পঞ্চায়েত নির্বাচন: সবে তো বোধন শেষ হল, সন্ধি পুজো এখনও বাকি
বোধন পর্বে 'উন্নয়ন' লাঠি-বোমা-বন্দুক নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, মূল পর্বে হবে রেকর্ড ভাঙার খেলা
- Total Shares
গণতন্ত্রের মহোৎসব চলছে। চলবে আরও কিছুদিন। আপাতত মনোনয়ন পর্ব শেষ হল। মানে ওই বোধন হল আর কী। সন্ধিপূজা এখনও বাকি। বোধন থেকেই 'উন্নয়ন' পথে-ঘাটে। হাতে হাতে লাঠি-গুলি-বোমা-বন্দুক। সে তো স্বাভাবিক। উন্নয়ন কী? কাকে বলে উন্নয়ন? তা আমজনতা কোনওদিনই বুঝল না। এটাই আক্ষেপ। খবরের কাগজে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন। টেলিভিশনে প্রচার। জেলায় জেলায় একবেলা খাসদরবার আর একবেলা আমদরবার বসিয়ে দু'হাতে 'উন্নয়ন' তো কম বিলানো হল না। রিমোটের বোতামে হাত রাখতেই কত যে 'উন্নয়ন' পাকা ফলের মতো ঝরে পড়ল। যেন কল্পতরু উৎসব। কল্পতরু উৎসবের দিনটি আর এই দলটির জন্মদিনে কী আশ্চর্য মিল! পয়লা জানুয়ারি।
বিরোধী দল বুঝতে চায় না। তারা ভোট চায়। তো আবদার করলেই তো হল না। এ তো 'উন্নয়ন বিরোধিতা'। সুতরাং, 'বিরোধী শূন্য' পঞ্চায়েতের ডাক দিতেই হয়। বুঝিয়ে দিতে হয় 'রাফ অ্যান্ড টাফ' কাকে বলে। তো বুঝিয়ে দিতে যখন হবে তখন মনোনয়ন পর্বেই বুঝিয়ে দেওয়া ভালো। কথায় আছে না, প্রথম রাতে বেড়াল মারা। দু'চারটে লাশ পড়বে। পড়তেই পারে। 'উন্নয়ন'-এর বিরোধিতা করলে এটুকু দাম তো দিতেই হবে। এ নিয়ে বিচলিত হতে নেই। বরঞ্চ, লাশ পড়লেই সকলেই বুঝবে 'উন্নয়ন'-এর মাহাত্ম্য। লাঠির বাড়িতে হাত-পা-মাথা ভাঙলে তবেই না মালুম হবে 'উন্নয়ন' কাকে বলে। ঠিক যে ভাবে কল থেকে ঝরঝর করে জল পড়লে, মানুষ খেয়ে, গায়ে-মাথায় ঢেলে বোঝে। খানাখন্দ ভরা না-রাস্তা একদিন যদি পঙ্খীরাজের মতো উড়তে থাকে তখন বোঝে, হুঁ হুঁ বাবা উন্নয়ন। দু'টাকার চাল পেলে বোঝ। তবুও পাবলিকের চাহিদার শেষ নেই। বলে কি না, জল খেয়ে কি পেট মাটিতে দিয়ে ঘুমাব! রাস্তা হয়েছে সাইকেলও। তা শিক্ষা-টিক্ষার শেষে আয়ের রাস্তা জুটবে তো? দু'টাকার চাল তো পেলাম। কিন্তু? চাল ফোটানোর জ্বালানি চাই। চাল তোলার পয়সা চাই। ডাল-সবজি চাই। কিনতে রোজগার চাই। কল বসিয়ে, রাস্তা বানিয়ে তো পঞ্চুবাবু আর দলের দাদাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হল। তা এতো অধৈর্য হলে সহবত শেখাতেই হয়। আর শিক্ষা দিতে হলে স্রেফ রাস্তার দখল নিলে চলবে না। ব্লক অফিস থেকে জেলাশাসকের দফতর দখল কর। কী যেন বলে--- ঘাঁটি এলাকা। হ্যাঁ, প্রশাসনিক দফতরে দফতরে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলো। তা ডাক্তারের মুখে পুরিষ মাখিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কাকে বলে। বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যার আলয় নয়। মুক্তচিন্তার পীঠস্থান নয়। প্রেসিডেন্সি জেলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পার্থক্য রাখা হয়নি। সর্বত্রই তো তাই। যেখানে পারিনি তা 'আমার' নয় 'মাওবাদী'দের। তবুও, বিরোধিতার সাধ। ভোটে লড়ার সাধ।
বোধন পর্ব জুড়েই তাই 'উন্নয়ন'কে দেখা গেল লাঠি-বোমা-বন্দুক নিয়ে চরম উৎসাহে রাস্তায় নেমে পড়েছে
