লড়াইটা প্রিয়াঙ্কা বনাম মায়াবতী নয়, বরঞ্চ প্রিয়াঙ্কাকে মায়াবতী হয়ে উঠতে হবে
স্রেফ দিল্লিনিবাসী তারকা প্রচারক নয়, প্রিয়াঙ্কাকে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে
- Total Shares
সক্রিয় রাজনীতিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর প্রবেশ একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে ঠিক নির্বাচনের আগের সময়কালটা সকলকে অবাক করে দিয়েছে। তার চেয়ে অবাক করে দেওয়ার মতো তথ্য হল যে একেবারে শুরুতেই তাঁকে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে লড়াই করতে হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে।
তবে বিশিষ্ট সাংবাদিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতীকে টক্কর দেওয়ার জন্যই প্রিয়াঙ্কার আগমন ঘটেছে।
আর এই স্ট্র্যাটেজি মানুষের একটি বদ্ধমূল ধারণার উপর ভরসা করেই ঠিক করা হয়েছে - মহিলারাই মহিলাদের প্রতিপক্ষ হতে পারেন, পুরুষরা নন। এই পরিস্থিতিতে সকলেই একটা কথা ভেবে অবাক হচ্ছেন। যেখানে সমাজবাদী পার্টি বিএসপির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী সেখানে অখিলেশ যাদবকে টক্কর দেওয়ার চিন্তা কংগ্রেস করল না কেন? প্রিয়াঙ্কা আর মায়াবতীর মধ্যে যে কোনও তুলনাই অর্থহীন। কারণ দু'জনের দুটি ভিন্ন প্রজন্মের নেত্রী এবং তাঁদের দু'জনের হাবভাবও সম্পূর্ণ আলাদা।
রাজনীতির ময়দানে মায়াবতী পোড় খাওয়া খেলোয়াড় [ছবি: পিটিআই]
প্রিয়াঙ্কা এখনও বাস্তবের রাজনীতিতে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। সেখানে রাজনীতির ময়দানে মায়াবতী পোড় খাওয়া খেলোয়াড়। তাঁর সমর্থকের সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। মানুষের সঙ্গে মায়াবতীর নাড়ির সম্পর্ক। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে উচ্চবর্ণের 'গুন্ডাদের' অত্যাচার ও আক্রমণ সহ্য করে মায়াবতী সাইকেলে চেপে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন।
কোনও কারণ ছাড়া মানুষের সঙ্গে এত নিবিড় সম্পর্ক গড়া সম্ভব নয়। তাঁর রাজনীতি কিংবা স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকতেই পারে, কিন্তু আধুনিক ভারতে তিনিই যে অন্যতম শক্তিশালী নারী তা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তাঁকে শুধু বাইরে নয়, লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাসী বিএসপির অন্দরেও বছরের পর বছর লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। তবে নিজের নিয়মেই 'রাজ' করেছেন তিনি।
এবার প্রিয়াঙ্কাকে ময়দানে নামতে হবে, শুধুমাত্র প্রচারের জন্য নয়, সত্যি সত্যিই তৃণমূল স্তরে কাজ করতে হবে তাঁকে।
তাঁকে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।
যে ভাবে আজকালকার দিনে দলিত ভোট, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর ভোট, মুসলমান কিংবা ব্রাহ্মণ ভোট নিয়ে অঙ্ক কষা হয় তাতে একটা কথা বলা যেতেই পারে - ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে এ যুগের তৃণমূল স্তরের রাজনীতি অনেকটাই জটিল।
তৃণমূল স্তরে কাজ করে হবে প্রিয়াঙ্কাকে [ছবি: পিটিআই]
দলিত কিংবা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর ভোটব্যাঙ্ক ও একত্র নয়। শেষ দু'দশকের মধ্যে এদের মধ্যেও বিভাগ হয়েছে এবং প্রতিটি বিভাগই ক্ষমতার কাছে থাকতে পছন্দ করে। এছাড়া পশমন্দ রাজনীতির উত্থান মুসলমান জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে কারণ এই ব্যবস্থায় মুসলমান ভোটব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের হাতে থাকে।
খুব সম্ভবত উত্তরপ্রদেশেই ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে সমাজের প্রতি শ্রেণীর উপরই রাজনীতির এবং রাজনৈতিক ইচ্ছা পূরণের প্রভাব পড়ে। তাই বলা যেতেই পারে যে প্রিয়াঙ্কার সামনে রাস্তাটা খুব একটা মসৃণ নয়। তিনি তাঁর পরিবারের পুরোনো দুর্গ ফের জয় করতে মরিয়া। কিন্তু তিনি যদি দলিত, ব্রাহ্মণ ও মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক এক করে চার দশক আগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিতে থাকেন তা হলে কিন্তু তাঁর হার অবশ্যম্ভাবী।
কংগ্রেস হিন্দু-বিরোধী। এমন একটা ধারণা রয়েছে মানুষের। মানুষের মন থেকে এই ধারণা দূর করতে হবে প্রিয়াঙ্কাকে। ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ব থাকবেই। আর এই হিন্দুত্বের লড়াইতে প্রিয়াঙ্কা কী ভূমিকা নেন সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কি ইন্দিরার মতো হিন্দু নেত্রী হয়ে উঠবেন? নাকি ইউপিএ জমানার কংগ্রেসের মতো উদারপন্থী ফাঁদে পা দেবেন? নাকি, রাহুল গান্ধীর নিজেকে পৈতেধারী ব্রাহ্মণ বলে যে ভুলটি করেছিলেন সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করবেন?
