প্রিয়াঙ্কা গান্ধী: ভারতীয় গণতন্ত্রে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি কতটা কুপ্রভাব ফেলছে
জওহরলালের হাত ধরেই ভারতে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সূত্রপাত, যা পরে মজবুত করেছেন ইন্দিরা
- Total Shares
সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধেরার প্রবেশ নতুন করে প্রমাণ করল যে ভারতের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি আদতে জন্মাধিকার সূত্রে নিয়ন্ত্রিত এবং বাস্তবিক অর্থে তা পশ্চাদমুখী ও দুর্নীতিপরায়ণ।
যাঁরা রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বিশ্বাস করেন তাঁরা নিজেদের পক্ষে দু'টি যুক্তি সাজিয়ে থাকেন।
প্রথমত: যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতন্ত্রেও পরিবারতন্ত্রের প্রচলন রয়েছে - বুশ পরিবার, ক্লিনটন পরিবার ও কেনেডি পরিবার।
দ্বিতীয়ত: আইনজীবীর সন্তানরা যদি আইনজীবী হতে পারেন, চিকিৎসকের সন্তানরা যদি চিকিৎসক হতে পারেন, অভিনেতাঅভিনেত্রীর সন্তানরা যদি অভিনয় করতে পারেন তাহলে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সন্তানরাও সক্রিয় রাজনীতি করতে পারেন।
সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা, পরিবারতন্ত্রের উপরই আস্থা রাখল কংগ্রেস [ছবি: এপি]
যুক্তিটা কি ঠিক?
না, ভুল।
আমার লেখা বইয়ের একটি অনুচ্ছেদ থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করা যাক।
"ম্যানিলার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের পলিসি সেন্টারের গবেষকরা ফিলিপিন্সের দারিদ্র্য ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে যে 'গভীর' সম্পর্ক রয়েছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ফিলিপিন্সের যে সব কেন্দ্রগুলোয় পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি কায়েম রয়েছে সেই সব কেন্দ্রগুলো অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি দরিদ্র।"
ফিলিপিন্সের সংসদে ৬৮ শতাংশ সাংসদই রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। উল্টোদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে মাত্র ছয় শতাংশ রাজনৈতিক পরিবারের। ফিলিপিন্সের (একদা যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ছিল) মাথাপিছু আয়ে যেখানে মাত্র ২,২০০ ডলার সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান মাথা পিছু আয় ৪৮,০০০ ডলার।
"জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৮৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। এর পর ২২৫ বছর কেটে গিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মোট ৪৪জন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র তিন বারই একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখা গিয়েছে - জন অ্যাডামস (১৭৯৭ -১৮০১) ও তাঁর পুত্র জন কুইন্সি অ্যাডামস (১৮২৫ - ১৮২৯); উইলিয়াম হ্যারিসন (যিনি ১৮৪১ সালের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যে মারা যান) ও তাঁর নাতি বেঞ্জামিন হ্যারিসন (১৮৮৯ - ১৮৯৩); সবশেষে, অতি সম্প্রতি, দুই বুশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এর থেকে আরও একটি বিষয়ে পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিছকই ব্যতিক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রে আদতে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির উপর নির্ভরশীল নয়। গণতন্ত্রের লক্ষই হচ্ছে ভোটারদের পছন্দের সুযোগ বাড়িয়ে দেওয়া, হ্রাস করে দেওযা নয়। কিন্তু পেশাদারদের আমল না দিয়ে শুধুমাত্র পারিবারিক উত্তরসূরীদের সুযোগ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সুযোগ খর্ব করছে এবং সংসদ ভবনের কর্মদক্ষতাও কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।"
পিতা-পুত্র, দুই বুশই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন [ছবি: রয়টার্স]
পথিকৃৎ
ভারতের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের পথিকৃৎ কংগ্রেস।