বোধন পর্ব জুড়েই তাই 'উন্নয়ন'কে দেখা গেল লাঠি-বোমা-বন্দুক নিয়ে চরম উৎসাহে রাস্তায় নেমে পড়েছে। বাঙালির বীরত্ব নিয়ে যেখানে যেটুকু সন্দেহ রয়েছে, এই পর্বেই তা মুছে ফেলতে হবে যে। মূল পর্বে রেকর্ড ভাঙার খেলা। ওই তো তলোয়ার আর বাইক নিয়ে রামনবমীর বীরত্ব। মরল হাড়-হাভাতে গোটা ছয়েক। একটা মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদের গায়ে আঁচ লাগাতে পেরেছে? 'উন্নয়ন' পেরেছে। সাংসদ পিটিয়েছে, বিধায়ককে দৌড় করিয়েছে। পা-মাথা ভেঙে একেবারে গ্যারেজ করে ছেড়েছে। এ হল 'উন্নয়নি দাঙ্গা'। তরাই থেকে সাগর, সাগর থেকে জঙ্গলমহল।
এমন তো আর নতুন নয়। যে আজ কাঁদুনি গাইতে বসতে হবে। এই যে মেরে বিধায়িকার পা ভাঙা হল, মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে লাঞ্ছিত হলেন একের পর এক মহিলা। চুলের মুঠি ধরে মারা হল, শাড়ি খুলে নেওয়ার চেষ্টা চলল। হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হল। একি নতুন নাকি? ভুলে গিয়েছেন, শূর্পণখার নাক কাটার গল্প। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। মহিলা সাংবাদিককে অপহরণ করে গোপন ডেরায় আটকে রাখা হয়েছে বলে কত কথা। কেন সীতা অপহৃত হননি? রাবণ তাকে বন্দি করে রাখেননি? আর শিক্ষায় গণতন্ত্র? ভুলে গেলেন, দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় একলব্যের আঙুল কেটে নেওয়ার গল্প। তবে? যুগ যুগ ধরে, কালে কালে এমন-ই তো ঘটে চলছে। শুধু, ৩৪ বছর তো নয়।
শুধু শুয়োরের খোঁয়াড় বলে গাল দিলেই হয় না। দেখুন কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় সংসদীয় গণতন্ত্রকে। বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা হতচ্ছেদ্দা করেই এসেছেন। দেখুন বুর্জোয়াতন্ত্রকে কী ভাবে ঘিরে ফেলতে হয় ব্লকস্তর থেকে। ঘাঁটি এলাকা গড়তে জঙ্গল, পাহাড় লাগে না। নবান্নই ঘাঁটি এলাকা। সদর দফতরে কামান দাগার কী প্রয়োজন? যদি, প্রশাসনিক ভবনের দখল নিয়ে নেওয়া যায়। পুলিশের বন্দুক কেড়ে গণমিলিশিয়া! ধ্যুস! পুলিশ সরকারের, বন্দুক সরকারি। আঙুলে ধরা সুতোর টানে পুতুল নাচাও, নাচবে। আইন-শৃঙ্খলা মানতে গেলে ওষুধ তো রয়েইছে। দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর।
আইন-শৃঙ্খলা মানতে গেলে ওষুধ তো রয়েইছে, দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর
আসলে উন্নয়নের কোনও আইন-শৃঙ্খলা হয় না। মদমত্ত ক্ষমতার কোনও গণতন্ত্র হয় না। বাক স্বাধীনতা হয় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হয় না। ও সব সংবিধানে লেখা থাকে। বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিলেই হয়। উন্নয়ন আসলে ক্ষমতা যা চায় তাই। হাজার হাজার গ্রাম ভেসে যাক। বাঁধ বাঁধার উন্নয়ন হবেই। আদিবাসী ও প্রকৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক খনি হবেই। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে শেষ হবে না।এই উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা। ভাঙড় অবরুদ্ধ হবেই। খুন হবে গ্রামবাসী। রুজি-রোজগার বন্ধ করে ভাতে মারা হবে। সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে কালাকানুনি ধারায় জেলে পোরা হবে। 'আমার আমলের রেললাইন' তাই বুজিয়ে ফেলতে হবে ভাবাদিঘি। পরিবেশ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বনের জমি-জলাশয় বেচে তিন তারকা, পাঁচ তারকা রিসর্ট গড়তেই হবে। বেচে দিতে হবে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। যশোর রোডের ঐতিহ্যশালী প্রাচীন বৃক্ষ। ক্ষমতা-উন্নয়ন-সন্ত্রাস আসলে একে অপরের পরিপূরক। সমার্থক শব্দ।
এইবেলা শাসকের অভিধানটি পড়তে শিখুন।