কম জায়গায় বেশি লোকের বাস হলে সেটাই ভালো ভোটব্যাঙ্ক

অনেক সুযোগ-সুবিধাই আমরা পাই না, কিন্তু কেন পাব না সেটাই প্রশ্ন

 |  3-minute read |   10-05-2018
  • Total Shares

তখন আমার বয়স ৫ বছর। বাবা আমার জন্মদিনে একটা মাটির লাল বলের মতো জিনিস দেয় যার মাথায় একটা ফুটো ছিল। এই হল আমার ব্যাঙ্কের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। যত দিন গেছে বাবা ও আত্মীয়দের নানা কারণে দেওয়া টাকা-পয়সা আমি ওটার ভিতরে জমাতাম। মাটির ব্যাঙ্কটা ভরে গেলে সেটাকে ভেঙে যা টাকা হত, সেটা দিয়ে কিছু না কিছু কিনতাম বা খেতাম। প্রতিবার একটা ব্যাঙ্ক ভাঙলে আর একটা বাবা এনে দিত।

vote_body1_051018030649.jpgটিভির মাধ্যমে অন্য একটা ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমার পরিচয় হল, ‘ভোট ব্যাঙ্ক’

এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়, আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। বাবা হাত ধরে একটা বড় অফিসের ভেতর নিয়ে গিয়ে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। তখন বুঝি এটাই হল ব্যাঙ্ক। তারপর যেমন আর ৫টা ছেলেদের বড় হওয়া সেরকম আমারও। কিন্তু মাথাটা ঘুরে গেল ক্লাস টুয়েলভ পাস করার পর। যে বন্ধুদের সাথে এত দিন খেলে বড় হলাম সেই বন্ধুদের কাছে আমার পরিচয়টা আমার নাম দিয়ে নয়, আমার পদবী বা আমার উৎসব দিয়ে বিচার হতে লাগল। তখনই টিভির মাধ্যমে অন্য একটা ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমার পরিচয় হল, ‘ভোট ব্যাঙ্ক’। নামটার বিচার করতে গিয়ে বুঝলাম যে এই ব্যাঙ্কে টাকা জমানো হয় না, সঞ্চিত হয় ভোট। যেহেতু আমি কোনদিন রাজনীতির সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত ছিলাম না তাই আমার সাধারণ বুদ্ধিতে মনে প্রশ্ন উঠল ‘ভোট তো ব্যালট পেপারে ছাপ মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়, তাও ভোটের সময় এবং কাউকে না দেখিয়ে। সেটা আবার জমানো যায় নাকি’?

যাকেই এই প্রশ্নটা করতে যাই সেই আমার দিকে এমন ভাবে তাকায় যেন আমি সব জানি। তাই কেউ এর উত্তর দেয় না। প্রশ্নটা মনের ভেতর রেখে দুটো বছর কাটল, আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ছি, কলকাতা জুড়ে তখন রাজনৈতিক প্রতিবাদ আর লড়াইয়ের বন্যা। সেই পথ ধরেই পালাবদল হল। রাতারাতি শহর সেজে উঠল নতুন ভাবে, রাস্তায় আলোর রোশনাইয়ে ঝাঁ চকচকে কলকাতা। কিন্তু এই উংসব এই আনান্দের মাঝে ভাগ হয়ে গেল মানুষ, সাধারণ মানুষ আর ‘অ’সাধারণ মানুষ।

vote_body2_051018030754.jpg‘ভোট তো ব্যালট পেপারে ছাপ মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়, তাও ভোটের সময় এবং কাউকে না দেখিয়ে

‘অ’সাধারণ মানুষজন আগে সাধারণই ছিল, মানে আপনি বা আমি যে রকম থাকি আরকি। কিন্তু রাতারাতি তাদের কাছে এল টাকা, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যাবসা, বেআইনি নির্মাণ, ঔদ্ধত্য। যেটা খেয়াল করলাম এই ‘অ’সাধারণ মানুষের মধ্যে আমার সেই কজন বন্ধু আছে যারা আমার নাম ছেড়ে পদবির জন্য বন্ধুত্ব ভেঙেছিল। এই ‘অ’সাধারণ মানুষরা অনেক কিছু সুযোগ সুবিধা পেতে শুরু করল যেগুলি আমি বা আপনি কোনদিনও পাইনি। কিন্তু আমি বা আপনি কেন এই সুযোগ সুবিধার থেকে বঞ্চিত থাকব? আমরাও কি এই সুযোগ সুবিধা গুলি পেতে পারি না?

ঠিক যখনই মনের ভেতর এই প্রশ্ন গুলি জাগল আমি আগের প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গেলাম। ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ মানে হল এই সব ‘অ’সাধারণ মানুষের সমর্থন। না, এই ব্যাঙ্কে টাকা রাখা যায় না। কিন্তু এই ব্যাঙ্ক সুদ দেয়। এই সুদ হল এইসব সুযোগ সুবিধা। কিন্তু কী জমা রাখার বিনিময়? নিজের ভোটাধিকার। সে তো আমি আপনিও ভোট দিই, তো আমরাও যদি ভোট দেব বলে কোন দলকে কথা দিই তাহলে আমরাও এই সুযোগ কেন পাব না? কারণ এই ‘অ’সাধারণ মানুষদের কাছে তো অনেক ভোট। বুঝলেন না তো?

vote_body3_051018030921.jpg‘ভোট ব্যাঙ্ক’ মানে হল এই সব ‘অ’সাধারণ মানুষের সমর্থন

আপনার ৭৫০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে কজন ভোটার? ৪-৫ জনের বেশি নয় নিশ্চয়। এবং সবাই শিক্ষিত তাই আপনার কথা শুনে তারা ভোট দেবে না। কিন্তু এই ‘অ’সাধারণ মানুষদের অসাধারণ দক্ষতায় তাদের ৪৫০ স্কোয়ার ফিট বাড়িতে কম করে ৮-৯জন ভোটার বাস করে। এবং এরা কেউ শিক্ষিত নয়, আর কেউ এদের বেশি শিক্ষিত করতেও চায় না। কারণ, “যে যত বেশি জানে, সে তত কম মানে”। এই ‘অ’সাধারণ মানুষদের এলাকাতে এক একজন মেষপালক থাকে। সে যেটা বলে বাকিরা তাই করে। তাই তাদের ব্যাঙ্ক করে রাখা অনেক সহজ। এরাই হল রাজনীতির ‘ভোট ব্যাঙ্ক’। এরা সংখ্যায় কম হলেও সংগঠিত। আর আমরা সাধারণ মানুষ নানা ভাবে বিভক্ত। কেউ ধার্মিক, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ বুদ্ধিজীবী, আর বেশীর ভাগই অত্যাচারিত খেটে খাওয়া মানুষ। তাই আমরা সাধারণ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হলেও ‘অ’সাধারণ মানুষজনেরা আরও ভালো থাকবে।

আশা করি এই ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ যেন সাধারণ বাঙালীর অস্তত্বহীনতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

If you have a story that looks suspicious, please share with us at factcheck@intoday.com or send us a message on the WhatsApp number 73 7000 7000

Writer

SOUMYA CHATTERJEE SOUMYA CHATTERJEE

Travel freak. Aspiring film director.

Comment