এর শুরু জওহরলাল নেহরুকে দিয়ে যখন তিনি তাঁর উত্তরসূরীকে নিজের পরিবার থেকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৯ সালে তাঁর ৪২ বছরের কন্যা ইন্দিরাকে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন যে স্বাধীনোত্তর যুগে কংগ্রেসকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে দলটিকে গণতান্ত্রিক ভারতের উপযুক্ত করে তোলা যায়, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সময়কার নয়। কিন্তু এর এক দশকের মধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দল থেকে কংগ্রেস পারিবারিক-অধীনস্থ একটি সংস্থায় পরিণত হল।
ভারতের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন জওহরলাল। তাঁর কন্যা ইন্দিরা সেই ধারাটিকে মজবুত করেছিলেন।
ইন্দিরাকে কংগ্রেস সভাপতি করে জওহরলাল নেহরু ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রথা চালু করলেন [ছবি: এপি]
আমরা যতই বলি না কেন যে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর অভিষেক হল এই তথ্যটি কিন্তু সঠিক নয়, মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৯১ সাল থেকে প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে সক্রিয়। ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনে প্রিয়াঙ্কাকে পিতা রাজীব গান্ধীর হয়ে অবিরাম প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল।
১৯৮৯ সালের নির্বাচনে হেরে রাজীব তখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ১৯৮৪ সালে চারশোর উপর আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। সেখানে ১৯৮৯ সালে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দুশোর নীচে নেমে এসেছিল। এই হারের আসল প্রভাব অবশ্য আরও ২৫ বছর পরেও দেখা গেল যখন ২০০৯ সালে ২০৬টি আসন পাওয়ার পরে ২০১৪ সালে কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪।
১৯৯১ সালের ২২ মের কাকভোরে মা সোনিয়ার সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা চেন্নাই উড়ে গিয়েছিলেন (রাহুল তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন) শ্রীপেরুম্বুদুর থেকে বাবা রাজীবের মৃতদেহ বিশেষ বিমানে দিল্লি ফিরিয়ে আনার জন্য। তামিলনাড়ুর এই মন্দিরনগরীতেই রাজীবকে হত্যা করা হয়েছিল।
সে সময়ে তাঁকে বেশ শক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, দাদা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং শেষকৃত্যের সময়েও তাঁকে বেশ স্থির দেখাচ্ছিল। পরবর্তী ৩০ বছর ধরেই প্রিয়াঙ্কার উপস্থিতি নীরব হলেও বেশ ব্যক্তিত্বময়ী ছিল।
পর্দার আড়ালে এতদিন ধরে রাজনীতি করে গিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা [ছবি: পিটিআই]
২০১৪ সালে কংগ্রেসের ভরাডুবির পরে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে প্রিয়াঙ্কাকে দাদা রাহুলকে সান্ত্বনা দিতে দিতে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। এই ছবি থেকে পরিবারে প্রিয়াঙ্কার ভূমিকাটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তিনি পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করছেন, বোঝা গিয়েছিল সঠিক সময়ে তাঁর মঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে।
তবে সেই সময়তেও কংগ্রেসের অন্দরমহলে তাঁর উপস্থিতি বেশ সক্রিয় ছিল।
প্রিয়াঙ্কাকে সক্রিয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার দাবি দশক পুরোনো। ২০১৭ সালের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনে বিজেপির কাছে গো-হারান হারের পরেও কংগ্রেস সমর্থকরা তাঁকে এবং সোনিয়া ও রাহুলকে সমালোচনার থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন।
১৯৯৭ সালে তিনি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী রবার্ট ওয়াধেরাকে বিয়ে করেন। এই বিয়েতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু এক দশকের মধ্যেই ওয়াধেরা নির্মাণ শিল্পে একজন শিল্পপতি হয়ে উঠেছেন যাঁকে জিমে কসরত করতে দেখা যায় আবার মধ্যরাতে দিল্লির পেজথ্রি পার্টিগুলোতেও উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
এক দশক আগেও বোঝা যায়নি যে প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে উঠবেন রবার্ট।
২০১০ সালের শুরু থেকে ওয়াধেরার বিতর্কিত জমি কেনাবেচার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে শুরু করে। সেই সময়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারই ক্ষমতায় ছিল।