কংগ্রেসে দলেও ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বহুদিনের। কিন্তু সেই পন্থা আজকালকার দিনে কাজ করে না।
পুরোনো দিনের মতো আজ কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চবর্ণ ভোটের উপর নির্ভর করে নির্বাচন জেতা যায় না। গোরক্ষপুর উপনির্বাচনে বিজেপি যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
সেই জেলাতে একজন ব্রাহ্মণ মুখ তুলে ধরতে চেয়েছিল বিজেপি যেখানে উচ্চবর্ণের ভোটারের সংখ্যা ২০ শতাংশেরও কম এবং নিশাদ ও দলিত ভোটারের সংখ্যা একত্রে ৪০ শতাংশ। মানুষ সেই হিন্দুমুখকে গ্রহণ করেনি। গোরক্ষপুর থেকে যোগী আদিত্যনাথ জিতেছিলেন কারণ লোকে তাঁকে একজন 'হিন্দু নেতা' হিসেবে দেখে। আর, এখানেই উত্তরপ্রদেশে সবচাইতে 'বড়' ভুলটা হয়ে চলেছে। প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন স্তরে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ ও ঠাকুরদেরকেই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
উচ্চবর্ণের লোকেদের মধ্যে একটা 'বাড়তি সুবিধা আদায়ের' মনোভাব জন্মেছে। এর ফলে অন্য শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
এমন এমন স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে আইনি পথে, যাতে সংরক্ষণের আইন খুব বেশি কার্যকর না করা যায়। ক্যাবিনেটও উচ্চবর্ণের বিধায়করা ভর্তি। দলিত বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়ছে না।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেই মায়াবতী হয়ে উঠতে হবে [সৌজন্যে: ডেইলি ও]
২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে বা ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি যে পরিমাণ হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে পেরেছিল তা এখন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া, অন্যান্য শ্রেণীগুলোর মধ্যে যারা যাদব নয় তারা এবং যারা জাতভ নয় তারাও এখন এসপি-বিএসপি জোটের উপর ভরসা হারিয়েছে এবং এই শ্রেণীর ভোটাররাও বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে।
তারা বিজেপির উপর ক্ষুব্ধ আর এসপি-বিএসপি জোট নিয়ে যারপরনাই আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। তার মানে এই শ্রেণীর লোকেরা এখন বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছে। শ্রেণী বিভাজনে বিশ্বাসী নন এমন একজন হিন্দু নেতাই শুধু এদের আস্থা অর্জন করতে পারবেন। কংগ্রেস কিন্তু এতদিন ধরে এই কাজে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মায়াবতী একটা সময় যা করেছেন প্রিয়াঙ্কাকে এখন সেই কাজটি করতে হবে - মানুষের মধ্যে বাস করতে হবে।
শুধুমাত্র দিল্লি নিবাসী একজন তারকা প্রচারক হিসেবে উপস্থিত হলে চলবে না।
লড়াইটা কিন্তু প্রিয়াঙ্কা বনাম মায়াবতী নয়। প্রিয়াঙ্কা কতটা মায়াবতী হয়ে উঠতে পারে লড়াইটা সেখানে। আজকের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চাহিদা এটাই।
প্রিয়াঙ্কা যদি এই কাজটি করতে পারেন তাহলে তামাম উত্তরপ্রদেশ তাঁর দখলে চলে যাবে। আর তাঁর দিল্লি দখলের পথটাও মসৃণ হবে।
লেখাটি পড়ুন ইংরেজিতে