহার করছে। এতে সেই জোটের উভয়েরই লাভ হয়েছে কারণ এর ফলে দক্ষিণ কাশ্মীরের বিভিন্ন গ্রামে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারছে লস্কর-ই-তৈবা এবং তাদের কাজকর্মেও সুবিধা হচ্ছে। জঈশ-ই-মহম্মদ একাই ছিল। হিজবুল মুজাহিদিনকে ছেড়ে আরও একটা বড় ব্যাপার জঈশ-ই-মহম্মদ করেছে, তা হল সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নির্ভরতা – লস্কর-ই-তৈবা এবং জঈশ জঙ্গি উভয়েই সোশ্যাল মিডিয়া সুন্দর ভাবে ব্যবহার করে ও বিভিন্ন ভাবে প্রচার করে ও প্রলুব্ধ করে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছে।
সে যাই হোক, গত কয়েক মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় জঈশ-ই-মহম্মদের উপস্থিতি অনেক বেশি বেড়ে গেছে। জঈশ-ই-মহম্মদ এখন তাদের প্রচারমূলক ভিডিয়ো, অডিয়ো, বিভিন্ন লেখাজোকা বিশেষ করে তাদের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ও মাসুদ আজহারের লেখা বই ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এনক্রিপ্টেড মেসেঞ্জার ব্যবহার করছে। এই হামলার দায়িত্ব নিয়ে তারা যে দাবি সম্বলিত বার্তা পাঠিয়েছে সেগুলিও সবই এনক্রিপ্টেড চ্যাট মেসেজ। এই গোষ্ঠীটির কোনও দিনই খুব একটা সমর্থন ছিল না, সমর্থন পাওয়ার জন্যই গোষ্ঠীটি বল্গাহীন ভাবে জনসংযোগ করতে শুরু করেছে।
আরও একটা ব্যাপার খুব সম্ভবত দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে খুব স্পষ্ট ভাবেই এতদিন স্থানীয় কাশ্মীরীরা ব্যর্থ হচ্ছিল, এর মূল কারণ ছিল অনুপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় রসদের অপ্রতুলতা। হামলা করার ক্ষেত্রে হোক বা সংঘর্ষের সময় – এরা বড় জোর কয়েক মিনিট টিঁকে থাকতে পারত। আরও একটা ধরণ, যেটি আগে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল, তা হল ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সে (এফএটিপি) পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার পরে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ক্রমেই মুছে যাচ্ছিল লস্কর-ই-তৈবার নাম। এফএটিপির ধূসর তালিকা থেকে বার হয়ে আসার চেষ্টা পাকিস্তান করলেও লস্কর-ই-তৈবা যে পরিচিতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রয়েছে, সেই পরিচিতির জেরে পাকিস্তানের পক্ষে এই তালিকা থেকে বার হয়ে আসা সুবিধাজনক হচ্ছিল না।
এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে কী ভাবে নিঃশব্দে কাশ্মীর উপত্যকায় প্রবেশ করেছে জঈশ-ই-মহম্মদ এবং এই আচমকা আক্রমণ করেছে এবং কেন তারা ভারতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠছে যেটা হিজবুল মুজাহিদিন কোনও দিন হয়ে উঠে পারেনি।
আমরা যে প্রায়শই শুনি যে রাজনৈতিকরা বলছেন তাঁরা "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর" এবং বুক বাজিয়ে বলতে থাকেন "সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জঙ্গি"কে মারা হয়েছে তা চলতে থাকবে, উপত্যকায় নতুন খেলা শুরু হয়েছে।
আফগানিস্তানের শান্তি আলোচনা এবং তালিবানকে স্বীকৃতি দেওয়া এ ব্যাপারটিকে আরও জটিল করে তুলবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে