ব্রিগেডের এই সভায় ইতিবাচক বার্তা যেমন আছে, তেমন রয়েছে নেতিবাচক বার্তাও
দেবগৌড়ার বক্তব্য রাজনৈতিক হলে এই সভার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
- Total Shares
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ইতিহাসে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভা একটা ইতিহাস। দু’-একটা ক্ষেত্রে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে এই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।
স্বভাবতই যে কোনও ব্রিগেড জনসভার দিকে নজর থাকে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের। অনেক দিন বাদে আবার একটা ব্রিগেড জনসভা অন্তত জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের নজরে থাকল। কিন্তু ব্রিগেড জনসভা কেন ডাকা হয়?
এক, এই জনসভার প্রস্তুতিকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন ধরে কর্মীদের চাঙ্গা রাখা যায়। দুই, একবারে কর্মীদের ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে নিজের দলের বক্তব্য তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া যায়, বিশেষ একটা রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে। অথবা বিশেষ কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তিন, দলের শক্তিপ্রদর্শন।
শনিবারের ব্রিগেড জনসমাবেশের আরও একটা, চতুর্থ কারণ ছিল। সেটা হল, তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রীর ইমেজ বিল্ডিং।
এই কয়েকটি কারণের কোন কোন জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেস সফল বা অসফল সেটা বুঝে নেওয়া জরুরি।
ব্রিগেডের জনসভায় দেশের প্রথমসারির বহু নেতৃত্বকে হাজির করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (সুবীর হালদার)
তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে এটা যথেষ্ট চিন্তার কারণ যে ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেড জনসভা কোনও রেকর্ড স্থাপন করতে পারল না। চেষ্টার কোনও অভাব ছিল না। জনসংযোগ চূড়ান্ত ভাবে করবার জন্য নেতারা সারা রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন, তা সত্ত্বেও ব্রিগেডের ময়দান ক্যামেরার চোখে কেন খালি দেখাল, তার পোস্ট মর্টেম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই করবেন।
এই রকম একটি ঐতিহাসিক জনসভায় চূড়ান্ত শক্তি প্রদর্শনে তৃণমূল কংগ্রেসের পিছিয়ে থাকাটা কোনও নেতিবাচক ইঙ্গিত কিনা নাকি কোনও ব্যবস্থাপনাজনিত ত্রুটি, এটা বলবার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু ক্যামেরার যে ছবি দেখে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে উৎসব তৈরি হওয়ার কথা ছিল, বা তৃণমূল কংগ্রেস সম্বন্ধে আকর্ষণ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেটা কোথাও যেন ধাক্কা খেল।
এবারে প্রশ্ন হচ্ছে কর্মীদের কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া। মোটামুটি ২৩টি দলের প্রতিনিধিরা এই সমাবেশের মঞ্চ আলোকিত করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে কংগ্রেসের প্রতিনিধি সভাকে সম্বোধিত করেছেন এবং রাহুল গান্ধী ও সনিয়া গান্ধী সভাকে বার্তা পাঠিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হল, যে দলগুলি এ দিনের মঞ্চ আলোকিত করেছে এই মুহূর্তে লোকসভায় তাদের সম্মিলিত আসনসংখ্যা ১১৯। কর্মীরা বিভ্রান্ত যে এই সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মঞ্চাসীন তারকাদের মধ্যে একজন-দু’জন ছাড়া বাকি সবাই কোনও না কোনও সময় বিজেপির হাত ধরে পথ চলেছে। ব্যতিক্রম – অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদব, এমকে স্ট্যালিন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং এইচডি দেবগৌড়া ও তাঁর পুত্র এইচডি কুমারস্বামী। কংগ্রেসের কথা আলাদা করে উল্লেখ করার কোনও প্রয়োজন নেই।
মমতার ঐক্যের মঞ্চে রাজনৈতিক ভাবে বেসুরো গেয়েছেন দেবগৌড়া। (সুবীর হালদার)
আরও একটা বিষয় নজরে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে, মঞ্চের বক্তারা (কংগ্রেস ছাড়া) মূল আপত্তির যে জায়গাটা শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরলেন তা হল মোদী এবং অমিত শাহ। সমালোচনাটা যত না বিজেপির অপশাসন নিয়ে, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদী এবং ব্যক্তি অমিত শাহ নিয়ে। এবং এই একটা চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকে একটু বেশি করে খোঁচা দিয়ে আরও জটিলতা সৃষ্টি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং।
অত্যন্ত সচেতন ভাবে তিনি রাজনাথ সিং এবং নীতীন গড়কড়ির নাম উচ্চারণ করলেন। এতে আলোচনার অবকাশ থেকেই গেল।
আরও একটা বিষয় আলাদা করে উল্লেখ করা প্রয়োজন – তা হল তিন বৃদ্ধের উপস্থিতি: অরুণ শৌরী, যশবন্ত সিনহা ও শত্রুঘ্ন সিনহা। রাজনীতির যে কোনও প্রাথমিক পাঠকও চোখ বন্ধ করে সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে এই ত্রয়ী নিছক অতৃপ্ত আত্মা।
এই সমাবেশে কেউ হয়তো খুব একটা গুরুত্ব দেননি কোনও এক ব্যক্তির বাচনভঙ্গির কারণে, তবে সেই ব্যক্তি ছিলেন সবচেয়ে বর্ষীয়ান এবং সেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা একেবারে সর্বোচ্চ। তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া। যদি একটু ধৈর্য ধরে এই ব্যক্তির স্বল্পদৈর্ঘের বক্তৃতা একটু মন দিয়ে শোনা যায়, তা হলে উপলব্ধি করা যায়, একমাত্র রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন তিনিই।
কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সম্ভাব্য জোট সরকারের অস্তিত্ব কত দিনের হতে পারে। এমন একটা তারকা সমাবেশে এই প্রসঙ্গের তিনি উত্থাপন করেছেন কেন?