কংগ্রেসের পক্ষে ওয়াধেরা লজ্জার বিষয়ে হয়ে উঠেছিলেন।
আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করেছিল। রাজস্থান ও হরিয়ানায় তদন্ত করে বেশ কয়েকটি বিতর্কিত জমি কেনা বেচার হদিস পাওয়া গেছে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এখন রবার্টকে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। প্রায় ২০ ঘণ্টা ধরে ওয়াধেরাকে জেরা করেছে ইডি।
ওয়াধেরা ও তাঁর এক সময়ের সহযোগী মনোজ আরোরার মধ্যে একটি ইমেল চালাচালি হয়েছিল। সেই ইমেল মারফত লন্ডনে ওয়াধেরার কিছু বেনামি সম্পত্তিরও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। সেই সম্পত্তি নাকি ২০০৫ থেকে ২০১০ শাল অবধি পেট্রোলিয়াম ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর থেকে পাচার হওয়া টাকা দিয়ে ক্রয় করা হয়েছিল।
কংগ্রেস প্রিয়াঙ্কাকে ইন্দিরা প্রতিমূর্তি রূপে তুলে ধরতে চাইছে
শ্রীমতি ওয়াধেরা
একটা বিষয়ে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, প্রিয়াঙ্কার এই সবকিছুর মধ্যে একটি বিচক্ষণ মাথা কাজ করছে।
ইউপিএ ১ ও ইউপিএ ২-এর শাসনকালে একের পর এক দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছিল - কখনও টেলিকম সংক্রান্ত, কখনও কমনওয়েলথ গেমস সংক্রান্ত, কখনও অগস্তা ওয়েস্টল্যান্ড ভিভিআইপি হেলিকপ্টার চুক্তি সংক্রান্ত আবার কখনও ডুবোজাহাজ সংক্রান্ত। ওয়াধেরাকে জেরা করে ইডি আবার তাঁর সঙ্গে ফেরার অস্ত্রব্যবসায়ী সঞ্জয় ভাণ্ডারীর যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে।
২০০৭-১২ সালে ভাণ্ডারী রাফেলের পরিবর্তে ইউরোফাইটার নেওয়ার জন্য তদ্বির করছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে হঠাৎই কম্ব্যাট এয়ারক্রাফট কেনার পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহগুলো প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক জীবনের এক একটি ল্যান্ডমাইন।
প্রিয়াঙ্কাকে এখন রবার্টের বিরুদ্ধে আনা ইডির অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এর পাশাপাশি প্রিয়াঙ্কাকে আরও একটি বিষয়ের সঙ্গে যুঝতে হবে - রাজনৈতিক নেতারা যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন তা নিয়ে এই মুহূর্তে যথেষ্ট সাধারণ মানুষ যথেষ্ট বিক্ষুব্ধ।
মা সোনিয়ার কাছে থেকে পাওয়া রাজনৈতিক বুদ্ধি সম্বল করে প্রিয়াঙ্কা তাঁর স্বামী রবার্টের পাশে দাঁড়িয়েছেন, পিতার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন আর নিজেকে অনেকটা ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীর অনুকরণে গড়ে তুলছেন।
এতে লাভের লাভ কি কিছু হবে?
কয়েকটি স্বচ্ছসেবী সংস্থায় কাজ করা ছাড়া প্রিয়াঙ্কাও রাহুলের মতোই কোনও পাকাপাকি চাকরি করেননি। বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতাদের ছাপিয়ে তিনি এখন রাহুলের পরেই দলের দু'নম্বর।
রাহুলের সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারী লখনউতে রোড শোয়ে প্রিয়াঙ্কাকে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তিনি যে উত্তরপ্রদেশে বিশাল একটা প্রভাব ফেলবেন সেরকম প্রত্যাশা কেউই করছেন না। জানানো হয়েছে, দীর্ঘকালীন পরিবর্তনের কথা ভেবে তাঁকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা সত্যি।
প্রায় ৬০ বছর ধরে আমেঠি ও রায় বরেলি নেহেরু-গান্ধী পরিবারের 'ঘরের' আসন হয়ে রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন যদি শুধুমাত্র উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে হয় তাহলে রাহুল ও সোনিয়া (যদি প্রিয়াঙ্কা রায় বরেলি থেকে প্রার্থী হন তাহলে প্রিয়াঙ্কাও) হেরে যেতে পারেন।
তাঁদের সৌভাগ্য এই দুই কেন্দ্রে আবেগ দিয়ে ভোটদান হয়ে থাকে, উন্নয়ন দিয়ে নয়। অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কার প্রবেশ কংগ্রেসকে আসন্ন নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের থেকে মাত্র দু'টি কেন্দ্র নিশ্চিত করতে পেরেছে।
পরিবারতন্ত্র আপনাকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারে কিন্তু এর চেয়ে বেশি দূরে নিয়ে যেতে পারে না। যে সব রাজনৈতিক দল নেহরু-গান্ধী পরিবারকে পরবর্তীকালে অনুসরণ করেছে তারা অচিরে এই শিক্ষাটা উপলব্ধি করতে পারবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে