দলীয় ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস তৃণমূল আমলে ব্যক্তির ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে
'নবজাগরণে'র বাংলা আজ সন্ত্রাসের রকমফের পর্যালোচনা করতে ব্যস্ত
- Total Shares
২০১০ সালে কলকাতার একটি স্বল্পস্থায়ী দৈনিক 'ডেথ মিটার' বলে একটি গ্রাফিক্স শুরু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যে রাজনৈতিক সন্ত্রাসে মৃত্যুর প্রতিদিনের খতিয়ান মানুষের সামনে তুলে ধরা। সংখ্যাটা প্রতিদিন বেড়েই যেত। দৈনিকের কর্তৃপক্ষ তাই এই ধরনের একটি ভাবনার সাফল্যে যারপরনাই উৎফুল হয়েছিল - মানুষ মরছে, সংখ্যা বাড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সেই 'ডেথ মিটার' যেন এক প্রতিবিম্ব। রাজ্যের রাজনীতির প্রকৃত চরিত্রের একটি আয়না। এ রাজ্যের রাজনীতি যে সন্ত্রাসবিদ্ধ!
কিন্তু, কেন এই সন্ত্রাস? যে বাঙালি সারা দেশে প্রতিবাদী আর যুক্তিবাদীবাদী হিসেবে সম্মানিত হয়েছে, তারা আজ রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘৃণিত। বিহার বা উত্তরপ্রদেশে বাহুবলী রাজনীতি দেখা গেছে, কিন্তু সেটা ছিল ব্যক্তি-কেন্দ্রিক। আজ সেই ব্যক্তিরা হয় প্রয়াত না হয় কারাগারের অন্তরালে। সে রাজ্যে বাহুবলী রাজনীতি বেশ স্তিমিত।
এই পরিস্থিতিতে এখন খবরের শিরোনামে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের ঐতিহাসিক গতিধারা এবং চরিত্রগত চেহারা বদল বোধহয় বেশ কয়েকটা দশক ধরে আকাবাঁকা পথ ধরে আজকের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এটা বোধহয় তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ নয়। এখন এটা রাজনীতিক্লিষ্ট বাঙালির চরিত্রগত অপগুণ।
বাঙালি কোনও কালেই যোদ্ধা-জাতি নয়। কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে বৌদ্ধিক ক্ষমতায় বলীয়ান বাঙালি চরমপন্থার সম্মানে সম্মানিত। সৈনিকের পোশাকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিত। আজকে যাঁরা ক্ষমতার উন্মত্ত নেশায় প্রকাশ্য দিবালোকে নারী জাতির শ্লীলতাহানি করছেন, ভোট রাজনীতির অজুহাতে তাঁরা কি তাহলে ক্ষুদিরাম বা বিনয়-বাদল-দীনেশ বা নেতাজির উত্তরসূরি?
এই নিম্নমুখী চরিত্রগত পরিবর্তনটা বুঝতে গেলে বোধহয় একটু ষাটের দশকের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। পরাধীন ভারতবর্ষে আদর্শগত চরমপন্থার বিস্তার কিছুটা পঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রেও অনুভব হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটা আধুনিক রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মতো হানাহানিতে পর্যবসিত হয়নি। সমসাময়িক কালে এমন কিছুটা চরিত্রগত সামঞ্জস্য পাওয়া যায় কেরলের রাজনীতিতে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কেরলেও 'ডেথ মিটারের' প্রাসঙ্গিকতা মনে করিয়ে দেয়। এই দুই জায়গায় সাযুজ্য একটাই - বামপন্থার উপস্থিতি।
ট্রাম পোড়াচ্ছে বামপন্থীরা (ফাইল চিত্র)
বামপন্থী রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের লক্ষে শ্রেণী সংগ্রামের নামে সন্ত্রাস একটা আদর্শগত অনুমোদন। ষাটের দশক পর্যন্ত স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি ছিল নিস্তরঙ্গ। তারপর থেকেই হিংসাত্মক উপস্থিতি জাহির রাজনীতির চরিত্রে বদল আনতে শুরু করে। রাজনীতির অপরাধীদের নিয়ে সারাদেশে নানা রকম বিতর্ক আছে। কিন্তু দলীয় অনুমোদনে বা আদর্শগত অনুমোদনে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বামপন্থীদের অবদান। মূলস্রোতের বামপন্থা এবং গেরিলা বামপন্থা।
মার, ভাংচুর কর, আগুন লাগাও এবং প্রয়োজনে খুন কর - ক্ষমতা দখল করতেই হবে। পরাধীন ভারতেও লড়াইয়ের অন্তর্নিহিত সত্য ছিল ক্ষমতার পরিবর্তন। দেশবাসীর মঙ্গলের জন্য সেই পরিবর্তনের আন্দোলন আর দলীয় পতাকা কাঁধে নিয়ে ট্রাম পোড়ানোর সন্ত্রাসকে বোধহয় একাসনে বসানো যায় না।
তাহলে সত্তরের কংগ্রেস কি এই অপবাদের বাইরে থাকবে? একেবারেই নয়। একদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার নেশা এবং অন্যদিকে বামপন্থী সন্ত্রাসের মোকাবিলার নাম করে স্রোতে গা ভাসিয়েছিল সত্তরের কংগ্রেস। এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক সন্ত্রাস পশ্চিমবঙ্গে দলীয় অনুমোদন পেতে শুরু করে।
আজ রাজনৈতিক হিংসা বা প্রাণহানিতে দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে শীর্ষস্থানে পশ্চিমবঙ্গ। আদর্শগত অনুমোদন নিয়ে কেরল বা পশ্চিমবঙ্গে যে বিষাক্ত সন্ত্রাসের রাজনীতি বামপন্থীরা আমদানি করেছে তার একটা চূড়ান্ত অবয়ব পরিবর্তন ঘটেছে ২০১৮ সালে।
আজ রাজনৈতিক হিংসা বা প্রাণহানিতে দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে শীর্ষস্থানে পশ্চিমবঙ্গ।
১৯৭৭ সালে ক্ষমতা দখলের পরে বামপন্থীরা সন্ত্রাসের রাজনীতিকে সরকারিসিদ্ধ, পুলিশসিদ্ধ এবং প্রশাসনসিদ্ধ করেছে। পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেস সুযোগ্য ছাত্র হিসেবে এই ক্ষমতা রপ্ত করেছে মাত্র। তবে তফাৎ একটা আছে। ক্ষমতা থাকার ৩৪ বছরে বামপন্থীদের সন্ত্রাস একটা পরিকাঠামোগত অনুমোদনের মধ্যে দিয়ে সংঘটিত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে সেটা ছন্নছাড়া। কোনও দলীয় পরিকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ নেই। যার ফলে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্তর্দলীয় সন্ত্রাস। যেটা ছিল দলীয় ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস সেটা তৃণমূল আমলে আরও সংকীর্ণ হয়ে জায়গায় জায়গায় ব্যক্তির ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পোড়া কপাল পশ্চিমবঙ্গে, নবজাগরণের বাংলায় বিচারপতিরা আজ আদালতের চার দেওয়ালের মধ্যে সন্ত্রাসের রকমফের পর্যালোচনা করতে ব্যস্ত। ক্ষমতা দখলের নেশায় শাসকের সন্ত্রাসের মোকাবিলায় বিরোধী সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে। স্রোতের বিপরীতে চলার সাহস দেখাতে পারছেন না কেউ। সন্ত্রাস এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চরিত্রগত অবস্থান।