সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন?
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স ২০১৭ অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল ১৩৬ নম্বরে
- Total Shares
“There were three Estates … but in the Reporters Gallery yonder, there sat a fourth Estate more important far than they all.”
এডমন্ড বার্কের সেই বিখ্যাত উক্তি, “(গণতন্ত্রের) তিনটি স্তম্ভ তো আছেই, কিন্তু সাংবাদিকদের আসনের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওটাই চতুর্থ স্তম্ভ, বাকি তিনটির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।”*
এ দেশ বা এ রাজ্য কি সে কথা বোঝে? নাকি সংবিধানে দেওয়া ভাবপ্রকাশের অধিকার সত্যিই সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা করছে রাষ্ট্রযন্ত্র? তা হলে ক’দিন আগে কলকাতা শহরের বুকে নগ্ন করে পেটানো হত না সাংবাদিককে। সবচেয়ে দুঃখের, যখন এ জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে রাজ্যের শাসকদলের দিকে।
আমাদের দেশে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারেন? ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স ২০১৭ অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল ১৩৬ নম্বরে। ২০১৬ সালে ছিল ১৩৩ এবং তার আগের বছর ছিল আবার সেই ১৩৬ নম্বরেই। মানে সামান্যতম হেরফেরটুকু বাদ দিলে ভারতে সাহসী সাংবাদিকতার পরিসর প্রায় নেই বললেই চলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি নিরাপত্তা না দেয়, তা হলে সাংবাদিকরা কী ভাবে নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করবেন? সাংবাদিকরা যদি নিরপক্ষ ভাবে কাজই না করতে পারেন তা হলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ধাঁচে প্রাভদা (যার বাংলা তর্জমা করলে হয় সত্য)এবং বর্তমান চিনের জিনহুয়া সংবাদসংস্থার মতো একটি সংস্থা খুললেই হয়। চিনে যে ৪২টি দৈনিক সংবাদপত্র রয়েছে, প্রতিটিই শাসকদলের এবং সবকটি সংবাদপত্রের খবর ও ছবির মূল উৎস হল জিনহুয়া।
ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স ২০১৭ অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল ১৩৬ নম্বরে, ২০১৬ সালে ছিল ১৩৩
ধর্মতলায় গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতিবাদ
স্বাধীনতার আগে ভারতে সংবাদপত্রের ধারণাটা মোটামুটি একই রকম ছিল প্রকাশক ও সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। স্বাধীনতার আগে সকলের স্বার্থ বা লক্ষ্যও ছিল অভিন্ন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে অভিমুখও বদলাতে থাকে। চলে আসে বিজ্ঞাপনের স্বার্থ। তারপরে অঞ্চলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের মতো না হলেও পরোক্ষে নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে সংবাদপত্রগুলি।
সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম কোনও জনমত তৈরি করতে পারে কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু সাধারণ ভাবে দৈনন্দিন ঘটনাবলি থেকে সরকারি তথ্য, সবই পাওয়া যায় সংবাদপত্রের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যম। এই মাধ্যমে সর্বশেষ সংযোজন হল ওয়েব-মিডিয়া। তাই দেখা গিয়েছে, কোনও দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হলে প্রথমেই সংবাদমাধ্যমের কার্যালয় তারা দখল করে নেয়। এখন গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারও হয়তো অন্য ভাবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মনে রাখা দরকার, অনেক সংবাদপত্রেরই আয়ের বড় অংশ আসে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে।
সামরিক অভ্যুত্থান না হলেও এ দেশে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সেই সংবাদ ‘চেপে দেওয়া’র জন্য সেই রাতে রাজধানী দিল্লির বহু সংবাদপত্রের অফিসে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল বলে তৎকালীন সময়ের সাংবাদিকদের কাছে শুনেছি। সেই সময় (এখনও) আকাশবাণী ও দূরদর্শন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং অন্য কোনও বৈদ্যুতিন মাধ্যম ছিল না।
দেশে জরুরি অবস্থা চলার সময় অনেক সাংবাদিককে কারাবাস করতে হয়েছে। নিয়মিত ‘সেন্সর’ করা হয়েছে সংবাদ ও ব্যঙ্গচিত্র। সেই সময় কে শঙ্কর পিল্লাইয়ের জনপ্রিয় কার্টুন পত্রিকা শঙ্করস উইকলিও বন্ধ হয়ে যায়।
এখন সংবাদ সংগ্রহের ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। ড্যানিয়েল পার্ল, জে দে থেকে গৌরী লঙ্কেশ— নির্ভীক সাংবাদিকতাই তাঁদের অকালমৃত্যুর কারণ, এ কথা নিশ্চয়ই সকলে মানবেন। এ রাজ্যে পুরভোটেও সাংবাদিকদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে, অতি সাম্প্রতিক কালে নগ্ন করে প্রহার করা হল। সর্বশেষ ঘটনার কথা পুলিশে অভিযোগ আকারে জানানো হয়নি অন্তত প্রথম ২৪ ঘণ্টায়, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন সে কথাই বলছে। আর পুরভোটের সময় অভিযোগ দায়ের করার চেয়ে সাংবাদিকরা গুরুত্ব দিয়েছিলেন খবর সম্প্রচার নিয়ে, যেমন ভূমিকম্পের সময় সকলে যখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত থাকেন, সাংবাদিকরা চালান ব্রেকিং নিউজ।
* এই প্রসঙ্গের উল্লেখ এডমন্ড বার্কের রচনায় নেই, বার্ককে উদ্ধৃত করে এ কথা বলেছেন টমাস কার্লাইল