কারণ তিনি স্বয়ং দেশের সর্বোচ্চ পদে থেকে কংগ্রেসের বিশ্বাস ঘাতকতার শিকার। বলা যেতে পারে এই প্রবীণ রাজনীতিকের এই পর্যবেক্ষণ সুর এবং তাল কেটেছে। অথবা বলা যেতে পারে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে আশ্রয় করে একটা কঠিন সত্যকে তিনি ছোট করে উল্লেখ করে গেছেন।
মঞ্চের নেতৃত্বরা অকপট ভাবে একটা বিষয় স্বীকার করে গেছেন যে এই তারকা সমাবেশে মনের মিল না থাকলেও একে অপরের হাত ধরাটা খুব জরুরি। সেটাও যে কোনও প্রচার সভার ক্ষেত্রে খুব একটা উতিবাচক সঙ্কেত নয়।
তেজস্বী যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, ফারুক আবদুল্লা, মল্লিকার্জুন খাড়গে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল -- মনের মিল নিয়ে প্রশ্ন এখন থেকেই। (সুবীর হালদার)
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং যে নীতিকথা বারবার শোনাচ্ছেন, সেটা তিনি আবার শুনিয়েছেন – যে যেখানে শক্তিশালী তাকে সেখানে ময়দান ছেড়ে দেওয়া উচিত। যেটা ফারুক আবদুল্লা মনে করিয়ে দিয়েছেন, লড়াই হওয়া উচিত একের বিরুদ্ধে একের। মমতা এই তত্ত্ব সারা দেশে বলে বেড়ানোর চেষ্টা করছেন নিশ্চিত ভাবে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে কংগ্রেস কী করবে। তা হলে কি কংগ্রেস কি উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী দেবে না?
আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই তত্ত্বটিকেই যদি সঠিক এবং চূড়ান্ত ভাবে ধরে নেওয়া যায় তা হলে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে। এদিনের সভা বামপন্থীরা না থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী এবং কংগ্রেসের জন্য মমতা দরজা কি খোলা থাকবে? অথবা বামপন্থী এবং কংগ্রেসকে কে তিনি বোঝাতে সক্ষম হবেন যে এ রাজ্যে তিনিই সর্বশক্তিমান?
নীতীন গড়করী ও রাজনাথের নাম করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। (সুবীর হালদার)
এবার আসা যাক মমতার ইমেজ বিল্ডিংয়ের প্রশ্নে। বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে ব্রিগেডের সভার পরে অন্তত নিজের কর্মী-সমর্কদের কাছে একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রীর ডাকে এমন তারকা সমাবেশ কর্মীদের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিদির বদলে ম্যাডাম-এর পর্যায়ে উন্নীত করবে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই এবং তাঁদের দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইন্ধন জোগাবে।
আগামী দিনে অমরাবতী বা দিল্লিতে এমন সভা হবে কিনা তা ভবিষ্যৎ বলবে, কিন্তুর শুরুর শুরুটা করে দেখাতে পারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেঙ্গালুরুতে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের মঞ্চের কথা মাথায় রেখেও এটা বলতে কোনও দ্বিধা নেই, যে ভোটের প্রাক্কালে বিরোধী রাজনীতির একটা দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।